Sylhet View 24 PRINT

বাংলাদেশে পশ্চিমাদের দ্বিমুখী আচরণ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৫-১১ ১২:৩৬:০৬

সিলেটভিউ ডেস্ক  :: গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলো দ্বিমুখী আচরণ করছে বলে মন্তব্য করেছেন ‘মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা’ বইয়ের লেখক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধকালে মহান অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘মুক্তিযোদ্ধা পদক’ পাওয়া এই লেখক জানান, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যে অভিযোগ আরোপ করা হচ্ছে তা এই দেশগুলো নিজেরাই চর্চা করছে না। দ্য ইস্টার্ন লিংক নামক পত্রিকায় লেখা এক কলামে তিনি এ কথাগুলো বলেন।

কলামে তিনি জানান, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ঘটনার দীর্ঘ ২১ বছর পর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ততদিনে জাতির পিতার শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতক অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তবুও দেশে থাকা কিছু ঘাতককে ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবুও এটি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর ছিল নানা ধরণের অভিযোগ। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ফাঁসি নিয়ে অভিযোগ জানালেও পশ্চিমারা নিজেদের প্রয়োজনে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের কখনই তোয়াক্কা করেনি।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিতে একটি লেখায় বলেন, ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে রাশেদ চৌধুরী(বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামি)স্বাধীনভাবে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। সে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডিত আসামি। সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে আদালত তার অনুপস্থিতিতে তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেন।যদিও সে সেনাবাহিনীর কর্নেল ছিলেন। চাইলে মার্শাল ল’র মাধ্যমে খুব দ্রুত এবং অস্বচ্ছ উপায়ে শাস্তি দেয়া যেত।

এই রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যাবর্তনের জন্য ২০০০ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আবেদন করা হয়। তবে আজো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে ফেরত দেয়া হয়নি। চৌধুরী মহিউদ্দিন নামের আরেক যুদ্ধাপরাধী বাস করছেন গণতন্ত্রের অন্যতম তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্যে। ১৯৭১ সালে হাজার হাজার মানুষকে হত্যার পরেও বেশ স্বাচ্ছন্দভাবে যুক্তরাজ্যে বাস করছেন তিনি।

১৯৯৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পুরুলিয়া জেলার ঝালদা, বেলামু, মারামু-সহ সাতটি গ্রামে ‘আন্টোনভ এ এন-২৬’ বিমান থেকে প্রায় বিপুল পরিমাণ একে-৪৭ রাইফেল এবং গোলাবারুদ ফেলা হয়েছিল। এর ক’দিন পর বিমানটি ফের ভারতে ঢুকলে ভারতীয় বিমান বাহিনী সেটিকে আটক করে। গ্রেফতার হন ব্রিটিশ নাগরিক পিটার ব্লিচ এবং আরও পাঁচ লাটভীয় নাগরিক। এই ঘটনায় অভিযুক্ত যুক্তরাজ্যের নাগরিক পিটার ব্লিচকে মুক্তি দিয়েছে ভারত সরকার। কিন্তু এই ঘটনার পর উধাও হয়ে যান অস্ত্র বর্ষণের মূল হোতা কিম পিটার ডেভি এবং তার সঙ্গী জ্যান ক্রিস্টিয়েন নেইলসেনকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেনি যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ভারতের কারাগারের দুরাবস্থার কারণে প্রত্যাবর্তন করা হবে না। এছাড়া যুক্তরাজ্যের নাগরিক পিটার ব্লিচার শাস্তি মওকুফের জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনও করেছিল যুক্তরাজ্য। এই ব্রিটিশরাই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের মামলায় উধাম সিংকে ১৯৪০ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো। আজ তারাই মানবাধিকারের নামে অপরাধীদের লুকিয়ে অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।

বাংলাদেশের বেলাতেও একই রকম দ্বিমুখী আচরণ করছে পশ্চিমা দেশের সরকাররা। গত ৭ মে বাংলাদেশ সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য সংবলিত কোনও পোস্ট দেওয়া ও লাইক-শেয়ার করতে পারবেন না বলে নির্দেশ জারি করেন। আর সরকারের এমন নির্দেশের ঘোর বিরোধিতা করেছেন বাংলাদেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট আর মিলার। একটি টুইট বার্তায় রবার্ট আর মিলার বলেন, জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য স্বাধীন এবং মুক্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত নির্ভরযোগ্য এবং সত্য ভিত্তিক তথ্যের প্রয়োজন। সুতরাং মিলারের কথায় বোঝা যাচ্ছে গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশের সরকারী কর্মীরা চাইলে সরকারের বিরুদ্ধে লিখতে এবং অস্থির পরিবেশ তৈরি করতে পারবে। কিন্তু খোদ মিলারের দেশ যুক্তরাষ্ট্রতেও করোনা ভাইরাসের সময় সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং বিজ্ঞানীদের তথ্য প্রদানের বিষয়ে কিছু বিধি আরোপ করা হয়েছে। যাতে সকল তথ্য গণমাধ্যমে না আসে। গত ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সকল তথ্যই ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের অফিসের তদারকির মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। চাইলেই মার্কিন সরকারের যে কেউ যে কোন খবর প্রকাশ করতে পারবে না। আর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন’র কাছে এমনটি বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশেষজ্ঞ ড অ্যান্থনি ফৌসি। শুধু যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে সমালোচনা করেছে তা কিন্তু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ সরকারের ওই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন বলেন, করোনা দুর্যোগে মত প্রকাশের স্বাধীনতা জরুরি। আর এটি গণমাধ্যমের কাজ।

যুক্তরাজ্যও কিন্তু করোনা দুর্যোগে কাজ করা স্বাস্থ্য কর্মীদের তথ্য প্রকাশের ক্ষেতে হুমকি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কর্মীরা এই নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু নিজেদের দেশ এত কিছু করলেও পূর্বের ধারা বজায় রেখে মিলার এবং ডিকসন পশ্চিমা দেশের মুখপাত্র হয়ে গণতন্ত্র এবং মুক্ত বক্তব্যের ইস্যুতে বাংলাদেশের সমালোচনা করেছেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একেএ আব্দুল মোমেনও এশিয়ান নিউজ ওয়েবসাইটে দেয়া সাক্ষাতকারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো দ্বিমুখী আচরণের অভিযোগ তুলেছেন। বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। সেখানে মিয়ানমারকে কোন কিছুই বলছে না পশ্চিমা দেশগুলো। যদিও মিয়ানমার চীন ঘেঁষা একটি রাষ্ট্র। ঢাকার মেয়র নির্বাচনের সময়েও দেশিদের বিদেশী পর্যবেক্ষকদের তালিকায় ঢুকিয়ে সমালোচিত হয়েছিল পশ্চিমা মিশনের ১০টি দেশ। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী দল জামাতে ইসলামেরও সদস্য ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সময়েও এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনের (আনফ্রেল) সদস্যদের আনতে চেয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলো। সেই সময় ভারতীয় একজন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের সময় টিভিকে বলেন, মানবাধিকার, গণতন্ত্রের নাম করে ক্ষমতার পালাবদল চায় যুক্তরাষ্ট্র। আর তাই দেশটির গোয়েন্দাদের অর্থায়নে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক বানাতে চায় আনফ্রেলকে।

১৯৭১ সালের ইয়াহিয়া আমল থেকে ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর হত্যা পর্যন্ত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র ভূমিকা ‘বাংলাদেশ: দ্য আনফিনিশড’ গ্রন্থটিতে বিস্তারিত লেখেছনে লরেন্স লিফশুলজ। আর মার্কিন গোয়েন্দাদের সেই কূট কৌশল গণতন্ত্রের নামে চালিয়ে যাচ্ছে রবার্ট আর মিলাররা।

(লেখক ‘মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা’ গ্রন্থের পাশাপাশি সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রকাশিত অপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘রোল অব সিদ্ধার্থ রয় ইন ইমার্জেন্সি’ এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের জীবনী নিয়ে লেখা ‘মনমোহন’। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি অবরুদ্ধ বাংলাদেশে থেকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি আনন্দবাজার, বম্বে ব্লিৎজ, গালফ নিউজ এবং বিবিসির সঙ্গে কাজ করেছেন)।
সিলেটভিউ২৪ডটকম/১১ মে ২০২০/ডেস্ক/মিআচৌ

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.