আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

বদি কেন আলোচনায়

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৫-২৬ ০১:২৫:২০

মির্জা মেহেদী তমাল ও সাখাওয়াত কাওসার :: সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে আবারও আলোচনায় টেকনাফের এমপি আবদুর রহমান বদি। সামাজিক গণমাধ্যম ও মিডিয়াতে তাকে ঘিরেই এখন আলোচনা। কেউ কেউ বলছেন, টেকনাফ দিয়ে মিয়ানমার থেকে আসা মরণনেশা ‘ইয়াবা গেট’ বন্ধ করতে হলে স্থানীয় এই এমপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এমনকি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, অপরাধী যে-ই হোক না কেন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একসময় ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে বদির সম্পৃক্ততার বিষয়ে তুমুল আলোচনা থাকলেও বদির বক্তব্য কতটা স্বচ্ছ তা নিয়ে আবারও তদন্ত করছে বিভিন্ন সংস্থা। জানা গেছে, ইয়াবার মতো ভয়াবহ মাদকের মূল উৎস টেকনাফ। মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ ইয়াবা প্রবেশ করছে বাংলাদেশে।

টেকনাফের অনেক স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা ইয়াবার সঙ্গে জড়িত থাকায় বারবার এমপি বদির নাম উঠে এসেছে। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ কর্মী এবং আত্মীয়স্বজনও সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। ২২ মে সচিবালয়ে এমপি বদির বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, ‘সংসদ সদস্য বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমাদের কাছে আছে। আমরা সেই অভিযোগগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছি। বদিসহ অন্য মাদক ব্যবসায়ীদের বিষয়ে আপনাদের কাছেও কোনো তথ্য থাকলে আমাদের দিন। বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তথ্য-প্রমাণ নাই।’ এ বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বদির বিষয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

গত বছর ৩১ ডিসেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) থেকে ১৪১ জনের তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়। ওই তালিকায় গডফাদার হিসেবে বদি ও তার পাঁচ ভাইয়ের নাম রয়েছে। তালিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠার একটি প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি দেশের ইয়াবা-জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তার ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। দেশের ইয়াবা আগ্রাসন বন্ধের জন্য তার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।’

তালিকায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে মাদকসাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি বলা হয়েছে। এতে বদির সঙ্গে তার পাঁচ ভাইয়ের নামও উঠে এসেছে। তারা হলেন মৌলভি মুজিবুর রহমান, আবদুস শুক্কুর, মো. সফিক, আবদুল আমিন ও মো. ফয়সাল। তাদের মধ্যে সরকারের প্রায় সব সংস্থার তালিকায় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি ছাড়া তার পাঁচ ভাইয়ের নাম রয়েছে। তবে আপন ভাই ছাড়াও তালিকায় বদির পিএস মং মং সেন ও ভাগ্নে সাহেদুর রহমান নিপুসহ আরও বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠভাজনের নাম রয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকা-সংক্রান্ত গোপনীয় প্রতিবেদনের ভূমিকা অংশে বলা হয়েছে, ‘সরকারদলীয় এমপি হওয়ার সুবাদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুসারী/সহযোগী নিয়ে তিনি ইচ্ছামাফিক ইয়াবা ব্যবসাসহ অন্যান্য উৎস হতে অবৈধ আয়ে জড়িত আছেন। শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তার অনিচ্ছার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসা করার সাহস রাখে না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জেলার অন্য শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বা টেকনাফের যে কোনো চাঁদাবাজ এলাকায় প্রভাব বিস্তারে সক্ষম নয়। বিশেষত মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হওয়া ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ করার জন্য তার ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’

এদিকে এক বছর আগে ডিএনসির করা তালিকায় ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা বলা হয় এক হাজার ২০০ জনের বেশি। দুই বছর আগের তালিকায় ছিল ৫৫৪ জন। দুটি তালিকাতেই কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আবদুর রহমান বদি, তার আপন দুই ভাই ও দুই সৎ ভাই রয়েছেন। রয়েছেন তার অনেক ‘অনুসারী’। তালিকায় বদির আপন ভাই মো. আবদুশ শুক্কুর ও মৌলভি মুজিবুর রহমান, দুই সৎ ভাই আবদুল আমিন ও ফয়সাল রহমানের নাম এসেছে। এর বাইরে বদির বেয়াই আখতার কামাল ও শাহেদ কামাল, মামা হায়দার আলী, মামাতো ভাই কামরুল ইসলাম রাসেল এবং ভাগ্নে নিপুও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বদির ঘনিষ্ঠ ও ডান হাত জাফর আহমেদ এবং তার চার ছেলের নাম রয়েছে শীর্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে। এরা হলেন শাহজাহান, ইলিয়াস, দিদারুল আলম ও মোস্তাক আহমদ। শাহজাহান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। বড় ছেলে মোস্তাক আহমেদ রয়েছেন নিখোঁজ। টেকনাফের সাধারণ মানুষ আক্ষেপ করে জানান, সৌন্দর্যের লীলাভূমি টেকনাফ ইয়াবায় এখন ভেসে থাকে। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কারণেই সাধারণ মানুষ আর এখানে বসবাস করতে চান না। অনেকে বাইরে পরিচয় পর্যন্ত দেন না।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টেকনাফে বদির ঘনিষ্ঠ ছয়জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জানা যায়, টেকনাফের মানুষের প্রধান ব্যবসাই ইয়াবা। টেকনাফের রাজনীতি আর অর্থনীতি সব চলছে ইয়াবাকে কেন্দ্র করে। জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে এমন কোনো সেক্টর নেই, যারা ইয়াবার ব্যবসায় জড়িত নন। ইয়াবা এখন এতটাই লাভজনক ব্যবসা যে লবণ, মাছ চাষ ও কাঠসহ বিভিন্ন বৈধ ব্যবসা ছেড়ে শত শত ব্যবসায়ী ইয়াবায় অর্থ লগ্নি করছেন। আর এসব কারণে সীমান্তবর্তী টেকনাফ হয়ে উঠেছে মাদকের স্বর্গরাজ্য। মাফিয়াদের বিচরণে মুখরিত থাকছে সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি টেকনাফ।

এ কারণে ইয়াবা ব্যবসায় বারবার উঠে আসছে এমপি আবদুর রহমান বদির নাম। এ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির বক্তব্য জানার জন্য তার মুঠোফোনে একাধিকবার রিং করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। বক্তব্য চেয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৯ মিনিটে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। তবে তিনি এর কোনো উত্তর দেননি।
-বাংলাদেশ প্রতিদিনের সৌজন্যে

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন