আজ বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং

পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছেন তারেকের স্ত্রী-কন্যাও

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৪-২৫ ০১:০৫:৫২

শুধু তারেক রহমানই নন, তাঁর স্ত্রী জোবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা জারনাজ রহমানও তাঁদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ফিরিয়ে দিয়েছেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহিরয়ার আলম গতকাল সোমবার বিকেলে ঢাকার গুলশানে তাঁর বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাংলাদেশি পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়া সংক্রান্ত তথ্যের সত্যতা চ্যালেঞ্জ করে বিএনপির বক্তব্য দেওয়া এবং তারেক রহমানের পক্ষে আইনি নোটিশ পাঠানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়েছে। আজ বলছি, শুধু তারেক রহমান নন, তাঁর স্ত্রী জোবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা জারনাজ রহমান—তাঁদের পাসপোর্টও যুক্তরাজ্য হোম অফিস (স্বরাষ্ট্র দপ্তর) আমাদের হাইকমিশনে ফেরত দিয়েছেন।’

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। সে ব্যাপারে আমাদের আলোচনা চলছে। এ মুহূর্তে আমি আর বলতে চাই না। তবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁদের (তারেক রহমান ও পরিবার) এখানে আসার ইচ্ছা নেই বলেই হয়তো তাঁরা বাংলাদেশি পাসপোর্ট হস্তান্তর করেছেন।’

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অবর্তমানে জোবাইদা রহমান বা জাইমা জারনাজ রহমান দলের নেতৃত্ব দেবেন—এমন ভাবনার ইঙ্গিত করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক বিভিন্ন সমীকরণে তাঁর (তারেক রহমান) স্ত্রী, কন্যার কথা আসে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাঁদের কারো কাছেই কোনো বৈধ ট্রাভেল ডকুমেন্ট নেই, যা দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে আসতে পারবেন। সেই জায়গায় তাঁদের কী পরিকল্পনা, সেটি তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন।’

শাহিরয়ার আলম বলেন, তারেক রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা স্বেচ্ছায় দেশে ফিরতে চাইলে তাঁদের বাংলাদেশি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে হবে। বাংলাদেশ তা আইন অনুযায়ী বিবেচনা করবে। যুক্তরাজ্য তারেক রহমানকে ফিরিয়ে দিলেও তাঁকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট বা এককালীন ট্রাভেল ডকুমেন্টে আসতে হবে। লন্ডনে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, তারেক রহমান বাংলাদেশি পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর বাংলাদেশি নাগরিকত্বই সমর্পণ করেছেন। পাসপোর্ট জমা দেওয়ার অর্থ নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়া কি না, সে প্রশ্ন ছিল গতকাল সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছে কালের কণ্ঠ’র। জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি এটিই মনে করব। কারণ বিদেশে আপনার আইডেনটিটি (পরিচয়) আপনার পাসপোর্ট। সেই পাসপোর্টটি যখন আপনি ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন, তখন তো আপনি আপনার সেই নাগরিকত্ব দাবি করছেন না। আপনি বলছেনও না আপনি কী।’

শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আমার পাল্টা প্রশ্ন থাকবে জাতীয়তাবাদী দলের কাছে। তারা পরিষ্কার করে বলুক, কী স্ট্যাটাস নিয়ে, কী লিগ্যাল প্রটেকশন (আইনি সুরক্ষা) নিয়ে তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন? তারা কিন্তু এখনো পরিষ্কারভাবে বলেনি। তারা অব্যাহতভাবে বলে চিকিৎসার জন্য।’ তিনি বলেন, ‘এটি হাস্যকর একটি বিষয়। চিকিৎসার জন্য এসে...আমরা দেখেছি কিছুদিন আগ পর্যন্ত। ইদানীং দেখা যায় না। কারণ আমরা ব্রিটিশ সরকারের কাছে অভিযোগ করার পর তাঁর (তারেক রহমানের) মুভমেন্ট (চলাফেরা) রেসট্রিক্টেড (বিধিনিষেধ আরোপ) করে দেওয়া হয়েছে।’

তারেক রহমান সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘(তারেক) অসত্য বক্তব্য দিচ্ছেন। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। অসুস্থতা তাঁর একটি ছুতা।’ তিনি বলেন, জীবনে বেঁচে থাকতে বাংলাদেশে আর রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে তারেক রহমান দেশ ছেড়েছিলেন। এরপর বিদেশে গিয়ে তাঁর পাসপোর্ট হস্তান্তর। এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল কিসের আশায় তাঁকে চেয়ারম্যান করে বা তাঁকে ভবিষ্যৎ হিসেবে দেখে এটি তাদের বিষয়।

এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, তারেকের নাগরিকত্বের বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ই বলতে পারবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, তারেক রহমান কী হিসেবে লন্ডনে আছেন সে বিষয়ে বারবার বাংলাদেশ জানতে চাইলেও যুক্তরাজ্য বলেছে যে তাদের দেশের গোপনীয়তা আইনের কারণে ব্যক্তি তারেক রহমান সম্পর্কে তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়।

তারেকের পাসপোর্টসংক্রান্ত তথ্য : শাহরিয়ার আলম বলেন, লন্ডন থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গতকাল সাড়ে ১১টায় তিনি ঢাকা ফিরেছেন। তারেক রহমানের পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়ার তথ্যকে বিএনপি অসত্য দাবি করার পর তিনি যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে চিঠি ও পাসপোর্টের কপি আনান। সাংবাদিকদের কাছে সেগুলো তুলে দিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালের ২ জুন যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর একটি ফরোয়ার্ডিং চিঠির মাধ্যমে তারেক রহমানের পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছে। তারেক রহমানের পাসপোর্টের নম্বর ছিল সি০৯৭৪৪৯৬। এই পাসপোর্টটি ইস্যু হয়েছিল ২০০৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। তখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিচারাধীন বা কারান্তরীণ ছিলেন। পাসপোর্ট ইস্যুর পাঁচ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২০০৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তিনি যুক্তরাজ্যের ভিসা পেয়েছিলেন। পাসপোর্টে সিল অনুযায়ী তিনি ২০০৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেন ছয় মাসের ভিসা নিয়ে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর যখন তাঁর নামে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় তখন তার রেফারেন্সে একটি তথ্য ছিল। তাঁর পুরনো একটি পাসপোর্ট ছিল, যার নম্বর ডাব্লিউ০৭৫৭৪২৪। ২০০৪ সালের ৭ অক্টোবর ওই পাসপোর্টটি ইস্যু করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পাসপোর্ট ইস্যু করার সময় বলা হয়েছিল, তাঁর আগের পাসপোর্টটি হারিয়ে গেছে।

প্রতিমন্ত্রী জানান, ২০০৮ সালে তারেকের নামে ইস্যু করা পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০১০ সালের ৩ জুন পর্যন্ত। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দিকে তিনি তাঁর পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেন। ২০০৮ সালের ১০ ডিসেম্বর তার সেই পাসপোর্টের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে যিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বিদেশে পরিচিত হতে চান, খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি সেই পাসপোর্টটি নবায়ন করে নেবেন অথবা মেয়াদ বাড়িয়ে নেবেন। সেটি না করে ব্রিটিশ হোম অফিসের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ২ জুন তিনি তাঁর, স্ত্রীর ও কন্যার পাসপোর্টটি আমাদের হাইকমিশনে ফেরত দিয়েছেন।’

শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘এত কিছুর পরও কারো যদি কোনো প্রশ্ন থেকে থাকে, আমি তাকে অনুরোধ করব, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী দলের কেউ যদি আগ্রহী হন, আমরা ব্যবস্থা করব, দয়া করে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়ে দেখে আসবেন। এই পাসপোর্টগুলো স্বাভাবিকভাবেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা থাকে। যদি আদালত চান সে ক্ষেত্রে হয়তো দেখানো যেতে পারে।’

বিএনপির আইনি নোটিশ প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি শুনেছি, তারা (বিএনপি) একটি উকিল নোটিশ ইস্যু করেছে। একটি বিষয় ভালো লাগল যে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি তাদের বোধ হয় বিশ্বাস পুনঃস্থাপিত হয়েছে। কারণ প্রতিনিয়ত তারা আস্থাহীনতার কথা বলে এবং একজন দোষী সাব্যস্ত হওয়া অপরাধী এমন একটি বৈধ ডকুমেন্টেশনের পরও কিভাবে উকিল নোটিশ দেয় সেটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। তারা যদি মামলা করতে চায়, তাহলে আমরা অবশ্যই একে মোকাবেলা করব। অন্য যে পত্রিকাগুলোকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে, সেটা তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’

বিএনপিকে তারেকের পাসপোর্ট দেখাতে বলল আ. লীগ : এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গতকাল বিকেলে ঢাকার ধানমণ্ডিতে দলীয় সভাপতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনেও তারেকের বাংলাদেশি পাসপোর্ট না থাকার বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ ওই সংবাদ সম্মেলনে বিএনপিকে তারেক রহমানের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখাতে বলেছে।

আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন দলের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পাসপোর্ট রিনিউ (নবায়ন) করার জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনে কোনো আবেদন করেছেন কি না, এটা যদি তারা (বিএনপি) দেখাতে পারে, তাহলে আমরা তাদের বক্তব্যকে স্বাগত জানাব। মূলত তিনি (তারেক) বাংলাদেশের পাসপোর্ট সারেন্ডার (সমর্পণ) করেছেন।’ স্বপন বলেন, সত্য তথ্য প্রকাশ করার জন্য যদি ক্ষমা চাইতে হয়, তাহলে সেটা দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।

খালেদা জিয়ার সাজা এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে বিএনপির নানা বক্তব্যের জবাব দেন স্বপন। তারেক রহমানকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বানিয়ে বিএনপি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কলঙ্কিত করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা চিহ্নিত ও সাজাপ্রাপ্তদের দেশে ফিরিয়ে এনে সরকার আইনের হাতে সোপর্দ করে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আইনের শাসন সমুন্নত রাখার স্বার্থেই তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে জিয়া পরিবারকে ধ্বংসের চক্রান্ত আবিষ্কার করে বিএনপি হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।

আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক সন্ত্রাস করে, আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারেক রহমান নিজেই নিজের রাজনৈতিক কবর রচনা করেছেন। তারেক রহমানের কাছে শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাজ্যের নাগরিকরাও নিরাপদ নয়।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন