আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

রাজধানীতে কোনো বস্তি থাকবে না : প্রধানমন্ত্রী

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৮-১৯ ১৮:৩১:১৯

সিলেটভিউ ডেস্ক :: ঢাকা মহানগরীর আধুনিকায়নে তাঁর সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাজধানীর বস্তিগুলো বহুতল ভবনে প্রতিস্থাপিত হবে, যাতে করে নগরবাসী উন্নত স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে জীবন যাপন করতে পারে। আজ সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে ঢাকা ওয়াসার দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাজধানীতে কোনো বস্তি থাকবে না। এর স্থলে ২০ তলা করে ভবন গড়ে তোলা হবে। এখন যেমন বস্তিবাসীরা ভাড়া দিয়ে থাকেন, তেমনি তখন তাঁরা ওই সব ভবনেও দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দিয়ে বসবাস করবেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিদিন নানা প্রয়োজনে দরিদ্র মানুষকে রাজধানীতে আসতে হয়। আবার আমাদের দৈনন্দিন কাজেও এই শ্রমিক শ্রেণির প্রয়োজন পড়ে। তাঁরা যেন একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারেন, সে জন্যই তাঁদের বসবাসের জন্য একটু ভালো পরিবেশের দরকার।’



শেখ হাসিনা বলেন, ‘বস্তিবাসীরা এখন বস্তিতে যে ভাড়া দিচ্ছেন, সে ভাড়াতেই এখানে থাকবেন। অবশ্য তাঁদের ভাড়া দিয়েই থাকতে হবে। দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন হচ্ছে, কাজেই তাঁরাও যেন সেই ছোঁয়াটা পান, সেটা আমাদের দেখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘কেবল অবস্থাসম্পন্নদের জন্যই নয়, আমাদের উন্নয়ন সকলের জন্য।’
ঢাকার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে একই পাইপলাইনে নিয়ে আসতে চীন সরকারের সহযোগিতায় ঢাকা ওয়াসার ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়নাধীন মহাপ্রকল্পের অংশ হিসেবে খিলগাঁও এলাকায় এই দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রাজধানীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে রাজধানীতে আরও ৪টি পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এতে পাগলায় বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় দুটি এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় রায়েরবাজার এবং উত্তরায় আরও দুটি পয়োশোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে।

অনুষ্ঠানে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট একটি ভিডিও উপস্থাপনায় জানানো হয়, ৩ হাজার ৩৭৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প ২০২০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে। ২৪ হেক্টর জমির ওপর বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পয়োবর্জ্য পরিশোধনের মাধ্যমে ৫০ লাখ নগরবাসীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব জাফর আহমেদ খান, চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুয়ো ও ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বক্তব্য দেন। মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ, অন্যান্য হুইপ এবং সরকারের পদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি ও আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বস্তি এলাকার পানির ব্যবস্থা আমি করছি, কিন্তু ঢাকা শহরের বস্তিগুলো এখন যে দুরবস্থার মধ্যে আছে, সে বস্তি ঢাকা শহরে থাকবে না। আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি, মানুষ কেন এই মানবেতরভাবে জীবন যাপন করবে। তারাও মানুষ, তারা কোনো না কোনো কারণেই বস্তিতে আসে।’
বস্তিবাসীর জন্য তাঁর সরকারের বহুতল আবাসন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবাই ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকবে অথচ আমার বস্তিবাসী থাকবে না, এটা কেমন কথা। বিদ্যুৎ, পানির প্রিপেইড মিটার থাকবে, তারা যতটুকু ব্যবহার করবে, তার বিল দেবে। কারণ শহর যত উন্নত হয়, তার কাজের জন্য এ ধরনের কর্মীও লাগে। কাজেই তাদের জীবনমানটা যেন উন্নত হয়, সেদিকেও ভালোভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিছু পরিকল্পনা করেছে যেগুলো তিনি দেখে দিয়েছেন। কাজও শুরু হয়েছে ।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এভাবে সমগ্র ঢাকা এবং ঢাকা ছাড়াও পর্যায়ক্রমে যে পরিকল্পনা করা হবে তাতে জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পরিকল্পনা করেই আমরা কাজ করব।’
‘ভবিষ্যৎ যে উন্নয়নটা হবে, তার ছোঁয়া উচ্চবিত্তের পাশাপাশি এই খেটে খাওয়া নিম্নবিত্তরাও যাতে পায়, তা নিশ্চিত করা হবে। কারণ এই নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের জন্যই আমার রাজনীতি’, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাঁর সরকারকে ৬৮টি মামলা মোকাবিলা করতে হয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো কাজ করতে গেলেই এভাবে বাধা আসে এবং সেই বাধা অতিক্রম করেই আমাদের কাজ করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘এখন থেকেই যদি আমরা সেই ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পরিকল্পনা নিয়ে নিই, তাহলে ভবিষ্যতে আর সমস্যা হবে না।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোয় তাঁর সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার কার্যক্রম আধুনিক ও গতিশীল করার লক্ষ্যে বিলিং সিস্টেমকে ডিজিটালাইজ করা হয়েছে। ফলে গ্রাহকসেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ওয়াসার সিস্টেম লসের পরিমাণ শতকরা ৪০ ভাগ থেকে কমে ২০ ভাগে নেমে এসেছে। অত্যাধুনিক ডিএমএ (ডিস্ট্রিক্ট মিটারড এরিয়া) প্রযুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সিস্টেম লস ৫ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এটির জন্য ঢাকা ওয়াসা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে প্রশংসা অর্জন করেছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা মহানগরীর পানি শোধনাগারসমূহের পানির উৎস মূলত চারপাশের নদী। নদীর তলদেশের বর্জ্য অপসারণের কাজ শুরু করার জন্য ইতিমধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসাকে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যাঁরা এখানে কাজ করবেন প্রত্যেককে এ কথা মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকতেই মানুষকে সেবা দেওয়ার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।’ তাঁর সরকারের সরকারি কর্মচারীদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি এবং আবাসন সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি চাইব এখানকার কর্মরতরা যেন মানুষকে সেবা দেওয়ার বিষয়টার প্রতি লক্ষ রাখেন।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় হাতিরঝিলসহ রাজধানীর একটি বড় অংশে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার সমালোচনা করে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টিকারীদের সতর্ক করেন। তাঁর সরকারই প্রথম ১৯৯৬ সালে ঢাকা মহানগরীর জন্য নতুন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার সেবা ও কার্যপরিধির পুনর্বিন্যাস করে “ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬” প্রণয়ন করি। এরপর ২০০৯ সালে পুনরায় আমরা ক্ষমতায় এসে দেখতে পাই ঢাকা শহরে পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় এক বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনায় ২০১০ সাল থেকে ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনার কাজ শুরু করে। ঢাকা ওয়াসা একটি পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও গণমুখী পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের লক্ষ্য স্থির করে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকারের পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলেই ঢাকা ওয়াসা পানি উৎপাদন ও সরবরাহে ১০০ ভাগ সক্ষমতা লাভ করেছে। ঢাকা ওয়াসাকে এখন দক্ষিণ এশিয়ায় পানি সেবাদানকারী সংস্থার “রোল মডেল” হিসেবে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো বিবেচনা করে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘ ঘোষিত “এসডিজি-২০৩০”-এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বরটি হচ্ছে, “সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ”। পানিসম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা ১০০ বছর মেয়াদি “বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান-২১০০” নামে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এই দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় আগামী ১০০ বছরে পানির প্রাপ্যতা, তার ব্যবহার এবং প্রতিবেশগত বিষয়সমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে।’
এ সময় নিরাপদ পানি ও পয়োব্যবস্থাপনায় তাঁর সরকারের গৃহীত কার্যক্রমের মধ্যে ১৯৯৯ সালে জাতীয় পানি নীতি প্রণয়ন, ন্যাশনাল ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন অ্যাক্ট-২০১৪ প্রণয়ন, বর্ষার পানি সংরক্ষণে ৪ হাজার ৭০০টি জলাধার নির্মাণ, রাজধানী ঢাকায় নতুন খাল খনন এবং পুরোনো খালের সংস্কার ও জলাধার সংরক্ষণের উদ্যোগ এবং রাজধানীসহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীতে ড্রেজিং কার্যক্রমের উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ভবিষ্যতে তিনি সরকার গঠন করতে পারলে রাজধানীর জলাবদ্ধতার মূল কারণ বক্স কালভার্টগুলো উন্মুক্ত করে এর ওপর দিয়ে এলিভেটেড ওয়ে নির্মাণ করে দেবেন। কারণ, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন।
বুড়িগঙ্গার পানি গৃহস্থলির বর্জ্য এবং শিল্পবর্জ্যের মাধ্যমে দূষণ প্রতিরোধে এখানে দুই ধরনের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা একটি কমিটি করে দিয়েছি এলজিআরডি মন্ত্রীকে দিয়ে, সেখানে দুই ধরনের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বাস্তবায়নে তাঁরা কাজ করছেন। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা থেকে টঙ্গীর তুরাগ নদ পর্যন্ত এই প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিং করা হবে। কারণ, পানির ধারাটা বজায় রাখতে পারলে বুড়িগঙ্গায় আর দূষণ থাকবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাশাপাশি বালু নদ এবং ধলেশ্বরীও ড্রেজিং করতে হবে। যেন সেখান থেকে পনির প্রবাহটা বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত ঠিক থাকে এবং বৃষ্টির পানিটাও ধরে রাখতে পারে। নদী ড্রেজিং ছাড়া আমাদের এই দেশকে রক্ষার আর কোনো উপায় নেই।’ তিনি বলেন, ইতিমধ্যে সরকার পানি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সুয়ারেজ মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেছে, যার মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে রাজধানী ঢাকা আধুনিক পয়োসেবার আওতায় আসবে। তিনি বলেন, ‘আজকে যে দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্প এটা সেই মাস্টার প্ল্যানেরই একটি অংশ। আমি বিশ্বাস করি, এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট যদি আমরা না করি তাহলে ওই হাতিরঝিলকে রক্ষা করা সম্ভব নয়, কারণ সেখানকার পানি পচে যায়।’ তিনি এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটি বাস্তবায়িত হলে বারিধারা, গুলশান, বনানী, বসুন্ধরা, সংসদ ভবন, ক্যান্টনমেন্ট এলাকাসহ আশপাশের সমগ্র এলাকায় জলাবদ্ধতা ও দূষণ বন্ধ হবে এবং এসব এলাকার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা আরও সুন্দর হবে।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৯ আগস্ট ২০১৮/ডেস্ক এলএস

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন