Sylhet View 24 PRINT

হবিগঞ্জে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে প্রাণ কোম্পানির বর্জ্য!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৯-১৩ ০০:১১:৪০

কাজল সরকার, হবিগঞ্জ :: প্রাণ কোম্পানির বিষাক্ত বর্জ্যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে হবিগঞ্জে বিস্তীর্ণ এলাকা। বিষাক্ত বর্জ্য পানিতে মিশে এলাকার সব নদী-নালা ও খাল-বিলের পানি নষ্ট হয়ে মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কালো রঙ ধারণ করেছে নদ-নদীর পানি। খালি চোখে দেখে বুঝার উপায় নেই যে এটি কোন নদীর পানি, নাকি তরল জাতীয় পদার্থ। এতে প্রতিনিয়তই অসুস্থ হচ্ছেন আশপাশের গ্রামগুলোর হাজার হাজার বাসিন্দা। শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ থেকে শুরু করে এমন কোনো রোগ নেই যা তাদের আক্রান্ত করছে না।

ওই এলাকার কোন নদ-নদীতেই এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। এমনকি পুকুরেও মাছ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কোন ধরণের সুড়ঙ্গ কিংবা ফাটল দিয়ে বিষাক্ত পানি প্রবেশ করে মরে যাচ্ছে পুকুরের মাছও। শুধু তাই নয়, নদীর বিষাক্ত পানিতে নেমে মরছে হাঁস, মুরগিসহ গবাদি পশু। প্রাণ-আরএফএল কোম্পানির অন্তত ৪৭টিসহ আরও অন্তত শতাধিক প্রতিষ্ঠানে বর্জ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এখানে। আর ওই এলাকার ঐতিহ্যবাহী সুতাং নদীর কথাতো আর বলার মতোই নয়। শিল্প কারখানার সব চেয়ে বেশি নির্মতার শিকার হয়েছে এই নদীটি।

জানা যায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সুতাং নদীর উৎপত্তি। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ওপর দিয়ে বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করেছে নদীটি। পরে শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে লাখাই উপজেলার ওপর দিয়ে মেঘনার শাখা নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। এ নদীর পানি দিয়েই আবাদ হতো চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জ ও লাখাই উপজেলার বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। নদী থেকে মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত কয়েক হাজার জেলে পরিবার। এক সময় নদী দিয়ে বাঁশ আনা-নেয়া হতো। এর ওপর নির্ভর করেই শায়েস্তাগঞ্জের সুতাং বাজারে বাঁশের বিশাল হাট বসে। এখন এর সবই প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে।

হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থেকে শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত পুরো এলাকা শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠে। এসব শিল্প কারখানার অনেকেরই বর্জ্য শোধনাগার নেই। আবার যাদের আছে ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে তারাও ব্যবহার করছেন না। কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অনেকেই বর্জ্য শোধন না করেই ছেড়ে দিচ্ছেন। খাল, নালা দিয়ে এসব বর্জ্য নদীতে ছাড়া হচ্ছে। ফলে নদীর পানি নষ্ট হয়ে কালো আকার ধারণ করেছে। আবার বিভিন্ন খাল ও নালার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছে বিস্তীর্ণ এলাকায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ওলিপুরে প্রায় শতাধিক শিল্প কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পরিবেশ দূষণের দিকে এগিয়ে প্রাণ গ্রæপের একাধিক প্রতিষ্ঠান। তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। এক কথায়, শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে নিজেদের লাভ ব্যথিত কোন ধরণের চিন্তাই নেই কোম্পানিটির।
২০১৪ সালে ওলিপুরে প্রতিষ্ঠিত ‘হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’-এ বিভিন্ন ধরণের পণ্য উৎপাধন শুরু করে প্রাণ গ্রæপ। স্থানীয় কৃষকদের জমিতে সেচ সুবিধার জন্য শৈলজুরা নামক খালটি পুনঃখনন করে জাইকা। পরে ওই খাল দিয়েই প্রাণ গ্রæপের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বর্জ্য ও বিষাক্ত পানি ছাড়তে শুরু করে। এতে প্রতিনিয়তই অসুস্থ হচ্ছেন আশপাশের গ্রামগুলোর হাজার হাজার বাসিন্দা। ওই এলাকার জমিগুলোতে এখন আর আগের মতো ফসল উৎপাদন করতে পারেন না কৃষকরা। দুষিত বর্জ্যরে পানিতে নষ্ট হয়ে যায় ফসলের জমি। আগের মতো সফল উৎপানও করা সম্ভব হয় না। ফসলি জমিতে ধান উৎপাদন করতে গিয়ে চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা অনেকেরই।

এ নিয়ে স্থানীয় লোকজন অনেক অভিযোগও করেছেন প্রাণ-আরএফএল কর্তৃপক্ষের কাছে। এতে কোন সাড়া না পেয়ে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও সংসদ সদস্যের কাছে। এতেও কোন ফল না পেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সরাসরি লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে অনেক বার। স্থানীয় লোকজনের বার বার প্রেরণ করা লিখিত অভিযোগের প্ররিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে আসতে বাধ্য হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধি দল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে প্রাণ-আরএফএল কোম্পানীর বর্জ্য পরিশোধনসহ সার্বিক অবস্থা ঠিক রয়েছে বলে প্রতিবেদন দেন।

কেন বা কি কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দল এমন প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন এর কারণ জানতে অনুসন্ধানে নামে দৈনিক খোলা কাগজ। অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রাণ আরএফএল গ্রæপের প্রতিষ্ঠিত ‘হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’-এর ভেতরে বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি লিটার পানি পরিশোধনের জন্য খরচ হয় ৬০ পয়সা। ফলে ওই কোম্পানীর উৎপাধিত পণ্যের বর্জ্য পরিশোধন করতে হলে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা খরচ হবে। যার কারণে তারা ৪৭টি প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত পানি ও বর্জ্য পরিশোধন না করেই ছেড়ে দিচ্ছেন। সে সাথে সেখানে কর্মরত ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিকদের মল-মূত্রতো রয়েছেই। বিশ^স্ত সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানীর ভেতরের অনেকগুলো টয়লেট ভর্তি হয়ে যাওয়ার কারণে সেগুলোও নালার মাধ্যমে বাহিরে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।

এবার যাওয়া যাক পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকায়। এই পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দল যতবারই এসেছেন তত বারই আসার অন্তত সপ্তাহখানেক আগে নোটিশের মাধ্যমে কোম্পানীর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ফলে ওই এক সপ্তাহ কোম্পানী কর্তৃপক্ষ পানি পরিশোধন করেই মূলত ছেড়েছে। যার ফলে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দল এখানে এসে তেমন কোন সমস্যা দেখতে পাননি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্ধা ফজলুর কমির জানান, নদীর পানির তীব্র দুর্গন্ধের মধ্যেই আমাদের বসবাস করতে হচ্ছে। সকাল, সন্ধ্যা এবং রাতে গন্ধ বেশি হয়। অন্যদিকে পানি না পাওয়ার কারণে জমিতে ফসল উৎপাদন কমে গেছে। কৃষি কাজের জন্য সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দিন দিন মানুষের রোগবালাই বাড়ছে। শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগসহ নানা অসুখবিসুখ দেখা দিচ্ছে। নদীর বিষাক্ত পানিতে নেমে হাঁস, মোরগ, গবাদি পশু মারা যাচ্ছে। এখন শুধু আমাদেও মরার বাঁকি।

করাব ইউনিয়নের ফুলতলি গ্রামের কৃষক মধু মিয়া বলেন- কোম্পানি আসার কারণে আমাদের জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে জমিতে ফসল উৎপাদন কমে গেছে। বাড়ির লোকজন শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগসহ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এলাকার মানুষের শরীর চুলকানি রোগ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে।
রাজিউড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম বাবুল বলেন- ‘২০১৪ সালে এলাকার কৃষিকাজে সেচের জন্য শৈলজুড়া নামক খালটি পুনঃখনন করা হয়। এই খালেই ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন কলকারখানায় দূষিত বর্জ্য। শৈলজুড়া খালটি সুতাং নদীর সঙ্গে সংযুক্ত, তাই সুতাং দূষণের প্রধাণ কারণ এই খালটি।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর হবিগঞ্জ জেলার সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, কয়েক বছর ধরে হবিগঞ্জের সদর ও মাধবপুর উপজেলায় কৃষি জমির ওপর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কলকারখানা। এসব কলকারখানার দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত বর্জ্য আশপাশের খাল ও নদীতে ফেলার ফলে ভয়াবহ দূষণ হচ্ছে। বার বার আন্দোলন করেও কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। দ্রæত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ না দিলে যে কোন ধরণের বড় মহামাড়ি দেখা দিতে পারে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে- হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের জেনারেল ম্যানেজার (আরএফএল অ্যাডমিন) ফজলে রাব্বি বলেন- আমরা সব সময় বর্জ্য পরিশোধন করে বাইরে ছাড়ি। যা অন্যান্য কারখানা করে না। অথচ কিছু স্বার্থান্বেষি লোক স্থানীয় জনগণকে ভুল বুঝিয়ে চলেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দলও যেখানে আমাদের পার্ক পরিদর্শন শেষে সব কিছু ঠিক আছে মর্মে প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানেতো আর কোন প্রশ্ন উঠার কথা না।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবির মুরাদ বলেন- প্রশাসনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমিসহ প্রশাসনের লোকজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ঘুরে এসেছি। কিন্তু এখানে অনেক কোম্পানি রয়েছে। এক কোম্পানি অন্য কোম্পানিকে দোষারোপ করছে। কিন্তু পরিবশে দূষনের ক্ষেত্রে কে বেশি দায়ি সেটা আমারা বুঝতে পারছি না। কারণ আমরাতো পরিবেশের বিশেষজ্ঞ না। তাই পরিবেশ অধিদপ্তরে আমরা বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছি।
তিনি বলেন- পরিবশে অধিদপ্তরের লোকজন কিছু দিনের মধ্যেই হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় পরিদর্শনে আসবেন। তখনই বুঝা যাবে আসলে কে পরিবশে দূষনের জন্য সব চেয়ে বেশি দায়ি।
জেলা প্রশাসক আরো বলেন- পরিবশে অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মর্জিনা আক্তার বলেন- আমি হবিগঞ্জ এসেছি মাত্র ৪ মাস হয়েছে। তাই এখন পর্যন্ত ওই দিকে যাওয়া হয়নি। তবে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ তদন্তের জন্য উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) নাঈমা খন্দকারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন- আমরা শিল্পায়ন চাই, তবে পরিবেশ বান্ধব শিল্পায়ন। পরিবেশ নষ্ট করে শিল্পায়ন কখনও কাম্য নয়। তাই যদি কেউ ওই এলাকায় পরিবেশ দুষন করে তাহলে তাদের ছাড় দেয়া হবে না।

এ ব্যাপারে জেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলীর সাথে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন কল রিসিভ করেননি।

সিলেটভিউ/১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮/কেএস/পিডি

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.