আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

যেভাবে কমানো সম্ভব ব্যাংক ঋণের সুদহার

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৮-২৫ ০১:০১:১৪

তপন কুমার ঘোষ :: ব্যাংক ঋণের সুদহার এই সময়ের বহুল আলোচিত একটি বিষয়। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার কমানোর জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ দেনদরবার করে আসছেন। তাদের যুক্তি, ব্যাংক ঋণের সুদহার বেশি হওয়ায় ব্যবসা পরিচালনার খরচ বেড়ে গেছে। ১২ থেকে ১৪ শতাংশ হারে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দায়। অযৌক্তিক নয় এই দাবি। বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস গত ১ জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার কমিয়ে ৯ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছিল।

এ ঘোষণার সঙ্গে মিল রেখে শেষমেশ অনেক ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত জুলাই মাসভিত্তিক তথ্যানুযায়ী, অধিকাংশ ঋণের সুদহার কমিয়ে ৯ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদহার ১ অঙ্কে অর্থাৎ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারও আন্তরিক। এই লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোকে বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে সরকার বিশেষ কিছু সুবিধা দিয়েছে। এসব সুবিধার কার্যকারিতা ও সুফল দেখতে কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে দিত। এরপর একসময় সুদের ঊর্ধ্বসীমা (সিলিং রেট) ও নিম্নসীমা (ফ্লোর রেট) বেঁধে দিত। ব্যাংকগুলো ওই সীমারেখার মধ্যে স্ব স্ব ব্যাংকের সুদহার নির্ধারণ করত। সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এখন অনেকটাই স্বাধীন। শুধু রপ্তানি ঋণ এবং কৃষি ও পল্লী ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার নির্ধারণ করে দেয়। বর্তমানে রপ্তানি ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ৭ শতাংশ এবং কৃষি ঋণের ৯ শতাংশ। ক্রেডিট কার্ডের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন আছে। ঋণের সুদহার কমাতে হলে আমানতের সুদহার কমাতে হবে। এটাই স্বাভাবিক।

এর ফলে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। শুধু নিরাপত্তা নয়, কিছু লাভের আশায় মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। সুদ-আয়নির্ভর ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীদের কথাও ভাবতে হবে। সব থেকে বড় কথা, ব্যাংক পরের ধনে পোদ্দারি করে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশের কিছু বেশি। আমানতের সুদের ওপর ১০ বা ১৫ শতাংশ হারে উেস কর কর্তন করা হয়। তদুপরি আছে আবগারি শুল্ক ও হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ। আমানতের সুদহার নির্ধারণের সময় এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। নইলে সঞ্চয়পত্রের ওপর অযাচিত চাপ বাড়বে। খেলাপি ঋণ এই সময়ের আর একটা বহুল চর্চিত বিষয়। এটা অনেকেরই অজানা নয় যে, ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ না করলে তা শ্রেণিকৃত হয়ে যায়। শ্রেণিকৃত ঋণ হচ্ছে ব্যাংকের নন-পারফর্মিং অ্যাসেট বা অনুৎপাদক সম্পদ। শ্রেণিকৃত ঋণের তিনটি পর্যায়— নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ বা কুঋণ। ‘অধঃমান’ ও ‘সন্দেহজনক’ হিসেবে শ্রেণিকৃত ঋণের ওপর আরোপিত সুদ, আদায় না হওয়া পর্যন্ত, আয় খাতে জমা না করে ‘স্থগিত সুদ’ হিসাবে জমা করা হয়। আবার ‘মন্দ’ বা ‘কু’ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের ওপর সুদ আরোপ স্থগিত থাকে। শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় হলেই কেবল অর্জিত সুদ আয় খাতে স্থানান্তর করা যায়। শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে কোনো আয় না হওয়ার কারণেই এটাকে বলা হয় অনুৎপাদক সম্পদ। আটকে পড়া ঋণ আদায় করে নতুন গ্রাহকদের ঋণ দিলে স্বাভাবিকভাবে ব্যাংকের আয় বাড়বে। শ্রেণিকৃত ঋণের আরও একটা নেতিবাচক দিক হচ্ছে প্রভিশনিং।

ব্যাংকের নিট মুনাফা হিসাব করার সময় ঋণ ও বিনিয়োগের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয়। সম্পদের সম্ভাব্য ক্ষতির বিপরীতে অর্থের সংস্থান রাখা হচ্ছে প্রভিশনিং। ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা থেকে অর্থ স্থানান্তর করে প্রভিশন হিসাবে জমা করা হয়।  বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ করে দীর্ঘদিনের অনাদায়ী ঋণ আদায় করা হয়। অন্যদিকে, আদায়ের সব চেষ্টা বিফলে গেলে ‘কু’ বা ‘মন্দ’ ঋণ রাইটঅফ বা অবলোপন করা হয়। ভবিষ্যতে সুদ মওকুফ বা ঋণ অবলোপনের উদ্দেশ্যে প্রভিশন রাখা হয়। ভালো ঋণ থেকে অর্জিত সুদ ও অন্যান্য সেবা থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটা অংশ চলে যায় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে। ফলে ব্যাংকের নিট মুনাফা কমে যায়। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো একদিকে আমানতের সুদহার কমিয়ে ব্যয় সাশ্রয়, অন্যদিকে ঋণের সুদহার বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধির কৌশল নেয়। এ যেন শাঁখের করাত। এর ফলে খেলাপি ঋণের দায় গিয়ে চাপে সাধারণ গ্রাহকদের ওপর। কেউ বলতেই পারেন, ঋণখেলাপিদের দায় আমানতকারী ও অন্য ভালো ঋণগ্রহীতারা কেন নেবেন? কোটি টাকার প্রশ্ন! এখানেই শেষ নয়, শ্রেণিকৃত ঋণের বিরূপ প্রভাব পড়ে ব্যাংকের মূলধন হিসাবের ওপর। মুনাফা ব্যাংকের মূলধন বাড়ায়। অন্যদিকে লোকসান হলে ব্যাংকের মূলধন কমে যায়। ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী সম্পদের ঝুঁকি বিবেচনা করে ঝুঁকিভিত্তিক পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের প্রধান সম্পদ হচ্ছে ঋণ। খেলাপি ঋণ আদায় অথবা মানের উন্নয়ন করা হলে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ কমে আসবে। ফলে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতার ঝুঁকি কমবে। মোদ্দা কথা, শ্রেণিকৃত ঋণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকের মুনাফা ও মূলধনের ওপর। সোজা কথায়, শ্রেণিকৃত ঋণ বাড়লে ব্যাংকের আয় তথা মুনাফা কমে। একটা বিষয় পরিষ্কার, ঋণের সুদহার কমাতে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। কাজটি কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। বিকল্প আর কীই বা আছে? এ ব্যাপারে সব পক্ষকেই তৎপর হতে হবে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও এ ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা রাখবে— এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক
জনতা ব্যাংক লিমিটেড

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন