আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ইং

যেভাবে কাটলো মৌলভীবাজারবাসীর ঈদ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৬-১৯ ০৯:৩০:০৯

খলিলুর রহমান স্টালিন, কুলাউড়া থেকে :: ‘বন্যার পানিতে থৈ থৈ করছে পুরো গ্রাম। দু'-একটি বাড়ি ছাড়া প্রায় সবার ঘর ডুবে গেছে। নেই নৌকা। তাই ঘর থেকে কেউ বেরও হতে পারছে না। তবে কেউ কেউ নৌকা ভাড়া করে নিয়ে এসেছেন স্বজনদের উদ্ধার করতে। কিন্তু স্বজনদের উদ্ধার করলেও আশপাশের লোকজনের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। এমনকি ডাকলেও কাছে আসছে না কেউ। ভয়ঙ্কর এক দিন! এমন পরিস্থিতি জীবনেও মোকাবেলা করতে হয়নি।’ সিলেটভিউ’র এই প্রতিবেদকের কাছে উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের করইয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. ওয়াহিদ মিয়ার ষাটোর্ধ্ব মা।

তিনি বলেন, ঈদের দুই দিন আগ থেকে এলাকায় বন্যার পানি যাওয়া শুরু করেছে। ঈদের আগের দিন (শুক্রবার) গ্রামের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ঘর-বাড়িতে পানি উঠে যায়। গ্রামের ঈদগাহ ও মসজিদও বাদ যায়নি। তাই গ্রামের মানুষ এবার ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেনি।

আশপাশের লোকজন অনেক কষ্টে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এক ঘর পানি প্রবেশ করলে অন্য ঘরে যাচ্ছেন। এক বাড়িতে পানি উঠলে অন্য বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। এমন করতে করতে এখন প্রায় (ঈদের দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত) সব বাড়িই পানিতে ডুবে গেছে।’

জীবনের প্রথম এত পানি দেখেছেন জানিয়ে ষাটোর্ধ্ব ওই নারী বলেন, সকাল থেকেই নৌকার অভাবে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। যারা নৌকা সংগ্রহ করতে গিয়েছিল, তাদেরও খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে। কারণ, সেই এলাকায় নৌকা কিনতেও পাওয়া যাচ্ছে না।

একই পরিস্থিতি হয়েছিল কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর, শরিফপুর ও টিলাগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দাদেরও। ঈদের দু' দিন আগে মনু নদীর ভাঙ্গনের কারণে ওসব এলাকার বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে পড়েন। তাই ঈদের আনন্দ তো দূরের কথা, তারা ঈদের নামাজও পড়তে পারেননি। এমনকি যোগাযোগের অভাবে তীব্র খাদ্যসংকটে পড়েছেন তারা। নৌকার অভাবে সরকারী ত্রাণও তাদের হাতে পৌছানো সম্ভব হচ্ছে না। আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে না পেরে অনেকে উঁচু জায়গায় খোলা আকাশের নিচে পরিবার নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। রোদে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে এভাবেই দিন কাটাচ্ছেন তারা। ঈদের দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হাজীপুর ইউনিয়নের বন্যাকবলিত এলাকাগুলো ঘুরে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে।

ওই দিন সকাল ১১টার দিকে মন্দিরা গ্রামে দেখা গেছে, বাঁধ ভেঙ্গে হরিচক, পালগাও, মন্দিরা, কাউকাপনসহ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৫-৬ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছেন। এই গ্রামগুলোর প্রায় অর্ধশত ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ায় বন্যার্তরা হরিচক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয় পেলেও খাদ্যসংকটে ভুগছেন তারা।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং খাদ্যসামগ্রীর জন্য স্থানীয় কটারকোনা বাজারের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কটারকোনা বাজারের সাথে আশ্রয়কেন্দ্রের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তারা বাজারে গিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছেন না। কেউ কেউ সাঁতার কেটে বাজারে গেলেও খাবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারছেন না। সরকার থেকে ত্রাণসামগ্রী এলেও সেগুলো তাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।

মন্দিরা এলাকার বাসিন্দা সেফুল মিয়া জানান, তিনি তিন দিন থেকে রাস্তায় ছিলেন। সেখানে পোকামকড়ের কামড় খেয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঈদের দিন কটারকোনা বাজারে একটি দোকানে আশ্রয় নিয়েছেন।

নিজের ঘর ও ঘরের মালামাল বন্যার পানিতে ভেসে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজ (ঈদের দিন) তিন দিন পর ভাত খাইলাম। আমার আর কিছু বলার নেই।’

হাজীপুর ইউনিয়নের চাঁনগাও গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে আরো করুণ অবস্থা। গ্রামের অধিকাংশ ঘর ভেঙে গেছে। আর যে ঘরগুলো রয়েছে সেগুলোতেও পানি উঠেছে। সেই পানি পার হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে বা শুকনো জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থাও নেই। তাই এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির গাছের সাথে রশি বেঁধে কলা গাছ দিয়ে ভেলা তৈরী করে একে অপরের বাড়িতে যাচ্ছেন।

ওই গ্রামের বৃদ্ধ নারী জরিবুন বেগম জানান, বন্যার পানিতে তার ঘর ভেঙে গেছে। শুধু তার ঘর নয়, ওই গ্রামের রায়হান মিয়া, আনিছ মিয়া, কুলছুমা বেগমসহ বেশ কয়েকজনের ঘর ভেঙ্গে গেছে। এছাড়াও আরো অনেকের সবকিছু বন্যার পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

জরিবুন নেছা জানান, তাদের গ্রামেও মসজিদ-মাদ্রাসা পানির নিচে থাকায় ঈদের নামাজ পড়তে পারেনি কেউ।

এদিকে মৌলভীবাজারের চারটি উপজেলার ৩০টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম।


স্থানীয় সাংবাদিকদের তিনি জানান, গত কয়েক দিন থেকে মনু ও ধলাই নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের ২৫ স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রায় ৪০,২০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিতে ডুবে নিহত হয়েছে সাতজন। নষ্ট হয়েছে ২,৯৬০ হেক্টর আউশ ধান। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক লাখ ৯৫ হাজার ৯৬ জন মানুষ।

তিনি জানান, বন্যাকবলিত এলাকা থেকে ইতোমধ্যে ৫,০৩৯০ জনকে উদ্ধার করে ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিএনসিসি, স্কাউটসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে খাবার রান্না করে বিতরণ করা হচ্ছে।

পানিবন্দিদের উদ্ধারে ১৮টি স্পিডবোট ব্যবহার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, জেলায় নগদ নয় লাখ ৪০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণের অপেক্ষায় আছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে ৭৪৩ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। মজুদ আছে ৬৬৮ টন চাল। তিন হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। শহরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিজিবি টহল দিচ্ছে।’

অপরদিকে সোমবার মৌলভীবাজারে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে গেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধূরী মায়া। এ সময় শহরের বড়হাট এলাকায় প্রায় ১হাজার বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন তিনি। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে জরুরী বৈঠকও করেছেন মন্ত্রী।

মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমানের পরিচালনায় এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধূরী মায়া বলেন, ‘আমি আশা করি, আপনাদের কষ্ট বেশিদিন থাকবে না। পানি অতিসত্ত্বর নেমে যাবে। তারপরেও আপনাদের যে ঘর নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো মেরামত করে দিব। যেসবের ঘর একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তাদের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে টিন ও টাকা দেয়া হয়েছে। সঠিক ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করা হবে।’

এ সময় মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দা সায়রা মহসীন, মৌলভীবাজার-৪ আসনের সাংসদ আব্দুশ শহীদ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নেছার আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৯ জুন ২০১৮/কেআরএস/ডিজেএস/আআ

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন