Sylhet View 24 PRINT

যেখানে বাসর রাতেই নির্ধারিত হয় নববধূর ভাগ্য!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৪-২২ ০০:১৬:৫৪

বিয়ের রাতে বাসর ঘরে পাঠানোর আগে বরকে ভরপেট পান করানো হয় মদ! শিক্ষিত করার নামে দেখানো হয় পর্নোগ্রাফি! অন্যদিকে কনেকে প্রাচীন কায়দায় দিতে হয় কৌমার্যের পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় পাস না করলে পরের দিনই ছাড়তে হয় স্বামীর সংসার! শুধু তাই নয়, ওই নারীর ওপর নেমে আসে নানা গঞ্জনা, নির্যাতন। প্রকাশ্যে করা হয় জুতোপেটা। ভাবছেন কোন আদিম সভ্যতার কথা বলছি? না, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরই কোন কোন সমাজে এখনো চলছে এমন মধ্যযুগীয় রীতি-রেওয়াজ। তেমনই একটি আদিবাসী সমাজ মহারাষ্ট্রের 'কঞ্জরভাট'।

এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, এমন উপায়ে মেয়েদের কুমারীত্ব পরীক্ষা বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বিয়ের রাতে দৈহিক মিলনে কুমারী মেয়েদের রক্তপাত হবেই এমন কথা চিকিৎসাবিজ্ঞান স্বীকার করে না। অনেক মেয়ের একাধিকবার মিলনেও রক্তপাত নাও হতে পারে। প্রথম মিলনে সতিচ্ছেদ ছিন্ন হওয়ার যে বিষয়টি প্রচলিত আছে, সাধারণ দৌড়-ঝাপেও সেটি ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। আবার একাধিকবার মিলনেও তা অক্ষত থাকতে পারে। তাই সতীত্বের পরীক্ষায় রক্তপাতের ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল।

তবে বিজ্ঞান স্বীকার না করলেও এখনো অনেক সমাজে এ রীতি প্রচলিত আছে। আর এর উপরই নির্ভর করে একজন নারীর ভাগ্য। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মহারাষ্ট্রের কঞ্জরভাট নামে আদিবাসীদের সমাজে বিয়ের ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ শেষ হওয়ার পরে নববিবাহিত দম্পতিকে একটা হোটেলের ঘরে পাঠানো হয়, সঙ্গে দেওয়া হয় একটা সাদা চাদর। যদি শারীরিক মিলন শেষে চাদরের মধ্যে নববিবাহিত বধূর রক্তের দাগ থাকে তবেই সমাজ তাদের  বিয়েকে মেনে নেয়।

আর যদি সদ্য বিবাহিতা নারী সেই পরীক্ষায় ফেল করেন, তাহলে তার পরিণাম ভোগার জন্য তাঁকে তৈরি থাকতে হয়। কুমারী না হওয়ার অপরাধে" নববধূকে বেইজ্জত তো করাই হয়, এমনকি পেটানোও হতে পারে। আর স্বামীটি পেয়ে যায় সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করার অধিকার।

কৌমার্যের পরীক্ষায় ফেল করে গিয়েছিলেন অনিতা। [পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে নাম পরিবর্তন করা হল]

তিনি বলেন, "বিয়ের আগেই হবু স্বামীর সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। তাই আমার স্বামীর একটা ভয় ছিল যে আমি হয়তো ভার্জিনিটির পরীক্ষায় পাশ করতে পারব না। ভেবেছিলাম আমার স্বামী পাশে দাঁড়াবে, কিন্তু সেই রাতে যা ঘটল, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না একদমই। "

'পরীক্ষা' দিয়ে বের হলে সকলের সামনে পঞ্চায়েত বসিয়ে স্বামীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, অনিতা 'পবিত্র' না 'অপবিত্র'।

"আমার স্বামী, নির্দ্বিধায় আঙ্গুল তুলে রক্তের দাগহীন সাদা চাদরটা দেখিয়ে দিল। অথচ তার কথাতেই রাজী হয়ে আমি বিয়ের মাস ছয়েক আগে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছিলাম। আর ওই কঠিন সময়ে সে আমাকেই অপবিত্র বলে দিতে একবারও দ্বিধা করল না! পঞ্চায়েত আমাকেই 'ফেক' বলে দিল," বলছিলেন অনিতা।

পুলিশ আর স্থানীয় সামাজিক আন্দোলনের কয়েকজন নেতাকর্মীর মধ্যস্থতায় অনিতার সঙ্গে থাকতে রাজী হয়েছিলেন তার স্বামী।

তবে স্বামীর ঘর করাটা দিনকে দিন অসহনীয় হয়ে উঠেছিল অনিতার কাছে। প্রতিদিনই মারধর করত অনিতার স্বামী। আবার পঞ্চায়েতও বেইজ্জত করত তাঁকে। কোনও ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে দেওয়া হত না।

"আমি গর্ভবতী হওয়ার পরেও অবস্থা পাল্টায়নি। আমার স্বামী আমাকে সবসময়ে জিজ্ঞাসা করত যে পেটের বাচ্চাটার বাবা কে! সে তো জানত কার সন্তান রয়েছে আমার গর্ভে! শুধু স্বামী নয়, পঞ্চায়েতের লোকেরাও ওইসব বলত," জানান অনিতা।

সন্তান প্রসবের দুই মাসের মধ্যে সদ্যোজাত সহ অনিতাকে তাড়িয়ে দেয় তাঁর স্বামী। অনিতা এখন নিজের বাবা-মায়ের কাছে থাকেন।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সোনিয়া নায়েক বলেন, "প্রথমবার শারীরিক সম্পর্কের সময়ে যে নারীর দেহ থেকে রক্ত বের হবেই, এমন কোন কথা নেই। অনেক সময়ে প্রথমবার শারীরিক মিলন হলেও কুমারী মেয়েদের শরীর থেকে রক্ত নাও বেরোতে পারে। এর অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু রক্ত না বেরনো মানেই যে কোনও নারী কুমারী নন, এটা বলা অবৈজ্ঞানিক।

এই প্রথা  বন্ধের উদ্দেশ্যে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন বিবেক। 'স্টপ দা ভি রিচুয়াল' নামে একটা হোয়াটস্ অ্যাপ গ্রুপও হয়েছে, যেটির ৬০ জন সদস্যের অর্ধেকই নারী। 'ভি রিচুয়াল' অর্থ ভার্জিনিটি রিচুয়াল, বা কৌমার্য পরীক্ষা।

আর যাতে কোনও নববধূকে বিয়ের পরেই কৌমার্যের পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে জুতোপেটা না খেতে হয়, তার ব্যবস্থা করতে গিয়ে কয়েক দিন আগে বিবেক আর তাঁর কয়েকজন বন্ধু নিজেরাই মার খেয়ে এসেছেন।

পুণে শহরে একটা বিয়েবাড়িতে বিবেক আর তাঁর কয়েকজন বন্ধু এই কৌমার্য পরীক্ষা বন্ধের স্বপক্ষে প্রচার চালাতে গিয়েছিলেন। সেখানেই কঞ্জরভাট সম্প্রদায়ের মানুষজন মারধর করেন। পুলিশ সেখান থেকে চল্লিশ জনকে গ্রেপ্তারও করে।

মারাঠি যুবক বিবেক তামাইচিকার নববধূকে জুতা পেটার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি তখন বেশ ছোট। বছর ১২ বোধহয় বয়স। একটা বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম যে নববধূকে অনেক লোকে মিলে জুতোপেটা করছে। বুঝতেই পারিনি সবাই মিলে কেন মারছে নতুন বউকে। কিছুটা বড় হয়ে গোটা বিষয়টা পরিষ্কার হয় আমার কাছে। সদ্য বিবাহিতা ওই নারী আসলে কৌমার্যের পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি।"

বিবেক তামাইচিকার আরো জানিয়েছিলেন, "অনেক সময়ে ঘরের ভেতরে পাঠানোর আগে বরকে শিক্ষিত করে তোলার নাম করে মদ খাওয়ানো হয় আর পর্ণোগ্রাফি দেখানো হয়।" নবদম্পতির বিছানায় দেওয়া হয় সাদা চাদর।

শারীরিক মিলনের শেষে যখন নবদম্পতি বাইরে আসেন, তখন দেখা হয় যে ওই সাদা চাদরে নববধূর রক্তের দাগ লেগেছে কী না।

দাগ থাকলে নববধূ যে বিয়ের সময় পর্যন্ত কুমারী-ই ছিলেন, সেটাই মনে করা হয়। তবেই পঞ্চায়েত ওই বিবাহকে স্বীকৃতি দেয়। টিকে যায় সেই বিয়ে।

আর যদি সদ্য বিবাহিতা নারী সেই পরীক্ষায় ফেল করেন, তাহলে তার পরিণাম ভোগার জন্য তাঁকে তৈরি থাকতে হয়। স্বামী চাইলে তখনই তাকে ত্যাগ করতে পারেন।

বিবেক তার প্রতিবাদের কথা জানিয়ে বলেন,"আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এ বছরের শেষে। কিন্তু আমি পঞ্চায়েতকে জানিয়ে দিয়েছি যে, আমার স্ত্রী কোনওমতেই ওই কৌমার্যের পরীক্ষা দেবে না। কিন্তু শুধু আমি বা আমাদের গ্রুপের সদস্যরা বললে তো হবে না। এগিয়ে আসতে হবে সমাজের বাকি অংশকেও।" সূত্র: বিবিসি

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.