আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং

জকিগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস আজ, স্বীকৃতির দাবীতে নানা কর্মসূচি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১১-২১ ০১:০৬:২৪

জকিগঞ্জ প্রতিনিধি :: আজ ২১ নভেম্বর। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা হানাদার মুক্ত দিবস। জকিগঞ্জের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। একাত্তরের এইদিনে সারাদেশে যখন পাকিস্থানি বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছিল তখন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় ১২ ঘন্টা শ্বাসরুদ্ধকর যুদ্ধে অসংখ্য আহত নিহতদের মধ্যেদিয়ে জকিগঞ্জ থানা সদরসহ আশপাশ এলাকা পাক হানাদার মুক্ত করা হয়। কিন্তু আজও মিলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। জকিগঞ্জ মুক্তাঞ্চল দিবস পালন করতে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। কর্মসূর্চি মধ্যে রয়েছে, শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা, দোয়া, স্বীকৃতি আদায়ে আলোচনা সভা ও র‌্যালি।

একাত্তরের ২১ নভেম্বর নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও পৌরসভার মেয়র খলিল উদ্দিন এবং জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আকরাম আলী বলেন, একাত্তরে বিরাঙ্গনের নেতৃবৃন্দ সিন্ধান্ত নেন ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই জকিগঞ্জকে মুক্ত করতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত মতে একাত্তরের ২৭ মার্চ জকিগঞ্জ ডাক বাংলোয় এক গোপনীয় বৈঠকে থানার সকল ইপিআর ক্যাম্পের পাক সেনাদের খতমের সিদ্ধান্ত হয়। ২৮ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেকাই মিয়া, চুনু মিয়া, আসাইদ আলী, ওয়াতির মিয়া, তজমিল আলী, মশুর আলী, হাবিলদার খুরশিদ, করনিক আবদুল ওয়াহাব, সিগনালম্যান আবদুল মোতালেবসহ কয়েকজন মিলে প্রথমে জকিগঞ্জ ও মানিকপুর ইপিআর ক্যাম্পে অপারেশন চালিয়ে পাক সেনাদের খতম করে জকিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন।

এরপর সাবেক এমপি মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী, এমএলএ আবদুল লতিফ, এমএলএ আব্দুর রহিম, সেক্টর কমান্ডার চিত্ত রঞ্জন দত্ত, মিত্র বাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে, কর্নেল বাগচিসহ কয়েকজন ভারতের মাছিমপুর ক্যান্টলম্যান্টে বসে জকিগঞ্জ এলাকা শত্রু মুক্ত করতে পরিকল্পনা করেন। ঐ পরিকল্পনায় ছিল কিভাবে কুশিয়ারার ওপারে ভারতের করিমগঞ্জের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে জকিগঞ্জ দখল করা যায়। এরপর একাত্তরের ২০ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে প্রথম দল লোহার মহলের দিকে ও দ্বিতীয় দল আমলসীদের দিকে অগ্রসর হয়। মূল দল জকিগঞ্জের কাষ্টমঘাট বরাবর করিমগঞ্জ কাষ্টম ঘাটে অবস্থান নেয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে জকিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়।

আক্রমনের খবর পেয়ে পাক বাহিনী দিকবিধিক ছুটাছুটি শুরু করে বর্বর। মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ভেবে তারা আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে পালাতে থাকে এরই মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় দল ভারত থেকে জকিগঞ্জে পৌছে যায়। মুল দল কুশিয়ারা নদীতে সেতু তৈরী করে জকিগঞ্জ সদরে প্রবেশ করে। তখন জকিগঞ্জ কাস্টমঘাটের নদীরচরে পাক সেনাদের বুলেটে শহীদ হন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর মেজর চমন লাল ও তার দুই সহযোগী। এ সময় মুক্তিকামীরা কয়েকজন পাক সেনাকে আটক করেন। এভাবেই মুক্ত হয় সিলেটের সীমান্ত উপজেলা জকিগঞ্জ।
একুশে নভেম্বর ভোরেই জকিগঞ্জের বুকে প্রথম স্বাধীনভাবে মুক্তিযোদ্ধারা লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে দেন। এরপর পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক আটক বন্দীদের জকিগঞ্জ থানা থেকে মুক্ত করা হয়। পরদিন জেডফোর্সের অধিনায়ক সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমানও জকিগঞ্জে প্রবেশ করেন।

কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, ২০ নভেম্বর রাতের যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের ফলেই জকিগঞ্জ উপজেলাকে দেশের প্রথম শত্রুমুক্ত এলাকা করা সম্ভব হয়েছিলো। এ সাড়াশি অভিযানের কথা আক্রমনের পূর্বে অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও জানতেন না। অনেকটা গোপনীয়তা রক্ষা করে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিলো। এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সাবেক এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী, তৎকালীন এমপি আব্দুল লতিফ, ইসমত চৌধুরী ও আব্দুল মুয়িদ চৌধুরী প্রমূখ।

২৮ নভেম্বর জকিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে মনমুগ্ধকর অনুষ্টানের মাধ্যমে দাউদ হায়দারকে জকিগঞ্জের বেসামরিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। শত্রুমুক্ত এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বীর মুক্তিযোদ্ধা এনাম চৌধুরীকে প্রধান করে ও মুক্তিযোদ্ধা স্পেশাল কামান্ডার মাসুক উদ্দিন আহমদ ও এনামুল মজিদ চৌধুরীকে উপপ্রধান করে এবং জকিগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিল উদ্দিনকে সহকারি কামান্ডার নিয়োগ করে প্রশাসনিক কর্মকান্ড শুরু হয়। সারাদেশের আগে শত্রুমুক্ত এলাকা জকিগঞ্জেই বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক প্রশাসনিক কর্মকান্ড শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জকিগঞ্জ ছিল ৪ নং সেক্টরের অর্ন্তর্ভূক্ত। অধিনায়ক ছিলেন তৎকালীন মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত)। সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপি ছিলেন এই সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা। ৬টি সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত)। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ৩ এপ্রিল মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী ভারতের করিমগঞ্জে গিয়ে সেখানকার ডিসি, এসপিসহ আসাম সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশী শরনার্থীদের থাকা খাওয়া ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবস্থা করেন।

জকিগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পরে প্রথম আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ভারতের বিহার প্রদেশের চাকুলিয়ায় বিশেষ প্রশিক্ষন প্রাপ্ত জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জকে মুক্ত করার পরিকল্পনা অনুসারেই ২১ নভেম্বর ভোরে মুক্ত হয় জকিগঞ্জ। জকিগঞ্জকে মুক্ত করতে ২০ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে জকিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। পাক বাহিনী খবর পেয়ে দিকবিধিক ছুটাছুটি শুরু করে। মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ভেবে তারা আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে পালাতে থাকে। জকিগঞ্জকে মুক্ত করার অভিযানে অংশ নিয়ে কাস্টমঘাটের নদীরচরে পাক সেনাদের বুলেটে শহীদ হন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর মেজর চমন লাল ও তার দুই সহযোগী। মহান মুক্তিযুদ্ধের তুখুড় এই যুদ্ধা জকিগঞ্জকে প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্বীকৃতি দিতে সরকারের প্রতি জোর দাবী জানিয়েছেন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২১ নভেম্বর ২০১৮/আহাতা/ডিজেএস

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন