Sylhet View 24 PRINT

সবুজ কলাপাতার নিচে মাটিচাপা হবিগঞ্জের সেই ‘সোনার প্রতীমা’

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-১১-১৪ ১০:৪৭:৫০

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি :: অভাব-অনটনের সংসার, আছে ঋণের চাপও। তবু দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সুখেই ছিলেন মহিন আহমেদ সোহেল ও নাজমা আক্তার দম্পতি। দুই ছেলে মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন তারা। তাইতো তাদের সুখের কথা চিন্তা করে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচং ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে।

সংসারে যতই অভাব-অনটন থাক-না কেন, কখনো ছেলে-মেয়েদের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেননি। কিন্তু কে জানতো এত আদরের মেয়েকে এভাবে হারাতে হবে, তাদের স্বপ্নের সাঁজানো সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় মহিন আহমেদ সোহেল ও নাজমা আক্তার দম্পতির দুই বছর দুই মাস বয়সী একমাত্র মেয়ে আদিবা আক্তার সোহাকে। এ ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন সোহেল ও নাজমা।

পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়- অভাবের তাড়নায় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং ছেড়ে চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন সোহেল ও নাজমা। সেখানে একটি ভাড়া বাসায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসবাস করতে। সঙ্গে থাকতেন নাজমার মা রেনু আক্তার (৪৫)। তাদের অনুপস্থিতিতে দুই সন্তানকে দেখাশোনা করতেন তিনি।

দূর্ঘটনার রাতে দেশের বাড়ি বানিয়াচং থেকে কর্মস্থল চট্টগ্রাম ফেরার পথে দুই ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ও শ্বাশুড়ি রেনু আক্তারকে নিয়ে রাত সাড়ে ১২টায় শায়েস্তাগঞ্জ থেকে ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ওঠেন সোহেল। রাত ৩টার দিকে ভয়াবহ ট্রেন দূর্ঘটনায় নিহত হয় তাদের একমাত্র আদরের মেয়ে সোহা। এ ঘটনায় আহত হন সোহেল ও নাজমা। তবে তাদের ছেলে ও শ্বাশুড়ির তেমন কোন ক্ষতি হয়নি।

সকালে সোহামণির মৃত্যুর খবর আসে বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে। এরই মধ্যে গুরুতর আহত সুহেল ও নাজমাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সারাদিন সোহার মরদেহ পড়ে থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল মর্গের ফ্লোরে। এমন একটি ছবি দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। যে ছবিটি নাড়া দেয় দেশবাসীর হৃদয়কে। পরে ওই দিন বিকেলে বাড়ি থেকে লোকজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সোহার মরদেহ বাড়িতে এনে দাফন করা হয়। নিয়তির নির্মম পরিহাস, এত আদরের মেয়েকে শেষবারের মতো দেখা হলো না মা-বাবার। তাদের অনুপস্থিতিতেই মাটি চাপা দেয়া হলো সোনার প্রতীমাকে।

বুধবার (১৩ নভেম্বর) বিকেলে বানিয়াচং উপজেলার তাম্মলিটুলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়- শোকে স্তব্ধ চারপাশ। শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে সোহার বাড়িতে। বাড়িতে ছিলেন সোহার দাদী সামছুন্নাহার বেগম, ফুফু জাহানারা বেগমসহ কয়েকজন আত্মিয়। সোহার বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলেই হাওমাও করে কেঁদে উঠেন তাঁরা। তাদের বুক ফাঁটা আর্তনাদে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি সেখানে উপস্থিত কেউই। এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয় সেখানে।

বুক ভরা আর্তনাদ নিয়ে শিশু সোহার দাদী সামছুন্নাহার বেগম বলেন- ‘আমার নাতনি যখনই বাড়িতে আসত তখনই আমার কত ভালো লাগতো। সারাক্ষণ আমার সাথে থাকতো। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতো। খাবার খাওয়ার পর আমাকে পানের ভাড়া এনে দিয়ে বলত ‘দাদী আমি তোমাকে পান বানিয়ে দেই?’

তিনি বলেন- ‘আজ আমার নাতনি এই পৃথিবীতে নেই ভাবতেই পারছি না।’- এই বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

সোহার ফুফু জাহানারা বেগম বলেন- ‘সোহামণি অনেক মিষ্টি মেয়ে ছিলো। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলত বলতো তাই আমরা ইচ্ছে করেই থাকে শুধু শুধু কথা বলাতাম। কিন্তু এখন আর আমাদের সোহামণি কোন কথা বলবে না।’

তিনি বলেন- ‘আমি আমার সোহামণির মৃত্যুর বিচার চাই। এছাড়া সোহামণির বাবা-মা খুব দরিদ্র। তারা ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। ভালো চিকিৎসা করার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই আমি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি তাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য।’

প্রতিবেশী সেলিম আহমেদ বলেন- ‘মেয়েটি অনেক মিষ্টি ছিল। কিন্তু আজ এই মেয়েটি দুনিয়াতে নেই। এছাড়া মেয়েটির মা-বাবাও পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তারা খুব দরিদ্র, তাই সরকারের কাছে তাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা ও কিছু আর্থিক সহযোগিতার দাবি জানাই।’

ইমদাদুল হোসেন খান বলেন- ‘এত ছোট নিষ্পাপ মেয়েটি এভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে তা মেনে নিতে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। এর উপর আবার তার মা-বাবাও পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তাদের উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন- ‘পরিবারটি খুব দরিদ্র, তাদের পক্ষে ভালো চিকিৎসা করানো সম্ভব না। তাই আমি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি তাদেরকে যেন উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এবং ভালো একটি অনুদান দেয়া হয়। কারণ সারা জীবন তারা আর কাজ করতে পারবেন কি-না তার ঠিক নেই।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল সাহেব বলেন- ‘আমরা পরিবারটিকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। এছাড়া সরকারও যদি তাদের একটু বেশি করে সহযোগিতা করে তাহলে ভালো হয়।’

এ ব্যাপারে বানিয়াচং উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন খন্দকার বলেন- ‘ট্রেন দূর্ঘটনায় বানিয়াচংয়ের দুইজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও ১২জন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত দুই পরিবারকে ১৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আমরা আরও সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা লিখিত আবেদন জানিয়েছি।’

এদিকে, বাড়ি থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের একটি করবস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে সোহাকে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় মা-বাবার আদরের প্রতীমাটি মাটি চাপা দিয়ে উপরে সবুজ কলাপাতা দিয়ে কবরটি ঢেকে রাখা হয়েছে। এ সময় সেখানে উপস্থিত অনেকেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলছিলেন- ‘যে মেয়েটিকে এতো ভালোবাসতো, সেই মেয়েটিকে শেষ দেখা দেখারও ভাগ্য হলো না তাদের (মা-বাবা)।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/১৪ নভেম্বর ২০১৯/কাজল/মিআচৌ

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.