আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

আমাদের মুক্তিসংগ্রামে শেখ মুজিবের রেণু

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৮-০৯ ১৫:২৭:২৮

সুজাত মনসুর :: বাংলা নামক এ দেশটিতে একজন সাধারনের বেশে অসাধারণ মহিযষী নারীর জন্ম হয়েছিলো, আমাদের চিরচেনা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যাকে আদর করে রেণু বলে ডাকতেন। কালের পরিক্রমনায়,আপন স্ককীয়তায় সমুজ্জল, আপন কর্মগুনে যিনি হয়েছেন বঙ্গমাতা। পুত্র শেখ কামালের মতো তাঁরও জীবনের শুরু আগস্টে, শেষও আগস্টে।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালে, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সূচনালগ্নে। আর বেগম মুজিবের জন্মা আরও দশ বছর পা, ৩০ সালের ৮ই আগস্ট। চাচাতো ভাই শেখ মুজিবের সাথে শেখ ফজিলাতুন নেসার যখন বিয়ে হয় তখন তাঁর বয়স তিন। ঐ সময় শেখ মুজিব পড়ালেখা করার জন্য বাবার সাথে গোপালগঞ্জে থাকতেন। আর রেণু থাকতেন গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় শ্বাশুড়ির তত্বাবধানে। স্বামীর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হবার সুচনা সেই শিশু বয়স থেকেই। তবে সে ব্যাপারে তাঁর আফসোস বা অভিযোগ কিংবা অতৃপ্তি ছিলো না। তাঁর সারাজীবনের ইতিবৃত্ত পর্যালোচনা করে বল্ইা যায়, তিনি সেই শিশু বয়স থেকেই প্রস্তুতি ছিলেন মানসিকভাবে স্বামীর পাশাপাশি নিজেকে উৎসর্গ করার দেশ-মাতৃকার সেব্য়া। জীবন দিয়েও তা প্রমাণ করে গেছেন। তাই তিনি হয়ে আছেন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র, সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর ভাবশিষ্য হয়ে স্বাধীন পাকিস্তান সৃষ্টির স্বপ্নে বিভোর, তখন শেখ মুজিবের রেণু কিন্তু পূর্ণ কিশোরী, স্বামী-সংসার তখন পুরোপুরিই বুঝতে ও অনুধাবন করতে পারেন। স্বামীর অনুপস্থিতি ঠিকই অনুভব করছেন, রাজনৈতিক জীবনের অনিশ্চয়তা তাঁকেও ভাবাচ্ছে কিন্তু কখনোই সাধারণ গৃহিনীর মতো অনুযোগ করেননি, অভিমান করেননি বরং আকারে-ইঙ্গিতে বুঝাতে চেয়েছেন তুমি এগিয়ে যাও ইস্পিত লক্ষ্যের দিকে। আমি আছি তোমার পাশে সার্বক্ষনিক ছায়ার মতো সহযাত্রী হয়ে। এমনকি রাজনীতি করতে গিয়ে, পথ চলতে গিয়ে যাতে আর্থিক অসমার্থতার কারনে পিছিয়ে পড়তে না হয়, সেজন্যে স্বামী বাড়ি এলেই সঞ্চিত টাকা তুলে দিতেন বাংলা-বাঙালির ভবিষ্যত ত্রানকর্তার হাতে।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “রেনু বলল, 'এভাবে তোমার কতকাল চলবে।' আমি বুঝতে পারলাম, যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেনু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেনু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখত, যাতে আমার কষ্ট না হয়।” শুধু কি আর্থিক সহায়তা, এমনকি নেই তিনি করেননি স্বামীর উপস্থিতিতে কিংবা অনপস্থিতিতে তাঁর চলার পথকে মসৃণ করার জন্য। একজন নির্ভার ও হৃদয়বতি স্ত্রী হিসেবে তিনি সব সময়্ চেয়েছেন স্বামী যেন তাঁর কাজগুলো পারিবারিক কোন বাাঁধার কারনে থমকে না যায়। স্বামী যেন নির্বিঘেœ ইস্পিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন। তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন নির্ভরশীল ও বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো টুঙ্গিপাড়ার রেণু, টুঙ্গিপাড়ার খোকার পাশে থেকেছেন। সহমরণ বরণ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর থেকেই মূলতঃ সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীতে পরিনত হন এবং পরিবার-পরিজনদের দায়িত্ব ছেড়ে দেন প্রিয় রেণুর ওপর। কেননা, তিনি যেমন জনগনের মনের ভাষা বুঝতেন, তেমনি বুঝতেন স্ত্রী রেণুর মনের ভাষা, চোখের ইশারা। তিনি অনুধাবণ করতে পেরেছিলেন, রেণু যখন পাশে আছে তখন আর ভাবনার কোন কারণ নেই, পিছুটান নেই। তাইতো তিনি জেল-জুলুমকে নিত্য সঙ্গী করতে পারেন। মৃত্যুকেও হাসিমুখে বরণ করতে প্রস্তুত থাকেন। বেগম ফজিলাতুন নেছাও স্বামীর মনোভাব অনুধাবণ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনিও নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন সেভাবে। শুরুতেই তিনি স্বামীর বিশ্বাসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই, যখন গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগের সম্মেলন হয়েছিল। সে সময় তিনি কলকাতা থেকে গোপালগঞ্জে আগত নেতাদের আপ্যায়ন, খাবারের ব্যবস্থায় যাতে কোন ধরনের ত্রæটি না হয় সেজন্য শ্বাশুড়ীর সাথে তাঁদের গোপালগঞ্জের বাসায় এসে অবস্থান নেন এবং সম্মানিত মেহমানদের আপ্যায়নে শ্বাশুড়িকে সহায়তা করেন। তাঁর এই দায়িত্ব নিয়ে দলীয় নেতাকর্মী, আত্মীয়-স্বজন, মেহমানদের আদর-আপ্যায়ন কিংবা আর্থিকসহ সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত ছিল মৃত্যু অবধি। তিনি বঙ্গবন্ধুর চলার পথে কখনোই সাংসারিক দায়-দায়িত্বের বিষয়টি এনে বিব্রত করতে চাননি। কেননা, তিনি জানতেন তাঁর স্বামী বৃহত্তর পরিবার অর্থাৎ দেশ ও জাতির মুক্তির তরে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জন্মাবধি। অন্যান্য অভিভাবকদের মতো প্রতিবন্ধকতা না হয়ে শেখ লুৎফুর রহমান এবং শেখ সায়রা খাতুন যেমন সন্তানের সাহস ও সহযোগিতার প্রতিক হয়েছিলেন, তেমনি বেগম ফজিলাতুন নেছাও তাঁদের নিকট থেকে তা রপ্ত করেছিলেন।

বৃটিশ আমলে রাজনীতিতে হাতেখড়ি এবং সার্বক্ষণিক ও প্রয়োজনীয় একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হলো, স্বাধীনতার আবরনে নতুন ঔপনিবেশিক দেশ পাকিস্তানে। অন্য সবাই বিষয়টি পুরোপুরি অনুধাবন করতে না পারলেও শেখ মুজিব কিন্তু ঠিকই অনুভব করতে পেরেছিলেন, মুক্তির সংগ্রাম শেষ নয়, শুরু হলো মাত্র। আর এ সংগ্রাম হবে আরো কঠিন। বৃটিশরা ছিল ভিন্ন জাতি, আর পাকিস্তানি শোষকদের মাঝে রয়েছে স্বজাতীয় মোনাফেক, লুঠেরা ধনিক শ্রেনী, বর্ণচোরা রাজনীতিবিদ। পাকিস্তান সৃষ্টির দুই বছরের মাথায় তিনি ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে সুচনা করেন বাংলা ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম।

পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠিও বসে ছিলো না। যে কোন মুল্যে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং এর রূপকার শেখ মুজিবুর রহমানকে দমাতে শুরু করে জুুলুম-নির্যাতন-গ্রেফতার। এসব করে যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে বাগে আনত পারছিল না, তখন শুরু করে ষড়যন্ত্র, কি করে জীবনের তরে শেষ করে দেয়া যায়। দায়ের করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এক্ষেত্রেও বেগম মুুজিবও একগুয়ে, জেদি, আপোসহীন। স্বামীর জীবন নয়, চাই বাংলার স্বাধীনতা। তাঁর জেদের কাছে সামরিক জান্তা পরাভুত। শেখ মুজিবের মুক্তি ও আইযুবের পতন, জনতার বিজয়ের কোন বিকল্প নেই। নেতারা যখন আপোষকামী-বিভ্রান্ত তিনি কিন্ত নিশ্চিত প্যারোলে মুক্তি নিলে পরাজয়, আর না নিলে বিজয়। তাই সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে বড় মেয়েকে দিকে স্বামীর কাছে বার্তা পাঠান, ‘গোলটেবিল বৈঠকে অবশ্যই যাবে, তবে মুক্ত মুজিব হিসেবে।’ জননেত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, “‘ওই সময় প্লেন রেডি, তখনকার তেজগাঁও এয়ারপোর্টে। আব্বাকে উঠায়ে নিয়ে যাবে...আওয়ামী লীগের নেতারাও নেমে পড়েছে এবং সব চলে গেছে ক্যান্টনমেন্টে আব্বাকে যেখানে বন্দী করে রেখেছে ওইখানে। মার কাছে খবর আসল, আমি ঢাকা ভার্সিটিতে। মা আমাকে খবর পাঠালেন, শিগগির আয়।”...বেগম মুজিব তাঁর বড় মেয়ে আর জামাতা ওয়াজেদ মিয়াকে পাঠালেন ক্যান্টনমেন্টে চিরকুট দিয়ে। শেখ হাসিনা আর ওয়াজেদ সাহেবকে শিখিয়ে দিলেন কী বলতে হবে। বেগম মুজিবের কড়া নির্দেশ, ‘জনগণ তোমার সঙ্গে আছে। তুমি কিছুতেই প্যারোলে মুক্তি নেবে না। তোমাকে বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসতে হবে।’ শেখ হাসিনা লিখেছেন, পিতার কাছে মায়ের বার্তা পৌঁছে দিয়ে ফেরার পর নেতারা তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি কেমন মেয়ে, বাবার মুক্তি চাও না।” শেখ হাসিনা অনেক কেঁদেছিলেন। কিন্তু বেগম মুজিবের সেদিনের পরামর্শ সঠিক বলে প্রমাণিত হলো। জান্তা শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। শেখ মুজিব বেরিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু হয়ে।

একই ঘটনা ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষনের আগে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা ভাষনের খসড়া তৈরি করছেন। বেগম মুজিব সবাইকে বের করে দিয়ে, বঙ্গবন্ধুকে দশ মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিতে বললেন এবং নিজে বসলেন পায়ের দিকে। তিনি ঐ সময় যা বলেছিলেন, তার মমার্থ হলো, যিনি জনগনের ভাষা বুঝতে পারেন, তিনি পূর্বে প্রস্তুত বক্তৃতা দেবেন কেন? সভাস্থলে যাবেন, জনগনের মনের কথা অনুধাবন করবেন। উপস্থিত সময়ে মুখে যা আসবে তা বলবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, তিনি এমন কিছু বলবেন না, যাতে সমাবেশে সমবেত লাখো মানুষের জীবনহানির কারণ হতে পারে এবং দুনিয়াব্যাপি বঙ্গবন্ধু আর বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামীর বদলে বিচ্ছিন্নতাবাদীর তকমা গাঁয়ে মাখবে। এই হচ্ছেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। যার অসমান্য অবদান ব্যতিত আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ত¦রান্বিত হতো না। আমরা বাঙালিরা স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতাম না। টুঙ্গিপাড়ার এক দুরন্ত বালক, যে কি না বিশাল মধুমতি নদী সাঁতরে এপার-ওপার করতো। রেণু বিহীন সেই বালক খোকা থেকে শেখ মুজিব আর শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হতে পারতেন না।

বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানার স্মৃতিচারণে এভাবেই চিত্রিত হয়েছেন বেগম মুজিব। তিনি লিখেছেন, “--আমার মা! তাঁর কথা ভাবি। কত অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তো তিনি আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন। কত অল্প বয়সে এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁকে জীবন-সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছিল। আব্বা আগের দিন মন্ত্রী, পরের দিন জেলখানায়; বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সরকারি বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে, কিন্তু কেউ মাকে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না, আমার তখনো জন্ম হয়নি, কিন্তু এসব ঘটনা তো শুনেছি, পড়েছি, পরে নিজের চোখে দেখেছি। গ্রামে জন্ম হওয়া একজন সাধারণ নারী আমার মা, ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন মিশনারি স্কুলে। কিন্তু কী যে প্রজ্ঞা, কী যে তাঁর ধৈর্য। আমার মায়ের কাছে আমাদের যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য আর সাহস। সবাইকে এক করে রাখা। এতগুলো লোক বাড়িতে খাচ্ছে, দাচ্ছে, আমাদের গ্রামে কোন মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছে, তাকে এনে ঢাকায় কলেজে ভর্তি করে দাও, কাকে বিয়ে দিতে হবে! সব সামলাচ্ছেন। এর মধ্যে আমাদের সকালে কোরআন শরিফ পড়া শেখাতে মৌলভি সাহেব আসছেন, তারপর নাচ শিখছি, সেতার শিখছি, বেহালা শিখছি, সব কিন্তু মায়ের সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাঁর নিজের বয়স কত! আমার তো মনে হয়, আমার মা কি কোনো দিন তাঁর শৈশবে কিংবা কৈশোরে একটা ফিতা বা রঙিন চুড়ি চেয়েছেন কারও কাছে! মা-ই তো সব থেকে বঞ্চিত ছিলেন। অথচ তিনি হাসিমুখে সব সামলিয়েছেন।”

সিলেটভিউ২৪ডটকম/৯ আগস্ট ২০১৮/এসএম/এক

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন