আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সিলেটজুড়ে মরণনেশার আগ্রাসন!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৯-২৬ ০০:০৮:৪০

রফিকুল ইসলাম কামাল :: মরণনেশা ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইনের আগ্রাসন ক্রমেই বাড়ছে সিলেট অঞ্চলে। চট্টগ্রামের কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়া এলাকায় কড়াকড়ির ফলে মাদক কারবারিরা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবার চালান আনতে নতুন রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে সিলেটের জকিগঞ্জকে। সিলেটে গত বছরের চেয়ে এ বছর জব্দ করা হয়েছে প্রায় পাঁচগুণ বেশি ইয়াবা। একইভাবে গাঁজাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য জব্দের পরিমাণও বেড়েছে। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ মাদক ছড়িয়েছে সিলেটজুড়ে। মাদক নামের মরণনেশায় আসক্তদের সংখ্যাও বাড়ছে। মাদক ঠেকাতে সিলেটে র‌্যাব ও বিজিবির তৎপরতা থাকলেও পুলিশের সফলতা এক্ষেত্রে কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের সঠিক প্রয়োগ হলেই মাদকের আগ্রাসন কমে আসবে।

সম্প্রতি মাদকের বিরুদ্ধে সারাদেশে একযোগে বিশেষ অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সে অভিযানে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন দুই শতাধিক ‘মাদক ব্যবসায়ী’। কিন্তু তবু মাদকের আগ্রাসন থামছে না কিছুতেই।

সীমান্ত এলাকা সিলেট। সিলেট বিভাগের সিংহভাগ এলাকাই ভারত সীমান্তঘেঁষা। ফলে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে অহরহ মাদকের চালান ঢুকে বাংলাদেশে। সূত্র মতে, সিলেটের গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদকের চালান আসে। এছাড়া সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়েও আসে মাদকের চালান। কখনো-সখনো বিজিবি বা র‌্যাবের হাতে চালান ধরা পড়লেও বেশিরভাগ সময়ই নিরাপদে চোরাচালান করে মাদক কারবারিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটে গত বছর (২০১৭ সাল) প্রথম আট মাসে যে পরিমাণ মাদক জব্দ করা হয়েছিল, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি থেকে আগস্ট) তারচেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ মাদক জব্দ করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর-সিলেট সূত্রে জানা যায়, গেল বছর অভিযান চালিয়ে প্রথম আট মাসে ২২৫ কেজিরও বেশি গাঁজা, ২২৮৭ পিস ইয়াবা, ৭০২ লিটার চোলাই মদ, ৮ গ্রাম হেরোইন, ১৩৩৫ বোতল বিদেশি মদ, ৬ হাজার লিটার ওয়াশ, ১৭৪৫ লিটার ডিএস, ৯০ লিটার পঁচুই, ১১৩ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করা হয়। অভিযানে একটি পিকআপ ও দুটি সিএনজি অটোরিকশাও জব্দ করা হয়েছিল। ওই সময়ে সিলেটে ৪৩১টি, সুনামগঞ্জে ২৮৪টি, মৌলভীবাজারে ৩৮২টি ও হবিগঞ্জে ২৫৬টি অভিযান চালানো হয়। তখন মামলা হয়েছিল ৪০৮টি, আসামি ছিলেন ৪৫৭ জন।

চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ২৬৭ কেজিরও বেশি গাঁজা, ১৩ হাজার ৯১৭ পিস ইয়াবা, ৭৩৪ লিটার চোলাই মদ, ২৪০০ বোতল বিদেশি মদ, ১৮ হাজার ২৬০ লিটার ওয়াশ, ২ গ্রাম হেরোইন ও ৬০ লিটার ডিএস জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া একটি করে বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, পিকআপ ও সিএনজি অটোরিকশা জব্দ করা হয়। এই সময়ে সিলেটে ৫১০টি, সুনামগঞ্জে ২৩৪টি, মৌলভীবাজারে ৩২২টি ও হবিগঞ্জে ২৮৩টি অভিযান চালানো হয়েছে। এবার অভিযানে মামলা হয়েছে ৪৩২টি, আসামি ৪৭৭ জন।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক জাহিদ হোসেন মোল্লা বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এ বছর মাদকের চালান জব্দের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। আমাদের লোকবলের পরিমাণ কম হওয়া সত্ত্বেও আমরা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করেছি।’

জানা যায়, গত ৩০ জুন পর্যন্ত সিলেট বিভাগের চার জেলায় মাদক আইনে ১১ হাজার ৫৫৩টি মামলা রয়েছে। তন্মধ্যে ১০ হাজার ৯১৩টি মামলার বিচারকার্য চলছে, বাকি ৬৪০টির তদন্ত চলছে।

এদিকে, কিছুদিন আগেও চট্টগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে মিয়ানমার থেকে বানের স্রোতের মতো ইয়াবা ঢুকতো। কিন্তু ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির কারণে মাদক চোরাচালানিরা কৌশল পাল্টে ফেলেছে। বর্তমানে তারা সরাসরি ভারতের ভূখন্ড ব্যবহার করে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদশে ইয়াবা চোরাচালান করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মিয়ানমার থেকে ভারতের মণিপুর-ইম্ফল-শিলচর হয়ে ইয়াবার চালান আসে করিমগঞ্জে। সেখান থেকে রাতের আঁধারে জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা বাংলাদেশে চালান করা হয়। এছাড়া বিজিবির কর্মকর্তাদের ধারণা, বর্তমানে সিলেট সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় ছোট ছোট ইয়াবার কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।

১৯ ব্যাটালিয়ান বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল আবুজার আল জাহিদ জানিয়েছেন, ইয়াবার নতুন রুট জকিগঞ্জ। এ বিষয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের সাথে বিজিবির বৈঠক হয়েছে।

র‌্যাব-৯ এর সিনিয়র সহকারি পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান সিলেটভিউকে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে অভিযানে আমরা বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করেছি। সিলেটে কারা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত, কারা বড় ব্যবসায়ী, কারা ছোট ব্যবসায়ী, এর তালিকা আমরা করেছি। চিহ্নিত এসব মাদক ব্যবসায়ীদের আমরা হাতেনাতে গ্রেফতার করতে কাজ করছি।’

মাদকের আগ্রাসন প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী সিলেটভিউকে বলেন, ‘যে হারে মাদকের আগ্রাসন বাড়ছে, তাতে আমরা শঙ্কিত, হতবাক। মাদকের চোরাচালান বন্ধের মূল দায়িত্ব সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও এখানে দায় আছে। এছাড়া সরকারি দলে ঘাপটি মেরে থাকা যেসব দুর্বৃত্ত আছে, তাদেরও হাত আছে। এই তিন পক্ষ মিলে যদি একমত হয়, তবে মাদক বন্ধ হয়ে যাবে।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮/আরআই-কে

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন