Sylhet View 24 PRINT

খুনের কৌশলেই খুনিকে চিনল পুলিশ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৯-১২ ০১:০২:৪৩

মির্জা মেহেদী তমাল :: ২০০০ সালের ৫ মে। সাত সকালে মোহাম্মদপুর রিভেলদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায় ২৬-২৭ বছরের এক যুবক।

পরনে জিন্সের প্যান্ট, প্রিন্টের শার্ট। এলোমেলো চুল। চিৎকার করে রিভেলকে ডাকে। এত সকালে কে ডাকাডাকি করছে? বিড়বিড় করতে করতে বারান্দায় এসে দাঁড়ান রিভেলের মা। বলেন, রিভেলতো ঘুমিয়ে আছে। খুব বিনয়ের সঙ্গে যুবকটি বলে, ‘খালাম্মা রিভেলকে খুব দরকার। ’ চেনাজানা বলেই মা রিভেলকে ডেকে দিল। রিভেল ঘুম থেকে উঠে বাসার বাইরে গিয়ে যুবকটির সঙ্গে দেখা করে। কথা বলতে বলতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর একটি নীরব স্থানে গিয়ে যুবকটি তার পকেট থেকে একটি পিস্তল বের করে। রিভেল কিছুই বুঝতে পারেননি। চোখ থেকেও তার ঘুম কাটেনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার বুকে পিস্তল ঠেকায় সেই যুবকটি। এরপর ট্রিগারে আঙ্গুলের চাপ। পর পর দুই রাউন্ড। পেছন দিকে ছিটকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ে রিভেল। গুলি রিভেলকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। রক্তাক্ত রিভেল নর্দমায় পড়ে থাকে। আশপাশের লোকজনের সন্দেহ হওয়ার আগেই যুবকটি হাওয়া। আধা ঘণ্টা পর যুবকটি আবারও ফিরে যায় রিভেলদের বাসায়। এবার রিভেলের বড় ভাই জুয়েলকে প্রয়োজন তার। ডাকে জুয়েলকে। বেরিয়ে আসে জুয়েল। কথা বলতে বলতে তারা দুজনে এগিয়ে যায়। সামনের রাস্তায় গিয়ে একটু বাম দিকে মোড় নেয়।

কথা বলতে বলতেই আশপাশে চোখ ঘোরাচ্ছিল যুবকটি। নাহ, কোথাও কেউ নেই। এবার জুয়েলকেও কিছু বুঝতে দিল না। রাস্তার ওপর জুয়েলের শরীরে পিস্তল ঠেকিয়ে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। রক্তাক্ত জুয়েল পড়ে থাকে রাস্তায়। গুলির শব্দে আতঙ্ক চারদিক। লোকজন শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে রাস্তার ওপর জুয়েলের সন্ধান পায়। হাতে ধরা পিস্তল উঁচু করে এবার দৌড়ে পালায় যুবকটি। মোহাম্মদপুরে এভাবেই আধা ঘণ্টার ব্যবধানে বাসা  থেকে ডেকে নিয়ে এক যুবক ফিল্মি স্টাইলে দুই ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, একজন মাত্র খুনি ঠাণ্ডা মাথায় পরপর দুটি খুন করে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা পুলিশের কেস হিস্ট্রিতেও বিরল। পুলিশের তখন ঘুম হারাম হওয়ার অবস্থা। খুনের এই ঘটনাটি রাজধানীসহ সারা দেশে চাউর হয়ে যায়। রাজধানীতে এমন ঠাণ্ডা মাথার কিলারের অবাধ বিচরণ রয়েছে—এমন ভাবনায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পুলিশও তাকে ধরতে পারছে না। জোড়া খুনের এ মামলার তদন্তে নামে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একমাত্র কামাল পাশার খুনের ধরন থাকত ভিন্ন। ঠাণ্ডা মাথার এমন খুনি খুব একটা মেলে না। জোড়া খুনের ধরন দেখেই পুলিশ নিশ্চিত হয়েছিল জোড়া খুনের খুনি কামাল পাশা।

পরে পুলিশ নিশ্চিত হয়, এই খুনি হলেন রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী কামাল পাশা। পলাতক থাকা অবস্থায় যার মাথার মূল্য সরকার লাখ টাকা ঘোষণা করেছিল। দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসী কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা যায়। একের পর এক ফিল্মি স্টাইলে খুনের ঘটনা ঘটালেও তার পরিবার প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিল, তাদের সন্তান মানসিক রোগী। মানসিক সমস্যার কারণে কামাল পাশাকে চিকিৎসাও করানো হয়েছিল। পরিবারের এই দাবির পর থেকে কামাল পাশা আন্ডারওয়ার্ল্ডে ‘পাগলা পাশা’ নামেও পরিচিতি ছিল। বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কামাল পাশা দিনের বেলায় খুন করতে পছন্দ করতেন। তিনি তার সহযোগীদের প্রায়ই বলতেন, দিনে নানা কায়দায় আক্রমণ করা যায়। প্রতিপক্ষের মৃত্যু নিজের চোখে দেখা যায়। এতে শান্তি পাওয়া যায় মনে! কামাল পাশার ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন একজন জানান, অন্ধকারকে ভয় করত পাশা। যে কারণে দিনের বেলায় খুনের ঘটনা ঘটাত। যে হত্যাকাণ্ডগুলো পাশা ঘটিয়েছে, তার প্রত্যেকটি দুঃসাহসিক। ফিল্মি স্টাইলে খুন করতে সে ভালোবাসত। ভাড়াটে কিলার হিসেবে তার নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল। তার বিরুদ্ধে যে খুনের অভিযোগগুলো রয়েছে, তার অধিকাংশই ছিল ভাড়াটে হিসেবে।

ইতিমধ্যে দুটি খুনের ঘটনায় ফাঁসির রায় হয়। সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সালের এাপ্রিলে আগারগাঁওয়ে খুন হন শামীম ও মামুন। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ এই জোড়া খুনের ঘটনাটি ঘটায়। কিন্তু কিলার হিসেবে ছিল কামাল পাশা। কামাল পাশার নেতৃত্বেই ওই জোড়া খুনের ঘটনাটি ঘটে। মূলত শামীম-মামুন জোড়া খুনের মধ্য দিয়েই হয় তার খুনাখুনির হাতেখড়ি। ১৯৯৭ সালের ২২ মে কামাল পাশা শাহবাগ পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) গুলি করে হত্যা করে ঠিকাদার আশিক ইকবালকে। দিনদুপুরে কামাল পাশা এবং তার সহযোগী রাশেদ মোস্তফা ওরফে রতনকে নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আশিক ইকবালকে গুলি করে হত্যার পর তারা দুজনে একটি বেবিট্যাক্সি নিয়ে পালাতে থাকে। শত শত লোকের সামনে পিস্তল উঁচিয়ে রাখে কামাল পাশা। বেবিট্যাক্সিতে ওঠার পরেও তার হাতে পিস্তল দেখা যাচ্ছিল।

সোনারগাঁও হোটেলের সামনে একজন পুলিশ সার্জেন্ট জীবনবাজি রেখে তাদের সেই বেবিট্যাক্সির গতিরোধ করে। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাদের দুজনকে পাকড়াও করা হয়। উদ্ধার হয় দুটি পিস্তল ও ২০ রাউন্ড গুলি। আটক কামাল পাশা জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর ২০০০ সালের প্রথম দিকে উত্তরায় গুলি করে এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এর কিছুদিন পরই বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে দুই ভাই আশরাফ হোসেন জুয়েল (২৮) এবং মোহাম্মদ আলী রিভেলকে (২৪)। কামাল পাশা গা ঢাকা দেয়। ওই অবস্থায় বনানীতে একজন ব্যবসায়ীকে হত্যা করে কামাল পাশা। বিএনপি জোট সরকার আমলে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে কামাল পাশাকে ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পরে কামাল পাশার বাবা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ইতিমধ্যে দুই ভাই হত্যা মামলায় তার ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়।
-বাংলাদেশ প্রতিদিন

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.