আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

তালাক নিয়ে যত বিভ্রান্তি!

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৮-২৫ ০১:০৯:৪৬

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক :: প্রথমেই তালাক সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাটি শুধরে নিই। মুখে মুখে তিনবার ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করলে বা একসঙ্গে ‘বায়েন তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করলে তালাক কার্যকর হয় না। এমনকি মুখে উচ্চারণ ছাড়া লিখিতভাবে তালাক দিলেও তা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয় না।
মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের স্বামী যে কোনো সময় কোনোরূপ কারণ ছাড়াই তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। তালাকের ক্ষেত্রে স্বামীর ক্ষমতা একচ্ছত্র, কিন্তু এজন্য আইনের বিধান মেনেই তা করতে হয়। বিধান না মানা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে, স্বামী তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর স্ত্রী সে সময় যে এলাকায় বসবাস করছেন সে এলাকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর মেয়র/সিটি করপোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিস দিতে হবে। সেই সঙ্গে তালাক গ্রহীতাকে ওই নোটিসের নকল প্রদান করতে হবে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, তালাকের নোটিসটি কত সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। আইনে বলা আছে ‘তখনই/পরবর্তী সময়ে/যথাশীঘ্রই’ সম্ভব। যা পাঠাচ্ছেন এটিই তালাকের নোটিস, এর জন্য আইন নির্দিষ্ট কোনো ফরম বা বক্তব্য নির্ধারণ করেনি। নোটিস লেখা বা পাঠানোর কাজটি তালাকদাতা নিজেও করতে পারেন, আবার অন্য কাউকে দিয়েও করাতে পারেন। নোটিস পাঠানোর কাজটি ডাকযোগেও হতে পারে, আবার সরাসরিও হতে পারে। ডাকযোগে রেজিস্ট্রি করে এডিসহযোগে পাঠালে ভালো হয়।
সরাসরি পাঠালে নোটিসের এক কপি করে রিসিভ করে নেওয়া ভালো। চেয়ারম্যান/মেয়র নোটিসপ্রাপ্তির তারিখ থেকে ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো তালাক বলবৎ হবে না। কারণ নোটিসপ্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপস বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশি পরিষদ গঠন করবে এবং ওই পরিষদ এ-জাতীয় সমঝোতার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে। উল্লেখ্য, নোটিস পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিশের কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে। তবে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে গর্ভকাল শেষ হওয়ার পর তালাক কার্যকর হবে। তবে সমঝোতার ৯০ দিন সময় চেয়ারম্যান কর্তৃক নোটিসপ্রাপ্তির তারিখ থেকে শুরু হয়। তালাক দেওয়া বা নোটিস লেখার তারিখ থেকে শুরু হয় না। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডিএলআর পৃষ্ঠা ৭০০)। সালিশি পরিষদ ৯০ দিন সময় পেয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রতি ৩০ দিনে একটি করে মোট তিনটি নোটিস দেবে। এর মধ্যে স্বামী নোটিস প্রত্যাহার না করলে তালাক কার্যকর হবে। কিন্তু নোটিস প্রত্যাহার করলে তালাক কার্যকর হবে না। নোটিস পাওয়ার ৯০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই যদি তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী অন্য কারও সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে ওই বিয়ে অবৈধ বলে গণ্য হবে। (সৈয়দ আলী নেওয়াজ বনাম কর্নেল মো. ইউসুফ, ১৫ ডিএলআর (আপিল বিভাগ, পৃষ্ঠা-৯)। কারণ তালাক সম্পূর্ণ কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত পক্ষগণ আইনসম্মতভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই থেকে যায়। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডিএলআর পৃষ্ঠা ৭০০)। এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রীকে ভরণপোষণও দিতে বাধ্য।

এখানে মনে রাখা দরকার, নোটিস পাঠানোর কোনো দায়িত্ব বিধিবদ্ধভাবে কাজির নেই। যিনি তালাক দিলেন, তিনিই কাজটি করবেন। তবে কোনো তালাকদাতা যদি নিজের অসামর্থ্য বা অজ্ঞতার দরুন কোনো কাজিকে ওই কাজের উপযুক্ত ব্যক্তি বলে মনে করেন, তবে তিনি কাজিকে দিয়ে নোটিস পাঠানোর কাজটি করাতে পারেন। লাইসেন্সপ্রাপ্ত দেশের বেশির ভাগ কাজিই ‘মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭(১) ধারায় তালাকের নোটিস’ ধরনের শিরোনামযুক্ত নোটিস নিজেরাই ছাপিয়ে রেখেছেন এবং সেগুলো দিয়ে যার যার চাহিদামতো তালাকের নোটিস পাঠাচ্ছেন। নির্ধারিত নিয়ম ও সময়ান্তে প্রদত্ত একটি তালাক যদি কার্যকর হয়, তখনই কেবল তা রেজিস্ট্রি করার সুযোগ আসবে। বিদ্যমান আইনের বিধানমতে, মুসলিম বিয়ে রেজিস্ট্রি করানো বরের জন্য বাধ্যতামূলক হলেও তালাকের ক্ষেত্রে তা তালাকদাতার ইচ্ছাধীন। তবে কোনো তালাক রেজিস্ট্রি করার আগে ওই তালাকটি বিধি অনুযায়ী কার্যকর হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা কাজির রয়েছে। কাজিরা তালাকদাতার হয়ে নোটিস তৈরি ও পাঠানোর যে কাজটি করেন, তা শুধু তালাকের ঘোষণা হিসেবে কাজ করবে। ওই ঘোষণা শেষ পর্যন্ত কার্যকর না-ও হতে পারে। তাই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তালাক রেজিস্ট্রি করে ফেলার সুযোগ কাজির নেই। তিনি যদি তা করেন, তাহলে ওই রেজিস্ট্রেশন কার্যকর হওয়া কোনো তালাকের প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে না। কেবল ৯০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরে একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার কর্তৃক তালাকের সার্টিফিকেট গ্রহণ করা যায়।

আবার বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী যেহেতু তালাক প্রদানের সময় স্ত্রী যে এলাকায় বসবাস করেন, সেই এলাকায় তা কার্যকর হয় এবং সেই এলাকার কাজির কাছেই তা রেজিস্ট্রিও করতে হয়; সেহেতু তালাক কার্যকরকারী পক্ষদ্বয়ের মধ্যে স্ত্রীর বসবাস যে এলাকায়, সেই এলাকার বাইরের কোনো কাজির সুযোগ নেই তাদের মধ্যকার তালাকটি রেজিস্ট্রি করার। আর পেছনের তারিখ ব্যবহার করে কোনো তালাক রেজিস্ট্রি করা অসদাচরণ তো বটেই, রীতিমতো অপরাধও। উল্লেখ্য, স্বামী যদি চেয়ারম্যান ও স্ত্রীকে নোটিস প্রদান না করেন তাহলে স্বামী এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডনীয় হবেন, কিন্তু তালাক বাতিল হবে না। ওই তালাক কার্যকর হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে অধ্যাদেশের কোথাও নোটিস প্রদান না করলে তালাক হবে না— এই বিধান উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। সিভিল রিভিশন নম্বর ৬৯৮, ১৯৯২, মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বনাম মোছা. হেলেনা বেগম ও অন্যান্য।
লেখক :  সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
Email: seraj.pramanik@gmail.com

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন