আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সিলেটে বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপন হবে ‘শীতলপাটির’ ইউনেস্কোর স্বীকৃতি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১২-০৮ ০০:০৯:৫৩

নিজস্ব প্রতিবেদক :: সাতকরা, কমলা, চা এসবের পাশাপাশি সিলেটকে চিনিয়ে দিতে ‘শীতলপাটি’-র সুনাম বেশ পুরনো। সিলেটকে বিশ্ব পরিমন্ডলে আলাদা পরিচয় এনে দিয়েছে সিলেটের এই ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পটি। বুধবার সিলেটের শীতলপাটি আরেকদফা বিশ্বমাত করলো। ইউনেস্কোর বিশ্ব নির্বস্তুক সংস্কৃতি ঐতিহ্যের (ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি) তালিকায় স্থান করে নিলো ‘শীতলপাটি’।

দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে বিশ্বের নির্বস্তুক ঐতিহ্য সংরক্ষণার্থে গঠিত আন্তর্জাতিক পর্ষদের সম্মেলনের শেষ পর্বে ‘শীতলপাটি’-র নাম উঠে আসে। এই অর্জনে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে মৃতপ্রায় এই কারুশিল্পে। হয়তো এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পিঠে ভর করে আবারোও নতুন করে জেগে উঠতে পারে ‘শীতলপাটি’ বুনন শিল্প।

আন্তর্জাতিক অর্জনে সিলেটবাসী আনন্দে উদ্বেলিত। সিলেটের জেলা প্রশাসন এই স্বীকৃতি অর্জনকে বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে দিনক্ষণ জানানো হবে।

‘শীতলপাটি’ ইউনেস্কোর স্বীকৃতির এর আগেও বাংলাদেশের বাউল সঙ্গীত, জামদানি বোনা ও মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর এ তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। অতিসাম্প্রতিক সময়ে ৩০ অক্টোবর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।

এর আগে ইউনেস্কোর তালিকায় শীতল পাটিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৩ সালে। ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি মনিটরিং কমিটির ৯ম সভায় শীতলপাটিকে তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বছরের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাদুঘর শীতলপাটির ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।

২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শীতলপাটি বুনন প্রক্রিয়া ইউনেস্কোর কাছে পাঠানো হয়। ২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর শীতল পাটিকে ঐতিহ্যে হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়।

জাতীয় জাদুঘরের সচিব মোহাম্মদ শওকত নবীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। প্রতিনিধি দলে রয়েছেন সিলেট অঞ্চলের দুই বিখ্যাত পাটিকর গীতেশচন্দ্র ও হরেন্দ্রকুমার দাশ। সম্মেলন স্থলে এই দুই পাটিকর তাদের বুননশৈলী উপস্থাপনা করছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া উন্নতমানের শীতল পাটি প্রদর্শন করা হচ্ছে সেখানে। সিলেটের সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্যের অংশ শীতলপাটি।

নানা রঙ আর নকশার শীতলপাটির ব্যবহার এ কসময় ছিল ব্যাপক। গরমকালে বিছানার উপরে এই পাটি বিছিয়ে ঘুমালে মিলে শীতল পরশ। যে কারণে এই পাটির নামকরণ হয় শীতলপাটি। শোয়ার সময় বিছানার উপর বা খাবারের সময় মাদুর হিসেবেই নয়, একসময় বিয়েশাদীতেও উপহার হিসেবে দেয়া হতো এই শীতলপাটি। শীতলপাটির এই স্বীকৃতিতে খুশি সিলেটে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কারিগর বা পাটিকররা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শীতলপাটি তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে উন্নতমানের শীতলপাটি তৈরি হয়ে থাকে সিলেটের বালাগঞ্জে। মৌলভীবাজারের রাজনগর, কুলাউড়া, বড়লেখা ও জুড়িতেও তৈরি করা হয় বিশেষ এ পাটি বা মাদুর। এসব এলাকার পাটির কারিগর বা পাটিকররা বংশপরস্পরায় শীতলপাটির কাজ করে আসছেন। বর্তমানে অন্তত ৫ হাজার শ্রমিক এই পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।

শীতলপাটির কারিগরদের বেশিরভাগই নারী। এসব নারী শ্রমিক সারাবছরই নানা ধরণের পাটি তৈরি করে থাকেন। একসময় কারিগররা পাটিতে নানারকমের লোককাহিনীর চিত্রও ফুটিয়ে তুলতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে পাটির বাজার সংকুচিত হয়ে আসায় এবং ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় আগের মতো শৈল্পিক কারুকাজের শীতলপাটি খুব কমই দেখা যায়।
 
শীতলপাটির কারিগররা জানিয়েছেন, মুর্ত্তা নামক এক ধরণের বেত গাছই হচ্ছে শীতলপাটি তৈরির প্রধান উপকরণ। একসময় সিলেটের গ্রামাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ মুর্ত্তাবাগান ছিল। কাঁচামাল হিসেবে মুর্ত্তাবেতের যোগান ছিল প্রচুর। কিন্তু এখন মুর্ত্তাবাগানগুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে মুর্ত্তাবেতের দুষ্প্রাপ্যতা ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে এখন পাটি তৈরির খরচ বেশি পড়ে। কিন্তু বাজারে চাহিদা কম থাকায় তারা উপযুক্ত মূল্যও পাচ্ছেন না। ফলে দিনদিন তারা শীতলপাটি তৈরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। পাটিকররা জানান, বংশপরম্পরায় তারা শীতলপাটি তৈরি করে আসছেন। কিন্তু শীতলপাটির বাজার সংকুচিত হয়ে আসায় এখন অনেকেই পেশা বদল করে নিচ্ছেন।

লালদিঘীরপাড়ের শীতলপাটি বিক্রেতা নবারুন দাস জানান, একসময় গ্রামাঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণ শীতলপাটি আসতো, দামও ছিল কম। কিন্তু এখন মুর্ত্তাবেতের সংকটের কারণে শীতলপাটি তৈরির পরিমাণ কমে গেছে। এছাড়া বাজারে প্লাস্টিকের মাদুর সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি দাম দিয়ে শীতলপাটি কিনতে চান না। ফলে দিনদিন এর ক্রেতা কমে যাচ্ছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার সিলেটভিউ২৪ডটকমকে বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে শীতলপাটির স্বীকৃতিলাভ সিলেটবাসীর জন্য গৌরবের। ধ্বংসের হাত থেকে যাতে শীতলপাটিকে রক্ষা করা যায় এজন্য সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে মুর্ত্তাবেত বাগান সৃজন করা হচ্ছে। আগামীতে বনবিভাগের মাধ্যমে এই বাগান সৃজনের পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। পাশাপাশি শীতলপাটির এই অর্জনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে উদযাপন করবে সিলেট জেলা প্রশাসন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭/ এমইউএ

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন