আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ইং

মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির আবদুর রহমানের ‘বহুমাত্রিক ড্রোন’

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০১-১১ ০০:২৪:০০

রফিকুল ইসলাম কামাল :: একটি ড্রোন দিয়ে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট কাজই করা হয় বলেই জানি আমরা। কিন্তু একটি ড্রোন দিয়েই একাধিক কাজ করা? এই দারুণ উদ্ভাবনী চিন্তার বাস্তব প্রয়োগ করেছেন আবদুর রহমান। সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান উদ্ভাবন করেছেন ‘বহুমাত্রিক ড্রোন’। পাঁচটি ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে এ ড্রোন।

বহুমাত্রিক ড্রোন: মানুষ ছাড়াই চলে এরকম আকাশযান হচ্ছে ড্রোন। বলা হয়, এটি প্রযুক্তির অন্যতম সেরা আবিষ্কার। ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ করে ড্রোন দিয়ে ছবি তোলা, ভিডিওচিত্র ধারণসহ বিভিন্ন কাজ করা হয়। সাধারণ ড্রোন দিয়ে নির্দিষ্ট একটি কাজ করা যায়। অন্যদিকে, বহুমাত্রিক বা মাল্টিপারপাস ড্রোন দিয়ে একাধিক কাজ করা সম্ভব।

শুরুর গল্প: তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় আবদুর রহমান ছোটবেলায় বিভিন্ন ধরনের খেলনায় মজে থাকতেন। বাবা-মা সবাই যে খেলনা কিনে দিতেন, সেই খেলনার নাটবল্টু সব খুলে দেখতেন তিনি। যন্ত্রপাতির প্রতি নেশাময় ভালোবাসা তখন থেকেই শুরু। সেই ভালোবাসার কারণেই পছন্দের বিষয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েও ভর্তি হন নি! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে বেছে নেন সিলেটের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিকে। এ ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ ছিল। শোনা যাক আবদুর রহমানের মুখেই, ‘বাংলাদেশের প্রথম ড্রোন নির্মাতা সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিল মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। এ ভার্সিটির শিক্ষার্থীরাই দেশে প্রথমবারের মতো আনম্যান্ড সাবমেরিন তৈরী করেন। এসব কারণে এখানে ভর্তি হই। কেননা, আমি নিজেও উদ্ভাবনের স্বপ্নে স্বপ্নাতুর ছিলাম।’

উদ্ভাবনে মত্ত: মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর সহপাঠি জীবন চন্দ্র দাশকে নিয়ে ক্যাম্পাসের সিনিয়র রাজু মিয়ার (যিনি ‘ভ্যাকুয়াম মেশিন’ ও ‘ব্লাই আই’ উদ্ভাবন করেছেন) সাথে একটি প্রজেক্টে কাজ শুরু করেন আবদুর রহমান। সেটা শেষ হওয়ার পর পরিচয় হয় একই ব্যাচের রুমন হোসেইনর সাথে। রুমন তখন ঢাকায় অ্যারোনটিক্যাল কোর্স করে গেছেন। সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিলের দেওয়া কিছু পুরনো মোটর ও যন্ত্রপাতি দিয়ে কোয়াডকপ্টার (চারটি পাখার হেলিকপ্টার) বানিয়ে চমকে দেন আবদুর রহমান ও রুমন। এরপর থেকে নাবিলের মেন্টরশিপে কাজ করতে থাকেন আবদুর রহমানরা। সাথে যোগ দেন সহপাঠি মিথুন ধর ও জাহান আহমেদ। সবাই মিলে গড়ে তুলেন ‘এমইউ ফ্লাইয়ার্স’ নামক টিম। এ টিম বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সাফল্য অর্জন করে।

বহুমাত্রিক ড্রোনে মনোযোগ: সাধারণ ড্রোন নিয়ে কাজ করে সফলতা পেয়ে বহুমাত্রিক ড্রোনের ভাবনা মাথায় আসে আবদুর রহমানের। ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেন প্রচেষ্টা। দীর্ঘদিনের চেষ্টা দেখে সফলতার মুখ। বহুমাত্রিক এমন একটি ড্রোন তৈরী করেন আবদুর রহমান, যেটিকে কৃষি, আবহাওয়া, নিরাপত্তা, জীবনরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়। তৈরীর পর সক্ষমতার পরীক্ষায় ভালোভাবেই উতরে গেছে ড্রোনটি। আবদুর রহমান বলেন, ‘ব্যবহারকারীর চাহিদা অনুযায়ী সামান্য মডিফিকেশন করে বহুমাত্রিক ড্রোন দিয়ে কয়েকটি কাজ করা যায়। এটি তৈরীর পর পরীক্ষায় সফলতা এসেছে। সহজে বহনযোগ্য এ ড্রোন ২০ হাজার টাকার মধ্যে তৈরী করা সম্ভব।’ ড্রোনের জন্য একটি মোবাইল অ্যাপস এবং ইমেজ প্রসেসিংয়ের কাজে আবদুর রহমানকে সহযোগিতা করেন তারই ব্যাচমেট শাফায়াত হোসেন।

বহুমাত্রিক ড্রোনের কাজের ক্ষেত্র: কৃষি, আবহাওয়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে কিভাবে কাজ করে বহুমাত্রিক ড্রোন? আবদুর রহমানের মুখে শোনা বিষয়গুলো দেখা যাক একে একে-
*আবহাওয়া ক্ষেত্রে: বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। আবহাওয়া ও দুর্যোগ মনিটরিংয়ের জন্য এখানে যতোগুলো আবহাওয়া স্টেশন থাকা দরকার, তা নেই। তারওপর আবহাওয়া স্টেশন স্থাপন অনেক ব্যয়সাপেক্ষ এবং পরবর্তীতে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণেও খরচ প্রচুর। এছাড়া দুর্গম অঞ্চল কিংবা গভীর সাগরে সৃষ্ট কোনো দুর্যোগ সম্পর্কে এসব স্টেশন তাৎক্ষণিক সঠিক তথ্য দিতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায় বহুমাত্রিক ড্রোনকে। এ ড্রোনের সেন্সরবোর্ডে প্রয়োজনমতো বিভিন্ন তথ্যসংগ্রাহক সেন্সর (তাপমাত্রা, আদ্রতা, বাতাসের বিশুদ্ধতা, অতিবেগুনি রশ্নির তীব্রতা প্রভৃতি পরিমাপক) লাগিয়ে আবহাওয়া ও দুর্যোগের তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। ড্রোনটি দুর্গম অঞ্চলে পাঠিয়ে সেখানকার আবহাওয়ার প্রকৃত তথ্য গ্রাউন্ড স্টেশন ও ওয়েবে সংরক্ষণ করা যাবে। ওয়েবে এই তথ্য সবাই দেখতে পারবে এবং চাইলে তথ্যের উপর গবেষণাও করতে পারবে।

*তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপক: বহুমাত্রিক ড্রোনে গাইগার মুলার কাউন্টার লাগানোর ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজন হলে ড্রোনে এটি লাগিয়ে তেজস্ক্রিয় দূষণযুক্ত এলাকায়, যেখানে মানুষের যাওয়া বিপজ্জনক, সেখানে পাঠানো যাবে ড্রোনকে। তেজস্ক্রিয়তার পরিমাপ সঠিকভাবে দিতে পারে ড্রোনটি।

*নিরাপত্তায়: যে কোনো স্থানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এই ড্রোন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। হেলিকপ্টার দিয়ে যেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ ব্যয়সাপেক্ষ, সেখানে স্বল্পব্যয়ে ড্রোন দিয়ে এটি করা সম্ভব। ড্রোনে লাগানো ক্যামেরার মাধ্যমে যে কোনো স্থানের ভিডিও সরাসরি দেখে নজরদারি করা যায়। ড্রোনে ইনফ্রারেড ক্যামেরার মাধ্যমে বনেজঙ্গলে লুকিয়ে থাকা কাউকেও সনাক্ত করা যাবে। এছাড়া ড্রোনের ড্রপিং মেকানিজম ব্যবহার করে নিরাপত্তাবাহিনী শত্রু এলাকায় টিয়ার গ্যাস বা বোমা ফেলতে পারবে।

*কৃষিক্ষেত্রে: মাল্টিপারপাস ড্রোন কৃষিক্ষেত্রে দারুণভাবে কাজ করতে পারে। একজন কৃষি কর্মকর্তা ক্ষেত বা ফসলের অবস্থা, জমিতে সারের পরিমাপ, চাষাবাদ এলাকার আবহাওয়া এ ড্রোন দিয়ে জানতে পারবেন। কোনো ধানক্ষেত্রের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ফসলের ছবি তুলে ইমেজ প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে জমিতে কতোটুকু সার প্রদান করা প্রয়োজন, তা জানাতে সক্ষম ড্রোনটি। এমনকি এ ড্রোন দিয়ে জমিতে সার ও কীটনাশকও স্প্রে করা সম্ভব।

*জীবন রক্ষায়: বহুতল কোনো ভবনে অগ্নিকা- ঘটলে বহুমাত্রিক ড্রোন ব্যবহার করে বিভিন্ন তলায় থাকা মানুষ সনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। অগ্নিকা-ের শিকার ভবনের যে স্থানে হোসপাইপ পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেখানে ড্রোনের মাধ্যমে অগ্নিনির্বাপক ব্যবহার করা সম্ভব। অগ্নিকা-, বন্যা, ভূমিকম্প বা যে কোনো ধরনের দুর্যোগের পর আক্রান্ত এলাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে এ ড্রোন কাজে লাগানো যাবে। এমনকি নৌদুর্ঘটনার পর এ ড্রোনের মাধ্যমে লাইফ সেভিং জ্যাকেট পাঠানো সম্ভব।

উন্নত হবে আরো: বহুমাত্রিক ড্রোনকে আরো অত্যাধুনিক করার চিন্তা রয়েছে আবদুর রহমানের। তার মতে, আগামীতে বহুমাত্রিক ড্রোনের কন্ট্রোল রেঞ্জ বৃদ্ধি এবং ডিজাইন আরো আপডেট করে এমনভাবে এটিকে তৈরী করা হবে, যেন প্রয়োজনমতো এটিকে বিমান বা হেলিকপ্টারের মতো ব্যবহার করা যায়। এছাড়া ড্রোনে সৌরশক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনাও রয়েছে।

আছে ব্যক্তিগত সফলতাও: বহুমাত্রিক ড্রোন দিয়ে ব্যক্তিগত কৃতিত্বের পুরস্কার পেয়েছেন আবদুর রহমান। নেপালে অনুষ্ঠিত ‘নেপাল ইয়ান্ত্রা’ এবং ঢাকায় ডুয়েটে অনুষ্ঠিত ‘ডুয়েট টেকফেস্ট ২০১৭’তে এ ড্রোন উপস্থাপন করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন আবদুর রহমান।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১১ জানুয়ারি ২০১৮/আরআই-কে

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন