আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

আমার সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতি অঙ্গনে আসা || মো. ওমর ফারুক

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৩-২৫ ২০:০০:১০

আমি যে পরিবেশ থেকে এসেছি, সেখান থেকে এসে সিনেমা বা সাহিত্য রচনা করার কথা কখনো ভাবিনি, ২০০৭ সাল পর্যন্ত। সাধারণ দশটা ছেলের মতো আমারও চিন্তা পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি করে জীবন পার করে দিব পরিবার নিয়ে। চিন্তা অনুযায়ীই সব চলছিল। কিন্তু, বাংলাদেশি ব্যান্ড ‘মাইলস’র গানের মতো ‘এক ঝড় এসে ভেঙে দিয়ে গেলো, তাই জীবনটা এলোমেলো।’

অনার্স শেষ করতে পারিনি তা নয়- আসলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে হঠাৎ করে মনটা উধাও, একই সাথে হারিয়ে গেল। কেন? উত্তর আজ নেই- কারণ এরই মাঝে সাহিত্যচর্চা, সংস্কৃতিতে এগারো বছর শেষে বারো-তে পা দিয়ে ফেলেছি এবং নেই নেই সেই ঝড়টাও গুছিয়ে এনেছি- যা কল্পনাও করিনি।

বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট- এ যখন ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশনের তিন মাসের ছোট কোর্স করি তখনো শখেই ছিলাম। সেখানেও সার্টিফিকেটের জন্য পরীক্ষা দিই নি। কারণ অজানা।

ঢাকাতে কোন ভাবেই মন টিকছিল না, আবার বাড়ি ফিরে যাবো সে মুখও নেই। বাবা-মা কত আশা করেছিল আমাকে নিয়ে, তার কিছুই পূরণ করতে পারিনি। তারপরও, পরিবারই শিকড়, সেখানেই ফিরে যাই এক সন্ধ্যায়; ২০০৭’র ডিসেম্বর মাসে। সবাই সব জেনেও আমাকে কোন বকাঝকা দিলো না। মা শুধু জড়িয়ে ধরে কাঁদলো বেশ সময় নিয়ে।

বাড়িতেই থাকি, খাই, ঘুমাই, পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই। রাতে বাসায় আসলেই রাজ্যের চিন্তা মাথায় কিলবিল করে। আমি তাহলে কি করে জীবন কাটাবো, আমার প্রফেশন কি হবে! উত্তর খুঁজে পাই না। বই পড়ার অভ্যাস ছিল ছোটকাল থেকে- তাই দীর্ঘ রাত পর্যন্ত বই পড়তাম। এক সময় বইও পড়তে ভাল লাগে না। মাঝ রাতে শোয়া থেকে ওঠে ঝিম মেরে বসে থাকতাম। এমনি কোন রাতে বসে আছি, হঠাৎ তানভীর মোকাম্মেল স্যারের কথা মনে হলো। কিভাবে তিনি সিনেমা বানাতেন, সেই গল্পগুলো মনে পড়তো। সাহস করে খাতা কলম নিয়ে তখন থেকে দুইটা একটা দৃশ্য লিখার চেষ্টা করতাম, লিখে আবার ফেলে দিতাম। অনেক দিন এমন করে কাটাই।

এদিকে, পরিবার থেকে কথা তোলে এভাবে বসে আর কতদিন। কিছু কাজ করা উচিৎ, যেহেতু লেখাপড়া নেই। সিদ্ধান্ত হয় কোন একটা হাতের কাজ শিখে ডুবাই যাওয়া যেতে পারে। পাইপ ফিটিং এর কাজ শিখি মদনগঞ্জ গিয়ে। খুব লুকিয়ে। বন্ধুরা জানলে লজ্জা পাবো। কাজ শিখে ঢাকা ক্ষিলখেত এসে দুবাইয়ের ভিসার জন্য পরীক্ষা দিই এবং পাশ করি। বেতন দুবাই’র টাকায় ১২০০। এজেন্সি পাসপোর্ট ও বিশ হাজার টাকা নেয় এবং বলে মাসখানিকের মধ্যেই যেতে পারবো। ছয় মাস পরও পারিনি যখন, তখন সিদ্ধান্ত নিই বিদেশ কখনো যাবো না। যা করার দেশেই। স্কুলবন্ধুর সাথে মিলে গার্মেন্টসে সেলাই মেশিনের কারিগর দিই কমিশনের বিনিময়ে। অল্প দিনেই ভাল এগিয়ে যাই এখানে। মনে মনে ভাবি তাহলে এটাই আমার গন্তব্য। কিন্তু, প্রতি রাতে নিয়ম করে বিভিন্ন এলোমেলো দৃশ্য লিখার একটা নেশা জন্মে ওঠে একই সাথে। আবার, কবিতার মতো কিছু লিখি-কাটি-লিখি।

ব্যবসার চার মাসের মাথায় একটা কলংকজনক ঘটনায় ব্যবসা ছেড়ে দিই। টাকার লোভ মানুষ সামলাতে পারে না। কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু নীরবে বাসায় বন্দি হয়ে যাই। প্রায় সারাদিন বই পড়ি, দৃশ্য লিখি, কবিতা লিখি। কেন লিখি, এই লিখা দিয়ে কি করবো জানিনা, তবু লিখার নেশা গাঢ় হয় ধীরে।

পরিবার থেকে শুরু হয় তখন নানা মন্তব্য। বেকার এমন বড় ছেলে ঘরে সারাদিন দেখতেও নাকি শোভনীয় না। রোজ সকালে বাবা মা’র সাথে ঝগড়া আমাকে নিয়ে। সকালের আধা ঘুমে আমি শুনি, বাবা মা কে বলে- মা যেনো আমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে, আমাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবেনা বাবা। আমি চুপ করে শুনি, মাথা নিচু করে খেয়ে বাইরে যাই, শীতলক্ষ্যার তীরে বসে বসে নদী দেখি।

২০০৮ এর এপ্রিল/মে আসে একটা ফোন কল আসে- যাদের সাথে ফিল্মের কোর্স করেছিলাম সেখানকার এক বড় ভাই টিভি নাটক বানাবে। তার টিম দরকার। কি মনে করে আমাকে ডাকছেন জানি না- মনে তখন অন্য চিন্তা; বাড়ির এই লাঞ্চনা গঞ্জনা না শুনে ঢাকা চলে যাই, নিজের মতো থাকবো, লিখবো, নাটকে কাজ করবো।

এক বিকেলে বেরিয়ে পড়ি সেই উদ্দেশ্যে। পরিবারের কারো কোন কথা নেই- যেনো আমি গেলেই বাঁচে। হ্যাঁ, তাদের বাঁচিয়ে দিয়ে সেই যে ঘর ছাড়া, আজও পরিবারে নেই।

দশ বছর কিভাবে কতোজনের সাথে কত নাটকের প্রধান সহকারী পরিচালক ও নাটক লিখায় কাজ করেছি তা অবিশ্বাস্য! আর আমার ভিতর এতো কথা গল্প তাতে তো আমিই অবাক। কাজ করে টাকা পাওয়া যখন শুরু করলাম, আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গেল।

টানা ছয় বছর আর বাড়ি যাই নি। মা, কেঁদে যেতে বলে। মনে তখন জেদ, কিছু তো না করে যাবো না। এরই মাঝে প্রতিদিন উঠতে বসতে খেতে শুটিং-ও মোবাইলে কবিতা লিখতাম, রাতে সেগুলো খাতায় তুলতাম। সংখ্যায় হিসেব করে বলা যাবে না। তার মধ্যে কিছু পুড়িয়ে ফেলি, কিছু ভাঙারির দোকানে বিক্রিও করে দিই কেজি দরে টাকার জন্য নয়, ক্ষুধার জন্য।

কবিতা লিখি শখে- স্বপ্ন মাথায় সিনেমার পরিচালক হবো। বুকে সাহস-ও প্রচন্ড। বিভিন্ন পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে কাজের প্রশংসা পেয়ে ভূতটা ঘাড়েই চেপে বসে।

২০১৪, এপ্রিল। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। কারো সাথে আর নয়। আমি নিজেই এবার নিজের সিনেমা লিখবো এবং পরিচালনা করবো। টিভি নাটক বানাবো আমি নিজে এমনটা ভাবিইনি কখনো, হ্যাঁ অন্যদের সাথে কাজ করেছি টিকে থাকার পৃথিবীতে।

আবেগী সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় মনেই ছিল না আমার বা আমাদের কোন সম্পদ, অর্থ নেই- যা সিনেমার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তবুও এতোদূর এসে পিছিয়ে যাবো আবার! আমার আছে মেধা- আবিষ্কার করি। এবং শুরু করি আমার কল্পনায় লিখা সিনেমার প্রথম ধাপ।

কোথা থেকে শুরু কোথায় শেষ হবে তা জানতে, লিখতে হয়েছে দুই বছর। এরই মাঝে যে সব অমানবিক ঘটনা ঘটেছে, আমার সাথে তা আর মনে করতে চাই না।

*লেখক পরিচিতি: মো. ওমর ফারুকের নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার নয়ানগর গ্রামে জন্ম। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স করে কর্মজীবন শুরু হয় টিভি নাটকে প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে, ২০০৮ সালে। দেশের স্বনামধন্য প্রায় ত্রিশ জন নাট্যপরিচালকের সাথে প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ২০১৪ সাল পর্যন্ত। কাজের অবসরে কবিতা, সিনেমার ছোট ছোট দৃশ্য লিখার চর্চা নিয়মিত ২০০৮ সাল থেকে। বর্তমানে পুরোপুরি লেখালেখিতেই মনোনিবেশ করেছেন।

২০১৭, অক্টোবরে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘DEAD POET’ প্রকাশিত হয় নিজস্ব প্রতিষ্ঠান স্টুডিও ক্যাপ্টেনের নিবেদনে। ‘DEAD POET RETURNS’তার দ্বিতীয় কবিতার বই, যা চলতি মাসেই প্রকাশিত। তাঁর প্রথম উপন্যাস
HaaT (Market Places) প্রকাশিত হয়েছে এই মার্চ মাসে। লেখালেখির পাশাপাশি মো. ওমর ফারুক তাঁর প্রথম সিনেমার চিত্রনাট্য ‘ওয়াজ- আন হ্যাপি নয়েস’ এতিমধ্যে শেষ করে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সিনেমাটি নির্মাণের।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৫ মার্চ ২০১৮/আরআই-কে

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন