আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

কার্লাইল কেন লন্ডন বাদ দিয়ে দিল্লিকে বেছে নিলেন?

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৭-১৬ ২৩:০৩:৫৮

:: সুজাত মনসুর :: মিঃ কার্লাইল বিলেতের একজন বিশিষ্ট আইনজীবি-কাম সম্মানিত লর্ড। বেশ কয়েকবছর ধরেই তিনি লন্ডনে বসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে, বিশেষ করে রাজনীতি নিয়ে একটি বিশেষ মতাদর্শের রাজনৈতিক জোটের পক্ষে লবিং করা থেকে শুরু করে যা যা করা দরকার তাই করছেন। এই রাজনৈতিক জোটটি হলো বিএনপি-জামাত জোট। তাঁর এ তৎপরতা সুচনা মুলতঃ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী দুই হাজার নয় সালে ক্ষমতা গ্রহনের সাথে সাথেই প্রায় সাড়ে চার যুগের অধিক তামাদি হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে।

এই যুদ্ধাপরাধীদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামের নেতাকর্মী। যাদের মধ্যে তাদের শীর্ষনেতা গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামি, আলী আহসান মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন সাইদী এবং বিএনপির নেতাদের মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আব্দুল আলিম অন্যতম্। বিএনপি শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সরাসরি বিপক্ষে। খালেদা জিয়া প্রকাশ্য জনসভায় যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ ও তাদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে। বিএনপি-জামাত কোটি কোটি টাকা খরচ করে লবিষ্ট নিয়োগ করে বিদেশে, এমনকি জাতিসংঘেও তদরিব করার চেষ্টা করেছে। আর সেই আন্তর্জাতিক লবিং-এর কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে লন্ডন ও লর্ড কার্লাইলকে।

এদিকে সবাই জানি খালেদা জিয়ার বড়ছেলে তারেক রহমান ও বুদ্ধিজীবি হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত চৌধুরী মঈনুদ্দিন লন্ডনে অবস্থান করছে। তারেক রহমান বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত তিন উদ্দিনের সরকারের সময় জেলে বছর খানেক কাটিয়ে রাজনীতি করবে না মুচলেকা দিয়ে চিকিৎসার নামে লন্ডনে এসে বসবাস করছে। অন্যদিকে মঈনুদ্দিন স্বাধীনতার পরপরই লন্ডনে এসে অবস্থান নিয়েছে এবং বাংলাদেশ বিরোধী যত ধরনের তৎপরতা সম্ভব চালিয়ে যাচ্ছে। দু’জনেই সাজাপ্রাপ্ত আসামী, অঢেল সম্পদের মালিক এবং দু’জনেরই কাজ হলো লন্ডনে বসে বাংলাদেশ বিরোধী সকল প্রকার তৎপরতা চালানো। আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো যুক্তরাজ্য বিশ্বব্যাপি গণতন্ত্রের পাদপীট ও আইনের শাসনের ব্যাপারে চ্যাম্পিয়ন বলে সুখ্যাতি থাকলেও দেশটিতে বিশ্বের যত দাগি খুনি, স্মাগলার, ডাকাত, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠনকারী শুধুমাত্র তথাকথিত মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে বেচেবর্তে থাকতে পারে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আর্থিক সহায়তা পায়।

নিজেরা নাৎসীদের ব্যপারে জিরো টলারেন্স দেখালেও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিশেষ করে সরকারীদল ও বাংলাদেশ হাইকমিশন সেভাবে তৎপর নয়। যুক্তরাজ্যস্থ সরকারীদলের হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তি ছাড়া এ ব্যাপারে কারো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সবাই আছে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এমনকি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আওয়ামী লীগ ঘরানার অনেকেই জামাত-বিএনপি নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশণগুলোতে টকশোতে এমন সব ব্যক্তির উপস্থাপনায় টকশোতে অংশ নেয়, যারা মূলতঃ কারলাইলদের সাথে জোটের পক্ষ থেকে লিয়াঁজো রক্ষা করে। কারলাইলদের এই অশুভ তৎপরতা সম্পর্কে ইতোপুর্বেও জনকন্ঠে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
শুরুতেই উল্লেখ করেছি, লর্ড কার্লাইল বিএনপি-জামাত জোটের লরিষ্ট। তিনি যে কেবল শুধুই লবিস্ট তা কিন্তু নয়, তিনি হলেন তাদের আন্তর্জাতিক লবিষ্ট গোষ্ঠির পালের গোদা। হাউস অব কমন্স থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক এমন কোন ফোরাম নেই যেখানে তারা লন্ডনে বসে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য চেষ্টা চালায়নি। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রপধান পর্যন্ত তদ্বির চালিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। এর বিনিময়ে মোটা অংকের  পাউন্ড মিঃ কার্লাইলরা হাতিয়ে নিয়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক।  তাদের পেশাই হলো তাই।  কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা আমলে নেননি। কেননা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের সাজা কার্যকর করা তাঁর নির্বাচনী অঙ্গিকার।

তারা যে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্যই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করে তা কিন্তু নয়। মানবাধিকার, মুক্তমতের অবাধ স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বিরূপ আচরনের বিষয়ে বানোয়াট কল্পকাহিনী প্রচার করে বাংলাদেশকে বন্ধুহীন  করতে না পারুক অন্ততঃ বহির্বিশ্বে যাতে বাংলাদেশ সরকার ও শেখ হাসিনার ভাবমুর্তি কালিমালিপ্ত করতে পারে সে চেষ্টায় বিরামহীন কাজ করে  যাচ্ছে তারেক রহমান ও মঈনুদ্দিন গংদের চক অনুযায়ী। বাংলাদেশ সরকার কারলাইলের ভিসা আবেদন নাকচ না করে, বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায়ই খোড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে দিল্লীতে বসে বাংলাদেশের রাজনীতি ও খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে  সাংবাদিক সম্মেলন করার পায়তারা ধারাবাহিত ষড়যন্ত্রেরই অংশ।

বিএনপির অপরিপক্ক হাইকমান্ড (যে মুলতঃ খালেদা জিয়া জেলের বাইরে থাকাকাকালীনও অঘোষিত হাইকমান্ডের দায়িত্ব পালনকারি) তারেক রহমানের পরামর্শেই লর্ড কারলাইল ভারতের রাজধানী দিল্লীকে বেছে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে কিন্তু কেন? তিনি তো সেটা বাংলাদেশে এসেও করতে পারতেন। বাংলাদেশ সরকার তো তার ভিসা আবেদন নাকচ করেনি, বিবেচনাধীন রেখেছে। ধরে নিলাম তার অতীত কার্যকলাপ বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার তাকে ভিসা দিলো না। কেননা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা অন্যকোন যৌক্তিক কারনে সরকার তাকে ভিসা না দেয়ার অধিকার রাখে (এমনকি কারলাইলের চেয়েও অধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে কোন ধরনের কারণ দর্শানো ছাড়াই সরকার তা করতে পারে)। সে ক্ষেত্রে কারলাইল তো লন্ডনে বসেই তার কাংখিত সাংবাদিক সম্মেলনটি করতে পারতেন। তা না করে তিনি ভিসার সকল প্রকার শর্তাদি ভঙ্গ করে বাংলাদেশের প্রতিবেশি, মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত(জিয়া ও খালেদা জিয়ার শাাসনামল বাদ দিয়ে) আমাদের অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র ভারতকে বেছে নিলেন কেন? এর উত্তর ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমারের বক্তব্যেই রয়েছে। তিনি বলেছেন,‘ লর্ড কার্লাইলের ভিসা বাতিলের কথা তাকে আগেই জানানো হয়েছিল। তিনি যে কাজের জন্য ভারত সফরে আসতে চাচ্ছিলেন ভিসা আবেদনের ফর্মে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি।
ভিসা আবেদনের ফর্মে তিনি ভারত সফরের যে উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেটির সঙ্গে তার ভারতে আসার মূল উদ্দেশ্যের মিল না থাকায় ভিসা বাতিল করা হয়েছিল।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমস্যা তৈরি করতে তিনি (কারলাইল) আসছিলেন এটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। এর ফলে বাংলাদেশের বিরোধীদলগুলির সঙ্গেও আমাদের ভুল বুঝাবুঝি হতে পারত। তার কিছু বলার থাকলে উনি কেন লন্ডন থেকে বলেননি? কেন ভারতে এসেছিলেন? এখানে আসলে আমাদের দেশের আইন মানতে হবে। তাকে জানতে হবে বাণিজ্যিক ভিসায় এসে সাংবাদিক সম্মেলন করা যায় না।’ ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্রের কথাই ঠিক। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে হৃদ্যতাপুর্ণ সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই ছিলো মুখ্য ও একমাত্র উদ্দেশ্য।
তারেক রহমান ও জামাতের ভুল রাজনীতির জালে পড়া আটকে পড়া দিশেহারা বিএনপির এটিও একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। তারা দেশে সুবিধা করতে না পেরে এতদিন বিদেশীদের নিকট ধর্ণা দিয়েছে হারানো ক্ষমতা ফিরে পাবার জন্য। কিন্তু শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা, সময়োপযোগি, বিচক্ষন ও সাহসী  সিদ্ধান্তের কারনে সুবিধা করতে পারেনি। শেষমেষ তারা ভারতের নিকটও ধর্ণা দিয়েছে তাদেরকে যেভাবে হউক ক্ষমতায় বসিয়ে দেবার জন্য। যদিও ভারতবিরোধী শ্লোগান ও রাজনৈতিক শক্তিই তাদের মূল পুঁজি। এমনকি তাদের শাসনামলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়-ট্রেনিং দেবার বিষয়টি নিশ্চয় ভারত ভুলে যাবার কথা নয়। বিএনপি কি করে ভাবলো সেই ভারত আবার তাদের অত্যন্ত ভালো বন্ধু শেখ হাসিনা সরকারকে হটিয়ে বিএনপি-জামাতকে ক্ষমতায় বসাতে সহায়তা করবে? অন্যদিকে ভারত একটি ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দেশ, তারা কেন অন্য একটি স্বাধীন দেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার পালাবদলে ভুমিকা রাখবে? সুতরাং যৌক্তিক কারনেই বিএনপির ভারত মিশন ব্যর্থ হয়েছে।

সুতরাং দেশে দিনদিন জনবিচ্ছিন্ন হওয়া দলটির দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আইনজীবি নিয়োগের নামে লর্ড কারলাইলকে দিয়ে দিল্লীতে সাংবাদিক সম্মেলন করানোর সিদ্ধান্ত বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির চরম রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরও প্রকাশ। আমার ধারণা বৃটিশ লর্ড কারলাইল ভারত সরকার তাকে দিল্লীতে সাংবাদিক সম্মেলন করা দুরে থাক, ভারতের মাটিতে পাও রাখতে দেবে না তিনি তা জানতেন। কেননা, ভিসার শর্ত ভঙের কারনে তার ভিসা যে বাতিল করা হয়েছে তা আগেই জানানো হযেছিলো। তবুও তিনি গিয়েছেন এবং যথারীতি পত্রপাট ফেরত এসেছেন। আবারও প্রশ্ন জাগে, ভিসা বাতিল হয়েছে জানা সত্বে কেন কারলাইল ভারতে প্রবেশের চেষ্টা নিলেন? উত্তর অতিসহজ, পাউন্ড হালাল করণ ও ভারত গণতান্ত্রিক দেশ হলেও মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই তা প্রমানের চেষ্টা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিবৃতিতে কিন্তু তাই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি মনে করে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে মুক্ত চিন্তা অনুশীলনের সঙ্গে এই ঘটনা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ কিন্তু ফখরুল ও কারলাইররা বুঝতে পারেননি বিষয়টি তাদের জন্যই বুমেরাং হয়ে যাবে। একজন সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের পক্ষেও অনুধাবন করা কঠিন নয় যে, বিষয়টি ছিলো বিএনপি নামক অস্তগামি একটি দলের হাস্যকর ও অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত। যা দলটির আরেকটি চরম দেউলিয়াত্বেরই বহিঃপ্রকাশ।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, প্রবীন রাজনৈতিক নেতা তরিকুল ইসলামের একটি মন্তব্য দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। সম্প্রতি চরমভাবে রোগাক্রান্ত তরিকুল ইসলাম তাঁর যশোরের বাসভবনে বিএনপির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, “আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ান্স।” আর তারেক রহমান বিএনপি করাই কঠিন করে দিয়েছে’। বাস্তবতা তো তাই। বিএনপির অন্তিম পরিণতি এখন সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হয়।

সুজাত মনসুর : যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক।
হোয়াইটহ্যাভেন, যুক্তরাজ্য ১৪ জুলাই, ২০১৮

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন