সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৬-২০ ১৯:১৮:৪৩
মুনজের অাহমদ চৌধুরী :: মরছে মানুষ। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্যে অনেকে সেটি দেখেন মুসলিম, খৃষ্টান ইহুদি হিসেবে। চোখের দৃষ্টিও সব ক্ষেত্রে যে সত্যি বলে, সেটিও নয় কিন্তু।
রোববার রাতে লন্ডনের ফিন্সবারী পার্ক মসজিদের অদূরে মুসল্লিদের উপর হামলার ঘটনা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব মানুষের চোখ অশ্রুসজল করে তুলেছে। সরে যেতে শুরু করেছে মুসলমানদের প্রতি সাম্প্রদায়িকদের সন্দেহের দেয়ালও।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর অস্ত্রবাজ দুনিয়ার অধিপতিদের একটি শত্রু পক্ষের দরকার অনিবার্য হয়ে উঠে। অাজকের ইসলামের নামে সন্ত্রাসের উৎস যে, সেই অাগুন নিয়ে খেলা; তার অাক্ষরিক-দালিলিক প্রমান হয়তো নেই। সাম্রাজ্যবাদ তার স্বার্থেই আইএস, আল-কায়েদা, কখনো তালেবান কিংবা কখনো জেএমবি নামে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠি সৃষ্টি করে। আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে নির্মূলে ব্যস্ত হয়। মাঝখানে রয়ে যায় মতবাদ নামের ভুলের বিষফোঁড়া।
পুনঃপৌনিকতার এ খেলা থেকে বেরোবার কথা ব্রিটেনে জেরেমি করবিনের মতো নেতারা বলছেন। যদিও ব্রিটেন বিশ্বে এখনো অন্যতম অস্ত্রবিক্রেতা রাষ্ট্র।
সিরিয়া, অাফগানিস্তানে মানুষ মরে, যুদ্ধবাজেরা দেখে সন্ত্রাসী মুসলিম হিসেবে। ব্রিটেন বা অামেরিকায় যখন অাইএস হামলা চালায়, তখনও কারো কারো মনে নীরব সমর্থন থাকেযেন সেটি অাগের গনহত্যারই পাল্টা মোক্ষম জবাব। প্রকৃত অর্থে, অাসলে কিন্তু মারছে সন্ত্রাস, মরছে মানুষ।
১৪০০ বছর অাগের ধর্ম ইসলাম। কই, অাগে কখনো তো ইসলামের নামে সন্ত্রাসে মানুষ মরেনি। হঠাৎ করে কেন, কারা, কাদের মদদে তা শুরু করলো, সেই ব্যাখ্যা যার-যার মতো সবার কাছে অাছে। অাসলে ধর্মকে অস্ত্র বানিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ অার পুজিঁর পেশি। যে কাজে মানুষের শান্তি বিনষ্ট হয়, নিরপরাধ মানুষের প্রাণ হরণ করা হয়, সেটাকে ইসলাম স্পষ্টত সমর্থন করে না। অন্যদিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিনে মানুষের সর্বপ্রথম যে বিচার করা হবে, তা হবে তাদের মধ্যে সংঘটিত রক্তপাত ও হত্যার বিচার (বোখারী, মুসলিম) ।
তাই জঙ্গিবাদকে ইসলামের সাথে জুড়ে দেবার চেষ্টা মুসলমানদেরই প্রতিহত করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, আল্লাহ ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের ভালোবাসেন না।’ (সূরা মায়েদা :৬৪)। জিহাদ ও সন্ত্রাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। সিরিয়ায় যাবার নামে তরুণ, তরুণীদের সেক্সি রোমান্টিসিজম যে ধর্ম নয়, সে ভ্রান্তি কেটেছে যেভাবে, বাকিটুকুও হবে, এটাই অাশাবাদ। ইউরোপে বা পশ্চিমের দেশগুলোতে মুসলমানদের চিত্ত বিনোদনের স্পেস খুজঁবার পথটুকুও ভাবনায় রাখতে হবে।
রোববার হাতে ফিন্সবারী পার্ক মসজিদে হামলার পর এক ঘন্টার ভেতরে মুসলিম কাউন্সিলের বিবৃতি এসেছে। ঠিক, এখন মুসলিম এখানে অাসলেই অাক্রান্ত।
কিন্তু কেবল বিবৃতি অার কথার মালার কি সাধ্য অাছে ভয়াল পাশবিকতা রুখে দেবার? এখন শক্ত বিবৃতির পাশাপাশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অামাদের সামর্থের সবটুকু দিয়ে সর্বচ্চো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদটাও দরকার। জানান দেয়া দরকার, ধর্মের নাম ভাঙ্গানো এ সন্ত্রাস মুসলমানরা কোনভাবেই সমর্থন করেন না। যে প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি, ব্রিটেনের সব মানুষকে নাড়িয়ে দিতে পারে। শ্লোগানের, জাগরণের শক্তি, ইসলামের সহনশীলতার শিক্ষা যাতে ভীত মাড়িয়ে দেয় ঘৃণা অার সব বিদ্বেষের। সময় অনেক গড়িয়েছে। ব্রিটেনের পথে-ঘাটে, টিউব স্টেশনে এখন অাশংকাজনক ভাবে হামলা অার বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন মুসলিমরা। হেইট ক্রাইম তুলে দিয়েছে সহনশীলতার অতীতে ঘৃনার দেয়াল। চক্রান্তকারীরা ইসলামের পবিত্র নামটির অপব্যাখ্যা সুকৌশলে ছড়িয়ে দিয়েছে ইংলিশদের মাঝে। ইসলামকে অপব্যাখ্যা করে মুসলিম মানেই প্রশ্নবোধকটির সঠিক জবাবটি তাদের পাইয়ে দেবার এখনই সময়।
এদেশে অামাদের সন্তান, প্রজন্মের জন্য বর্ণবাদের ঘৃণ্য বর্ণ মুছবার সংগ্রামে অার কোন এথনিক কমিউনিটি অগ্রণী ছিল না। লন্ডনে কৃষ্ণাঙ্গদের ব্রিকস্টন রায়টের পর বাংলাদেশীরাই ছিলেন অগ্রণী। পূর্ব লন্ডনের অালতাব অালী পার্ক বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শহীদ অালতাব অালীদের ত্যাগের শহীদ মিনারময় অামাদের অর্জনের স্তম্ভ। ফিন্সবারী পার্কেও রোববার রাতে প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশের সন্তান প্রবীণ মকররম অালী।
ইডিএলের মতো বর্ণবাদীদের পূর্ব লন্ডনের মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধভাবে অতীতে বিতাড়ন করেছেন। সেভাবে এখন যদি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মুসল্লীরা জুম্মার পর অথবা যে কোন পরিকল্পিত শান্তিপূর্ণ পথে সংহতভাবে মাঠে নামার সময়।
তাহলে ইসলামের অপব্যাখ্যা বা মুসলমানদের সম্পর্কে ব্রিটিশ ইংলিশদের ভুল ধারণার পুরোপুরি অবসান না-ই হোক, অন্তত অামাদের বক্তব্যটি, শান্তির শাশ্বত বার্তাটি তো তাদের কাছে তো পৌঁছুবে। থামবে দূরত্ব রেখার দৌরাত্ম্য।
ঘৃণা অার অশান্তির পথটি ইসলামের নয়। সেটি রোববার রাতে হামলাকারী ব্যক্তিটিকে মারতে নিবৃত্ত করে ফিন্সবারী পার্ক মসজিদের ইমাম ব্রিটেনকে অাবারো সহিংসার বিপরীতে অহিংসার শ্রুত অক্ষরে জানিয়ে দিয়েছেন। মোহাম্মদ মাহমুদ নামের ইমাম অামাদের শুরুর পথটি দেখিয়ে দিয়েছেন।
অনেকে বলবেন, এখানকার স্বীকৃত অার অস্বীকৃত বর্ণবাদের কষাঘাতের কথা। রোববার রাতেও তো ফিন্সবারী পার্কের ঘটনার প্রথম দুঘন্টা বিবিসি তো অাংশিক খবর প্রচার করেছে। গ্রীনফেল পার্কের অাগুনেও ঘুরে ফিরে সেই কজন ভিকটিমের স্বজনদের বক্তব্যই শুধু শুনিয়েছে মূল ধারার বহু মিডিয়া। ব্রিটেনের ভিসা থেকে শুরু করে সর্বত্রই অন্যায্য অাচরনের নজীর।
তবুও বলি, ব্রিটেনে জঙ্গিবাদের পরিকল্পিত দেয়ালটি ভাঙ্গতে অামাদের সন্তানরাই পারবেন। অতীতের উদাহরনীয় পথটি তাই বলে। তা না হলে, সন্ত্রাসের ভয়াল থাবা কেবল প্রজন্মের ভবিষ্যতে দেশটিতে বৈষম্যের পাচিঁলের দৈর্ঘ্য বাড়াবে। ইসলামের প্রকৃত অালোর সহনশীলতা অার ত্যাগের মহিমায় এ অন্ধকার ঘুচঁবেই। ত্রাস দিয়ে তো অার সন্ত্রাস রুখে দেয়া যায় না।
রক্তের মতোন অশ্রুর রংও এক। ব্রিটেনে মুসলমানদের প্রতি যে অ-বিশ্বাস অার ভয়ের দৃষ্টি বহু ইংলিশদের, সে চোখে অাজ পরম সহমর্মীতার অশ্রু। মকররম অালীর রক্তে ভেজা রমজানে সে অশ্রুফোটা হোক,ব্রিটিশ বাংলাদেশী; ব্রিটিশ মুসলিমের সম্প্রীতির শক্তি।
পুনশ্চ: ব্রিটেনে মুসলমানকে কারা সাথে থেকে জঙ্গিবাদে চিত্রিত করেছে সবার তা জানা। লন্ডনের পোট্রেট মিউজিয়ামে এখনও কিন্তু বাঙ্গালীর রক্ত চোষা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লর্ড ক্লাইভের পাশে সদর্পে শোভা পাচ্ছে সেই মীরজাফর। পোট্রেটের নীচে লেখা পরিচিতিতেও সেই মীরজাফরকে দেয়া হয়েছে বীরের সম্মান...। সেই ঘৃণিত মীরজাফরেদের সাথে এখানকার এখনকার রাজাকারদের যোগসূত্র কোথায়; জানি সে অন্বেষণ পাঠক অবশ্যই করবেন।
# লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক।