Sylhet View 24 PRINT

সিলেটের জয়িতা-০২: কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ই রিপার সাফল্যের চাবিকাঠি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০১-০২ ১২:১৩:২৩

মো. এনামুল কবীর :: সংসারে অভাব অনটন লেগেই ছিলো। কঠিন পরিস্থিতে গোটা পরিবারের অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এক কিশোরী। তার নাম রিপা বেগম।

এবার সিলেট জেলায় ‘শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী’ হিসাবে সরকারের জয়িতা পুরস্কার অর্জন করেছেন।

রিপার জন্ম এবং বেড়ে উঠা সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায়। দেওকলস ইউনিয়নের জগতপুর গ্রামের কবির মিয়ার ৫ মেয়ে ও ৩ ছেলের মধ্যে তিনি মেজো। তবে ব্যবসা ও কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন থেকে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার অধিবাসী।

সম্প্রতি এক দুপুরে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে মেলে দিলেন তার সাফল্য অর্জনের গল্পের ঝুলি।

রিপা এসএসসি পাশ করেছিলেন ২০০০ সালে। অর্থাভাবে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অদম্য রিপা শুরু করলেন হাঁস-মুরগী পালন। এই করে চলতে থাকলো লেখা-পড়া। কিন্তু তাও কঠিন দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছিল।

এ অবস্থায় বোনের দেয়া গহনা বিক্রি করে রিপা চলে এলেন এই সিলেট শহরে। প্রথমে এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠলেন। পরে নিজেই বাসা ভাড়া নিলেন। ভর্তি হলেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সেলাই প্রশিক্ষণ কোর্সে। কোর্স শেষ করে নিজেই কাজ শুরু করলেন। সেলাই থেকে  আয় করে করেই চলতে থাকলো নিজের এবং ভাই বোনদের লেখা পড়ার খরচ।

২০০৩ সালে এইচএসসি পাশ করলেন। বিএ পড়ার পাশাপাশি ২০০৫ সালে বিশ্বনাথে নিজের এলাকায় প্রথম নারী উদ্যোক্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘রূপসী বাংলা লেডিস টেইলার্স এন্ড বুটিকস’। অন্য ভাই-বোনেরাও তার মতো কাজ শিখে ফেললেন। তারা যথেষ্ট সহযোগীতা করতে শুরু করলেন।

২০০৮ সালে রিপা বিএ পাশ করলেন। ইতিমধ্যে কম্পিউটারের কিছু কাজও শিখে ফেলেছেন। ২০০৮ সালেই তিনি দক্ষিণ সুরমার লাউয়াই ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় কম্পিউটার শিক্ষক হিসাবে যোগদান করলেন। ২০১০ সালে বিএড শেষ করলেন। এর পর বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স।

এখানেই শেষ নয় এই জয়িতার অধ্যাবসায়। বাবার স্বপ্ন ছিলো মেয়ে উকিল-ব্যারিষ্টার হবে। তো রিপা এক সময় এলএলবিও পাশ করলেন। বর্তমানে সিলেট জজ কোর্টের ৫নং বারে প্র্যাকটিস করছেন। ২০১১ সালে কিছু দিন নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফন্ট ডেস্ক অফিসার হিসাবেও কাজে করেছেন। বর্তমানে বারে প্র্যাকটিস আর নিজের ব্যবসা সামলানোর পাশাপাশি বেশ কিছু সামাজিক কাজকর্ম নিয়েই তার ব্যস্ততা।

নিজের পাশাপাশি রিপা ভাই-বোন এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যাপারেও খুব যত্নশীল। তার একটি ভাই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। তিনি এই অসহায় ভাইটিকেও জনশক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। তার নাম রাসেল মিয়া। তাকে তিনি গবাদী পশু পালনের উপর যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ করালেন, নিজেও প্রশিক্ষণ নিলেন। এরপর গ্রামের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘রাসেল ফার্ম’। বর্তমানে সেই ফার্মে  ১২টি গরু ও ২ হাজার সোনলী মোরগ আছে। রাসেলের পাশাপাশি তিনি নিজেই এই ফার্মের সার্বিক দেখাশুনা করছেন। ৫ জন শ্রমিকের কর্ম সংস্থানও হয়েছে সেখানে।

২০১৪ সালে রিপা দক্ষিণ সুরমার চন্ডিরপুল এলাকায় রূপসী বাংলা লেডিস টেইলার্স এন্ড বুটিকস-০২ ও ০৩ প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেও জানালেন। তার ভাই ও বোনেরা সবাই শিক্ষিত এবং কারিগরি প্রশিক্ষন প্রাপ্ত। তারা সবাই বেশ ভালো আয় রোজগার করছেন।

আমরা যারা চাকুরি নামক সোনার হরিণের পিছনে উন্মাদের মতো ছুটছিতো ছুটছি, তাদের জন্য আদর্শ উদাহরণ হতে পারেন জয়িতা রিপা। বললেন,‘চাকুরি বাকরির চেয়ে ব্যবসাই ভালো। চেষ্টা করলে শিক্ষকতা বা অন্য যেকোন একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়া আমার জন্য তেমন কঠিন কিছু ছিলোনা। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভাইবোনগুলোকে কাজে লাগানো যেতোনা। ওরাও সেই সোনার হরিণ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। বরং এইতো ভালো। ওদের পাশাপাশি আরও ২০/২২ জন চরম দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারলাম। মাদ্রাসা ও নর্থইস্ট মেডিকেলের চাকুরিটা আমি তাই ছেড়েই দিয়েছি।’

রিপার এক ভাই বর্তমানে অনার্স ও একটি বোন মাস্টার্স পড়ছে। ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান সামলাতে তারা সহযোগীতা করেন। আর তিনি বারে প্র্যাকটিসের পাশাপাশি কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসাবে একটি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করছেন। কাজ করছেন যুব উন্নয়নের প্রোগ্রামেও স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে। ব্র্যাকের ‘স্টার গ্রোগ্রামে’ ঝরে পড়া কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষাদানের সাথেও তিনি জড়িত।

নিজের এক ভাই শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী হওয়ায় রিপা এমন পরিবারের কষ্ট ও যন্ত্রণা উপলব্দি করতে পারেন ভালো মতোই। আর তাই তার প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের কাজ করতে তিনি উৎসাহ প্রদান করেন। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩ জন প্রতিবন্ধী কাজ করছে। তিনি প্রতিবন্ধীদের জনশক্তিতে রূপান্তর করতে তাদের পরিবারগুলোকেও উৎসাহ দেন, উজ্জীবিত করেন।

ব্যবসায়ী হিসাবে নারীদের প্রতিষ্ঠালাভে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলোও রিপা চিহ্নিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সামাজিক-পারিবারিক অসহযোগিতাই প্রধান অন্তরায়। নানাজন নানা নেতিবাচক কথাবার্তা রটিয়ে দেয়। মেয়েরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। আমার দোকানেইতো শুরুর দিকে একবার একদল দুর্বৃত্ত হামলা করে ভাংচুর করেছিল। কিন্তু আমি মোটেও দমে যাইনি। বরং নতুন উদ্যমে আবার শুরু করি এবং সফল হই।

নারীদের জন্য রিপার পরামর্শ, প্রতিষ্ঠিত হতে হলে লেখা-পড়া খুব জরুরী। ধৈর্য আর পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে নিজের একটি পরিচয় তৈরি করুন। অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে সম্মানজনক একটি অবস্থান সৃষ্টি করুন। একাজে প্রতিটি মেয়েকে পারিবারিক-সামাজিক সহযোগিতা প্রদানও খুব জরুরী।

প্রিয় পাঠক, ০১ জানুয়ারি প্রকাশিত এ প্রতিবেদনের কিছু বিষয়ের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন জয়িতা রিপা বেগম। শিরোনাম নিয়েও কিছুটা ভূল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। তাই বিষয়গুলো বাদ দিয়ে নতুন করে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলো।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২জানুয়ারি২০১৮/এমইকে

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.