আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বছরের সেরা অর্জন: শীতলপাটির বিশ্বজয়

ফিরে দেখা-০৪

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১২-২৭ ০০:০৭:১৪

মিসবাহ উদ্দীন আহমদ :: সিলেটকে যখন পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে তখন অবধারিতভাবেই চলে আসে ঐতিহ্যের স্মারক ‘শীতলপাটি’। এই শীতলপাটি বিশ্বজোড়া পৌঁছে দিয়েছে পূণ্যভূমি সিলেটকে। ২০১৭ সালে শীতলপাটি নতুন করে আবারো বিশ্বজয় করলো। ইউনেস্কোর বিশ্ব নির্বস্তুক সংস্কৃতি ঐতিহ্যের (ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি) তালিকায় উঠেছে ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প ‘শীতলপাটি’। বিশ্বব্যাপী এমন অর্জন ২০১৭ সালের সিলেটবাসীর জন্য ছিলো অন্যতম প্রাপ্তি। যে বিষয়টি দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সাথে তোলে ধরেছে।

সিলেট জেলা প্রশাসন ‘শীতলপাটির’ এমন স্বীকৃতিকে বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপন করার কথা রয়েছে। তবে সেটি এখনো হয়নি। ‘শীতলপাটির’ জন্মস্থান বালাগঞ্জসহ অন্যান্য উপজেলাতে এ অর্জনকে পালন করা হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সিলেট মহানগরীতেও বিভিন্ন সংগঠন এমন অর্জনকে স্বাগত জানিয়ে আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রা করেছে।

এর আগে গত ৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে বিশ্বের নির্বস্তুক ঐতিহ্য সংরক্ষণার্থে গঠিত আন্তর্জাতিক পর্ষদের সম্মেলনে শেষ পর্বে সিলেটের ‘শীতলপাটি’র নাম উঠে আসে। এমন সংবাদে সিলেটবাসী খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। নিজ জেলার একটি ‘ব্রান্ড’ বিশ্ব দরবারে অর্জন করে নিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। সেটি চাট্টি খানি কথা নয়।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমকে এ সুখবরটি জানায় স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর। বিশ্ব নির্বস্তুক তালিকাতে বাংলাদেশের অর্জন এটিই নতুন নয় এর আগে বাংলাদেশের বাউল সঙ্গীত, জামদানি বোনা ও মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর এ তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অতি সম্প্রতি গত ৩০ অক্টোবর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। মাস পেরুতে না পেরুতেই এবার সিলেটের ‘শীতলপাটি’ আবারো স্থান করে নিলো ইউনেস্কো স্বীকৃতির তালিকাতে। এ অর্জনে পুরো দেশের মানুষের সাথে সিলেটবাসী আনন্দিত।

এর আগে ইউনেস্কো’র গুরুত্ববহ এ তালিকায় শীতলপাটিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় চারবছর আগে ২০১৩ সালে। ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি মনিটরিং কমিটির ৯ম সভায় শীতলপাটিকে তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বছরের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাদুঘর শীতলপাটির ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।

২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শীতলপাটি বুনন প্রক্রিয়া ইউনেস্কোর কাছে পাঠানো হয়। ২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর শীতল পাটিকে ঐতিহ্যে হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়।

জাতীয় জাদুঘরের সচিব মোহাম্মদ শওকত নবীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন সিলেট অঞ্চলের দুই বিখ্যাত পাটিকর গীতেশচন্দ্র ও হরেন্দ্রকুমার দাশ। সম্মেলন স্থলে এই দুই পাটিকর তাদের বুননশৈলী উপস্থাপনা করেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া উন্নতমানের শীতল পাটি প্রদর্শন করা হয় সেখানে।

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির অতীত গৌরব ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। অস্তিত্বসংকটে ভুঁগছিলো দেশের গৌরবের এ কারুশিল্পটি। মৃতপ্রায় অবস্থার মধ্যে এমন বৈশ্বিক অর্জন আবার আশার সঞ্চার করেছে। এবার হয়তো  দেশে-বিদেশে খ্যাত শীতলপাটি খাদের কিনারা থেকে ফিরে আসবে। তবে এজন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পৃষ্টপোষকতা, বেত চাষ করা, প্রয়োজনীয় পুঁজি বিনোয়োগ, প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি, শিল্পে নিয়োজিত কারিগরদের উৎসাহ প্রদান।

শীতলপাটি সিলেটকে সারা পৃথিবীতে পরিচিত করে তুলেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯০ সালে রোমে অনুষ্ঠিত হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে সিলেট বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে রাজনগরের শীতলপাটি শিল্পী মনিন্দ্র নাথকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। তারও আগে ১৯৮২ সালে একই এলাকার প্রবঞ্জয় দাস বিসিক- জি আই বিস্ট ক্রাফটম্যান ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।

দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, ‘শ্রীহট্টের ‘পাটিয়ারা দাস’ নামক একশ্রেণীর লোক বেতের পাটি প্রস্তুত করিয়া থাকে। ইহা উৎকৃষ্ট নৈপুণ্যের পরিচায়ক। জলসুখা, জগন্নাথপুর, জাফরগড়, প্রতাপগড়, চাপঘাট প্রভৃতি স্থানে ঐ শিল্প বিশেষ শ্রীসম্পন্ন ছিল। এক একখানি পাটির মূল্য ২০০ টাকা পর্যন্ত হইত। ধুলিজুরার (ইটার অন্তর্গত) শিল্পী যদুরাম দাস ১৯০৬ খৃস্টাব্দে কলিকাতায় কৃষি প্রদর্শনীতে ৯০ টাকা মূল্যের একখানি পাটি দেখাইয়া স্বর্ণপদক পাইয়াছিলেন।’

শীতলপাটির দক্ষ শিল্পী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, মূর্তা নামের এক রকমের বেত দিয়ে তৈরি হয় সিলেটের এ ঐতিহ্যবাহী পাটি । সিলেটের বন জঙ্গল ভরা জলাভূমিতেই আগাছা হিসেবে মূর্তা জন্মায়। কোন  কোন এলাকায় মূর্তাগাছের চাষও করা হয়। মূর্তা সিলেটের বালাগঞ্জ ও রাজনগরে প্রচুর জন্মে। এটি সাধারণত আট থেকে দশ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। মূর্তা গাছের ছাল তুলে তা দিয়ে বানানো হয় শীতল পাটি। পার্টির আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য খুবই চমৎকার এবং মসৃণ। শীতলপাটিতে বিভিন্ন ধরনের নকশা দেখতে পাওয়া যায়। মূর্তা গাছের বেতে রঙ লাগিয়ে এ নকশা তৈরি করা হয়। শিল্পী তার ইচ্ছামতো নকশা করেন। তাজমহল, মক্কাশরীফ, হাতি, ফুল, পাখি বিভিন্ন জিনিসের চিত্র আঁকা হয়।

সিলেটের বালাগঞ্জ, রাজনগর, বড়লেখা, দাসের বাজার, ফেঞ্চুগঞ্জের দিনপুর হচ্ছে শীতলপাটি শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা এলাকার দাসের বাজার শীতল পাটি বেচাকেনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার।

প্রতিদিনের জীবন যাপনের সঙ্গে শীতলপাটির ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখের দাবি রাখেই। গরমের দিনে শীতলপাটি যেমন বিছানার উপর ব্যবহৃত হয়, তেমনি অতিথিদের আসন হিসাবেও এটির কদর রয়েছে। ইদানীংকালে বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে সাজসজ্জার কাজেও এটার ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ‘গায়ে হলুদ’ অনুষ্ঠানে বর-কনের বসার জন্যও শীতলপাটি ব্যবহৃত হয়। সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কনের বাড়ি থেকে প্রদত্ত বিবাহ উপহারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে শীতলপাটি।

এ স্বীকৃতির ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার সিলেটভিউ২৪ডটকমকে বলেন, ‘শীতলপাটির এ অর্জনের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় এ শিল্পটি আবার পুনর্জীবন পেলো। ইউনেস্কোর এমন স্বীকৃতি নি:সন্দেহেই সিলেটসহ গোটা দেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। সিলেট জেলা প্রশাসনের ইচ্ছে রয়েছে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ স্বীকৃতি উদযাপনের।

বালাগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ ও সিনিয়র সাংবাদিক লিয়াকত শাহ্ ফরিদী সিলেটভিউ২৪ডটকমকে বলেন, ‘শীতলপাটির এমন বিশ্ব স্বীকৃতি বালাগঞ্জের তথা পুরো সিলেটের মানুষের জন্য অত্যন্ত আনন্দের এবং গৌরবের। এ শিল্পটি ঠিকিয়ে রাখার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৭ ডিসেম্বর ২০১৭/এমইউএ

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন