Sylhet View 24 PRINT

মিরাজের প্রেমে-বিয়ে...এ যেন সিনেমা!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০৩-২৬ ২০:৩৭:১৭

সিলেটভিউ ডেস্ক :: কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তাঁকে জায়গা করে নিতে হয়েছে জাতীয় দলে। খুব সাধারণ এক পরিবার থেকে উঠে আসা মিরাজ বাংলাদেশের হয়ে গত তিন বছরে অসাধারণ সব গল্প লিখেছেন। কদিন আগে তাঁর বিয়ে নিয়ে হয় বেশ হইচই। মিরাজের প্রেমের গল্পটাও কম সংগ্রামমুখর নয়

৮ মার্চ, ওয়েলিংটন টেস্টের প্রথম দিনটা ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। ওয়েলিংটনের বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় মেহেদী হাসান মিরাজের কি খুব মনে পড়ছিল প্রীতি অর্থাৎ রাবেয়া আখতার প্রীতির কথা? এই টেস্টে মিরাজ একাদশে নেই। বৃষ্টিবাধায় দলের খেলাও নেই। নিস্তরঙ্গ সময়ে মনে পড়তেই পারে শতসহস্র মাইল দূরে থাকা প্রেয়সীর কথা। বাতাসের শহর ওয়েলিংটনে মনে গুনগুন সুর উঠতেই পারে, ‘সময় যেন কাটে না/ বড় একা একা লাগে/ এই মুখর জনারণ্যে/বিরহী বাতাস বহে...।’

মিরাজ বিয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন নিউজিল্যান্ড সফরে থাকতেই। ভেবেছেন, ছয় বছরের পরিণয়কে পরিণতি দিতে এটাই সেরা সময়। মিরাজ মনে করেছেন, প্রীতির হৃদয় যেখানে, তাঁর হৃদয়ও সেখানে। দুটি হৃদয় যেহেতু সংগ্রামমুখর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মিলেছে এক বিন্দুতে, আর দেরি করা ঠিক নয়।

মিরাজের ছয় বছরের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর ভক্তদের অনেক কৌতূহল। তিন বছর আগেও যিনি খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট, তিনি প্রেম শুরু করেছেন কবে থেকে? প্রেমের সম্পর্কটা আসলে কত দিনের, সেটি নির্ণয় করতে পারেন না মিরাজ নিজেও। শুধু জানেন, প্রীতির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছয় বছর আগে, খুলনায় শৈশবের কোচ আল মাহমুদের সূত্র ধরে, ‘মাহমুদ ভাইকে প্রায়ই দুষ্টুমি-রসিকতা করে বলতাম, আপনার পরিচিত কোনো মেয়ে থাকলে বলতে পারেন। যদি ভালো লেগে যায়, তাকেই বিয়ে করব। আমি রসিকতা করে বললেও মাহমুদ ভাই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। সত্যি সত্যি একদিন আমাদের এলাকার একটা মেয়েকে দেখালেন তিনি। তারিখটা স্পষ্ট মনে আছে—২০১৪ সালের ২৮ মার্চ। আরব আমিরাতে মাত্রই ২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে এসেছি। ওকে প্রথম দেখাতেই ভালো লাগল। আমারই বয়স তখন আর কত! ও তো আরও ছোট। কিন্তু ভালো যখন লেগে গেছে, মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, জীবনে যদি বিয়ে করি ওকেই করব।’

ব্যক্তিগত জীবনের অনেক চাওয়া-পাওয়া সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যায় হাওয়ায়, যদি সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করা যায়। মিরাজ সেটি ভালো করেই জানতেন। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের গণ্ডি না পেরোতেই একটা মেয়ের সঙ্গে কোন ভরসায় তিনি সম্পর্কে জড়াতে চান তবে? সহজাতভাবে সাহসী, ইতিবাচক মানসিকতার মানুষ। আত্মবিশ্বাস হারান না কখনোই। মিরাজ তাই মনস্থির করেছিলেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েই তিনি প্রীতির পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন। তবে আশঙ্কা ছিল, এই সম্পর্ক সহজে হওয়ার নয়। প্রীতিকে পেতে তাঁকে পাড়ি দিতে হবে কঠিন পথ। আসবে অনেক বাধাবিপত্তি।

প্রথম বাধাটা এল প্রীতির কাছ থেকেই। মিরাজ তাঁর ভালো লাগার কথা জানাতেই এক কথায় ‘না’ করে দিলেন। ‘ও তখন খুলনার বঙ্গবাসী স্কুলে পড়ে। স্কুল ছুটি থেকে একদিন ফিরছে । ফেরার পথেই আমার ভালো লাগার কথা ওকে বললাম। দুজনই তখন প্রেম-ভালোবাসা এসব ব্যাপারে তেমন কিছু বুঝি না। আমি শুধু বুঝি ওকে ভালো লাগে। শুনে সোজাসাপ্টা বলে দিল, সে কোনো সম্পর্কে জড়াবে না। বাসায় জানলে ওর নাকি খবর আছে! মা মারধর করবে! আমি ওকে সাহস দিয়ে আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে এলাম। বললাম, যদি আমাকে ভালো লাগে তবে এই নম্বরে মিসডকল দিয়ো। যদি ভালো না লাগে দেওয়ার দরকার নেই’, মিরাজ একটু বিরতি নেন।

তারপর? মিসডকল কি দিয়েছিলেন প্রীতি? এসব গল্প শুনতে হয় ধীরে ধীরে, এমন অভিব্যক্তিতে মিরাজ ফিরে যান তাঁর প্রেমের দিনগুলোয়, ‘পরদিন খুলনায় আমার খেলা ছিল। খেলা শেষে দেখি অপরিচিত একটা নম্বর থেকে মিসডকল এসেছে। নম্বরটা দেখেই কেমন খটকা লাগল। কল ব্যাক করতেই হ্যালো বলেই কেটে দিল! পরে কিছুদিন কোনো খবর নেই। টেনশনে পড়ে গেলাম। এক হ্যালো বলেই কোথায় হারিয়ে গেল? তবে কি...একদিন আবার হঠাৎ মিসডকল! আমি যখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি ওকে নিয়ে, তখন সে বলে, না এ সম্পর্ক হবে না। মা-বাবা জানলে খবর আছে! এভাবেই কাটল ২০১৪ সাল।’

২০১৪ গেল, ২০১৫ সালও চলে গেল। মিরাজ মাঝেমধ্যে জানতে চান, ‘প্রীতি, কিছুই তো বললে না!’ প্রীতি অস্ফুট স্বরে বলেন, ‘দেখা যাক...।’ খুব একটা নিয়মিত কথা হতো না দুজনের। কথা বলার সুযোগও ছিল না খুব একটা। প্রীতির নিজের কোনো ফোন ছিল না। মায়ের ফোন থেকে লুকিয়ে মিরাজকে মিসডকল দিতেন। এই একটা মিসডকলের আশায় মিরাজের দিন কাটত, রাত কাটত, সপ্তাহ কাটত। কখনো বা মাস। আগ বাড়িয়ে মিরাজের ফোন দেওয়া ছিল নিষিদ্ধ। পাছে মা ধরে ফেলে ফোন!

ছোট্ট একটা মিসডকল তাঁর কাছে হয়ে আসত মুগ্ধ করা পিয়ানোর সুর হয়ে। মনে তুলত আনন্দের অদ্ভুত অনুরণন। প্রীতির মনটা গলতে লেগে গেল পাক্কা দুই বছর। মনের ভেতর মিরাজকে নিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি হলো অন্য রকম অনুভূতি। তিনি অনুভব করলেন, মিরাজকে ঠাঁই দেওয়া যেতে পারে হৃদয়-নাওয়ে। কিন্তু সেটি কি এতই সহজ?

বিষয়টা জানতে পারলেন প্রীতির মা। মিরাজের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক তিনি তো কিছুতেই মানবেন না। মায়ের কাছে মার পর্যন্ত খেতে হয়েছে প্রীতিকে। পরিবার থেকে ভীষণ চাপ এসেছে। তবুও প্রীতি অটল, মিরাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন না। মিরাজের মা–বাবাও অবশ্য কিছু জানতেন না এ সম্পর্কের ব্যাপারে।

দেশের মাঠে হওয়া ২০১৬ যুব বিশ্বকাপ দিয়ে মিরাজ চলে এলেন প্রচারের আলোয়। একই বছরের অক্টোবরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে আলোড়ন তুলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। প্রীতির পরিবারের ভাবনা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করল। মিরাজের গায়ে ধীরে ধীরে লাগতে শুরু করল তারকা তকমা, প্রীতির পরিবার তত দিনে রাজি এ সম্পর্ক মেনে নিতে। তখনই দুজনের সম্পর্কে আরেক মোড়। মিরাজের মা-বাবা যখন শুনলেন এ সম্পর্কের কথা, তাঁরা কিছুতেই মানবেন না। শুরু হলো মিরাজের আরেক লড়াই।

এবারের লড়াইটা তাঁর মা-বাবাকে রাজি করানো। মিরাজ শোনালেন সে লড়াইয়ের কথা, ‘মা-বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ যখন তাঁদের বলেছে, মিরাজ এখন জাতীয় দলে খেলে, এ মেয়ের সঙ্গেই কেন বিয়ে দিতে হবে? এতে মা-বাবা আরও বেঁকে বসে। মা-বাবাকে অনেক বুঝিয়ে বলেছি, যখন আমাকে কেউ চিনত না, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, তখন থেকেই ওর সঙ্গে সম্পর্ক। ও চাইলে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারত। প্রচণ্ড চাপেও সেটা সে করেনি। সে আমাকে সাধারণ মানুষ হিসেবেই পছন্দ করেছে। ক্রিকেটার মিরাজ হিসেবে নয়।’

মিরাজের প্রায় দুই বছর লেগেছে মা-বাবাকে বোঝাতে। মা-বাবাকে বোঝানোর এ পর্বটাও তাঁর কাছে কম কঠিন ছিল না, ‘মা-বাবাকে বারবার বলেছি, যদি ওকে বিয়ে না করি, এটা প্রতারণা করা হয়। একটা মানুষকে ঠকানো হয়। একজনকে ঠকিয়ে আমি জীবনে ভালো কিছু করতে পারব না। একটা অভিশাপ লেগে থাকবে। ক্রিকেটে আমার যা প্রাপ্তি, সেই অভিশাপে এসব তো হারিয়েও ফেলতে পারি। এটা করলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। সবচেয়ে বড় কথা, আমি ওকে ভালোবাসি। অবশেষে মা-বাবা মেনে নিয়েছেন তিন মাস আগে।’

মিয়া-বিবি রাজি, দুই পরিবার রাজি—তবে কেন দেরি? মিরাজ তবুও দেরি করতে চাইছিলেন। কিন্তু দুই পরিবার মনে করেছে, মিরাজ যেহেতু জাতীয় দলের ক্রিকেটার, একটা মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে অনেক নেতিবাচক কথা ছড়াতে পারে। এর মধ্যে আবার বিয়ে হয়ে গেছে মিরাজের বোন রুমানার। বাড়িটা কেমন শূন্য শূন্য লাগে। এ শূন্যতা পূরণে নিউজিল্যান্ডে থাকতে মিরাজ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন। ক্যারিয়ারের নানা বাঁক পেরিয়ে বাংলাদেশ দলে যেমন জায়গাটা পোক্ত করেছেন, ব্যক্তিজীবনেও নানা বাধা পেরিয়ে অবশেষে প্রীতিকে পেয়ে মিরাজ ভীষণ প্রীত হয়েছেন।

তাঁদের ঘর সুখের আলোয় ভরে যাক, এখন এটাই তাঁর ভক্তদের প্রার্থনা।


সিলেটভিউ ২৪ডটকম/২৬ মার্চ ২০১৯/গআচ

সৌজন্যে: প্রথম আলো

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.