আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সমকামিতা এবং প্রিয়ার প্রিয়বচন

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৯-১১ ০১:২৩:৩৮

শামসুল ইসলাম শামীম :: প্রিয়া ঘোষাল; সুশ্রী, সুহাসিনী, সুকেশিনী, সুশিক্ষিতা তরুণী। আমার কোলকাতার বন্ধু। ধারণা ভুল না হলে কোন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় দায়িত্বশীল। ছবি তোলার পাশাপাশি ঘুরে বেড়ানোও তাঁর অন্যতম শখ হতে পারে। আমার অজ্ঞতার কারনে তার সম্পর্কে পোষন করা ধারনার ব্যত্যয় ঘটলে তা আমার ‘মনোবার্ধক্যে’র কারন!

আমার এই বন্ধুটি সম্প্রতি ফেসবুকে Homosexuality বা সমকামিতা সম্পর্কিত একটি নাতিদীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসটি আমি মগজে ‘প্রিয়ার প্রিয়বচন’ হিসেবে ধারন করেছি। প্রিয়া এই লেখনীতে সমকামিতার প্রতি তার তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে বিষয়টিকে শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সমকামিতা কি এবং কেনো; এমন প্রশ্নের জবাবের পাশাপাশি এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে যেমন ব্যাখা দেয়ার চেষ্টা করেছেন তেমনি খুব সংক্ষেপে তার দেশ সম্পর্কেও তার মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। শিল্পিত শব্দ চয়ন ও চমৎকার বাক্য গঠন প্রমাণ করে প্রিয়া অনেকেরই প্রিয়া লেখিকা, আমার তো বটেই।

প্রিয়া তার লিখার একাংশে লিখেছেন, ‘আমার মতে মনের ব্যাধি তো অবশ্যই। আমার ব্যক্তিগত ধারণা মনের কু প্রভাব থেকে আসে, এবং ঘৃণিত কাজও বটে। বিজ্ঞানের মতে মানুষিক ব্যাধি না হলেও, শারীরিক ব্যাধি তো অবশ্যই। পৃথিবীর কিছু বিচিত্র মানুষের মাঝে বিকৃত মানুষও বসবাস করে ওদের মনের কুপ্রভাব হলো সমকামিতা। সমকামীর আবার বিভিন্ন ভাগ প্রকারভেদ আছে। ওদিকে না যাই। ছোটকরে কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করিঃ সমকামীর শারীরিক ব্যাধি, বিভিন্ন গবেষণা করে দেখা গেছে,, সমকামীর এইডস হয় খুব বেশি বিশ্বের মাত্র ১.৮% সমকামী হলেও এইডস রোগির শতকরা ৬৪জন সমকামী। তবে বিভিন্ন মতে সমকামীদের এইডস হওয়ার কারণ দুজনের একজনের মধ্যে এইডস থাকলে অন্য জনের হবে এবং তাদের থেকে একাধিক জনের হয়ে থাকে। যার প্রভাব আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি।'

এ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রিয়া তার দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘ইন্ডিয়া এটিকে রাস্ট্রিয় ভাবে অনুমতি দিয়েছে। কারণ ইন্ডিয়া হলো, ব্যক্তি স্বাধীন দেশ।কিন্তু আমি এটিতে একদমই সহমত নই।' স্বাধীনচেতা এই তরুণীর বাকসাহসীকতাকে আমি কুর্ণিশ করি।

সমকামিতা কি? সহজ জবাব, সমলিঙ্গের আদিমাচার! কিন্তু কেনো? এ প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু খুব সহজ নয়। এই প্রশ্নের জবাব খুজতে গেলে মানুষের মনোজগত ও দেহজগতের খুব গভীরে বা গোড়ায় যেতে হবে। মানুষের দেহজগত যতোটাই জটিল বা কঠিন তার মনোজগত তার চেয়েও আরো বেশি জটিল এবং কঠিনতর। সহজাত নিয়মে যৌনাচার একটি প্রাকৃতিক আচার। যার চর্চা হয় শরীরে-শরীরে। দু’জন মানব-মানবীর স্বেচ্ছায় পরস্পরের কাছে শারীরিক ও মানসিক কারনে সমর্পিত হলেই তবে এ আচারের সুষ্ঠু চর্চা সম্ভব। তবে শরীরের কাছে শরীর সমর্পিত হওয়ার আগে মনের সামনে মন নীত হলে এ আচারের চর্চা সর্বোত্তম সুমধুর হয়ে উঠে। শারীরিক এই আদিম ক্রিড়া নৈপুণ্য নিয়ে সরাসরি যেমন রচনা আছে, তেমনি বাঙলাসহ পৃথিবীর প্রায় সবক’টি ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এর পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব চোখে পড়ে।
আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের জনক কবি জিওফ্রে চসারের ভালোবাসা বিষয়ক কবিতার দিকে নজর দিলে সেখানেও এই শারীরিক আচার প্রতিভাত হয়, একই ভাবে বিশ্ব সাহিত্যের দিকপাল উইলিয়াম শেকসপিয়র তার অমর লেখনীর মাধ্যমে সর্বপ্রথম রাজনীতির নিয়ামক হিসেবে যৌনতাকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নিয়ে আসেন। তার প্রায় সব নাটকেই প্রধান পাত্র-পাত্রীদের জীবনের উপাখ্যান রচিত হয়েছে যৌনতাকে কেন্দ্র করে।

মহাকবি হোমারকে স্মরণ করা যায়! হোমারের মাধ্যমেই আমরা হেলেন ও ট্রয়ের ধ্বংসের কাহিনী জানতে পারি। ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিস পার্শ্ববর্তী রাজ্যে তার বন্ধুর স্ত্রী হেলেনকে পরকীয়া ফাঁদে ফেলে পালিয়ে মিসর চলে গেলেন। অন্যদিকে এ অপহরণের কারণে গ্রিকদের দ্বারা সম্পূর্ণ ট্রয়নগরী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ষোড়শ শতাব্দীতে রানী প্রথম এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের ইতিহাস ভ্রষ্টতা ও পাপাচারের এক নিকৃষ্ট উদাহরণ। রানী প্রথম এলিজাবেথের বিকৃত যৌনাচার ব্রিটিশ সামাজ্যের পতন ডেকে এনেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টোরিয়াও ছিলেন পরকীয়ায় আসক্ত। জনৈক ভারতীয় মুসলমান মুন্সীর সঙ্গে তার যৌনাচারের কথা কম-বেশি সবাই জানত। একই ভাবে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর পরকীয়ার কারণে ভারতবর্ষ দু’ভাগ হয়েছিলো বলেও জানা যায়।

বিশ্ব সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি; সব মাধ্যমেই প্রেম, প্রনয়, পরিণয়ের মাধ্যমে যৌনাচার বা শারীরিক আচারের প্রকাশ ঘটেছে দুনিয়া জুড়ে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার দিকে নিজর দিলে দেখা যাবে, তখনকার সভ্যতার প্রায় পুরোটুকুই জুড়ে ছিলো আদিম ‘সভ্যতার’ প্রণয় লীলা! একইভাবে সনাতন ধর্মের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সেখানে নর-নারীর প্রণয়-পরিণয়ের ‘সাক্ষ্য-সাবুদ’ মিলানো যায়।

এতো গেলো নর-নারীর প্রণয়-পরিণয়ের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত, যাকে আমরা স্বাভাবিক শারীরিক আচারাদি হিসেবেই মেনে থাকি। কিন্তু, অস্বাভাবিক যৌনাচার বা সমকামিতা কি একেবারেই গোপন বা একেবারেই আধুনিক? ইতিহাসের দু’একটি পাতা উল্টালেই এই সমকামিতার শেকড়ের খোঁজ পাওয়া যায়। দাসপ্রথা এবং তারও আগে মরুচারী বনিক সমাজ ও কারা কয়েদিদের মাঝে গোপনে প্রচলিত সমকামিতার প্রমান পাওয়া যায়। দাসপ্রথা আমলে গৃহকর্তা দাস ক্রয়ের ক্ষেত্রে সর্বদাই অপেক্ষাকৃত কম বয়সী, পুষ্ট এবং সুন্দর শিশু-কিশোর ক্রয়ে আগ্রহী থাকতেন। কারন এসব দাসদের দিয়েই কর্তারা তাঁদের বিকৃত যৌনাচারের তেষ্টা মেঠাতেন। একইভাবে, অন্দরমহলে রাজকুমারী আর রাণী মা’রা কৃত বাঁদি বা দাসীদের দিয়ে তাঁদের অপূর্ণ যৌনাচারের সাধ পূর্ণ করতেন বলেও ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়। মরুচারী বনিক গোষ্টিকে বাণিজ্যের কারনে মাসের পর মাস মরুপথে চলতে হতো। দীর্ঘ মাস বাইরে থাকার কারনে এই বণিক পুরুষেরা তাঁদের যৌনাকাঙ্ক্ষা নিবারনের জন্য নিজেদের মধ্যেই যৌনাচারে লিপ্ত হতো। প্রাচীন মহাভারতেও প্রচলিত এমন সমকামিতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

প্রায় দু’শো বছরেরও আগে চট্টগ্রামের সওদাগর শ্রেণি ও জাহাজের নাবিকদের মাঝে এই প্রবনতা থাকারও প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রান্তিক বাংলা জনপদ বৃহত্তর শ্রীহট্ট বা সিলেটের অধিকতরও নিম্নাঞ্চলের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থদের মধ্যেও এই বিকৃত যৌনাচারের ব্যাপ্তি ঘটে। নিতান্তই হাস্যরসের ছলে প্রচলিত ঘেটুগান সমকামিতার কারনে ব্যাপক প্রসার লাভ করে। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে তৎকালীন জমিদার শ্রেণিসহ অপেক্ষাকৃত অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থকর্তারা বর্ষার পুরো মৌসুমই কিশোর ঘেটুপুত্রদের সাথে যৌনাচারে লিপ্ত থাকতেন, ইতিহাস যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ দেয়।

সমকামিতা সম্পর্কে ধর্ম কি নির্দেশনা দেয়? ইসলামে সমকামিতাকে সম্পূর্ণ হারাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পবিত্র আল কোরআনের ১৪ জায়গায় সমকামিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত লূত (আঃ) এর সম্প্রদায় আপাদমস্তক সমকামিতা বা ব্যভিচারে লিপ্ত ছিলো। এ সময় হযরত লূত তার সম্প্রদায়কে এই বিপথগামীতা থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এ সম্পর্কে আল্লাহতা’লা পবিত্র কোরআনের সুরা লূতে বলেন- ‘এবং লুতকেও পাঠিয়েছিলাম, সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘‘তোমরা এমন অশ্লীল কাজ করছ যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে কেউ করেনি। তোমরা তো কাম-তৃপ্তির জন্য নারী বাদ দিয়ে পুরুষের নিকট গমন কর, তোমরা তো সীমালঙ্গনকারী সম্প্রদায়।’’ (আ‘রাফ; ৮০-৮১)। এ ব্যাপারে বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘তোমরা কাউকে লূত সম্প্রদায়ের কাজ (সমকাম) করতে দেখলে যে করে এবং যার সাথে করা হয় উভয়কে হত্যা কর।’’ (তিরমিযি:১২৭৬) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন- ‘‘আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি দিবেন না, যে কোন পুরুষের সাথে সমাকামিতায় লিপ্ত হয় অথবা কোন মহিলার পিছনের রাস্তা দিয়ে সহবাস করে।’’ (তিরমিযী, সহীহ আল জামে)।

হিন্দুধর্মে দেবদেবীদের মাঝে সমকামি বৈশিষ্টের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন দেবতা চন্দ্রের সৌন্দর্য্যে অনেক দেবতার মুগ্ধ হওয়ার উল্লেখ আছে। দেবদেবীদের বাইরে ভাগীরথের জন্মবৃতান্তে একটি থ্রিসাম গল্পে আছে। সন্তানহীন অবস্থায় অযোধ্যার রাজা দিলীপ মারা যান। থাকেন তার দুই বিধবা স্ত্রী। এই সূর্য্যবংশে বিষ্ণুর অবতার হয়ে আসার কথা। কিন্তু বংশ নির্মুল হলে সেটা কিভাবে সম্ভব! তখন ব্রহ্মা এর প্রতিকার করার জন্য শিবকে পাঠালেন। শিব এসে দুই বিধবাকে বর দিলেন যে তাদের একজনের গর্ভে পুত্র সন্তান জন্মাবে। (‘কৃত্তিবাসী রামায়ণের আদিকাণ্ডের “গঙ্গার জন্ম-বিবরণ ও মর্ত্ত্যলোকে সগরের গঙ্গা আনিতে গমন ও ভগীরথের জন্ম’ পর্ব)। মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ের ৩৬৯ এবং ৩৭০ নম্বর ছত্রে দুজন নারীর মধ্যে সমকামিতা সংঘটিত হলে কি শাস্তি হবে তার উল্লেখ আছে।

এই জঘন্য সমকামিতা নিয়ে সোচ্ছ্বার আজকের আধুনিক বিজ্ঞান। মানুষের প্রতিটি আচরণের সাথে জিন কোন না কোন ভাবে জড়িত। অনেক সময় জিনকে সক্রিয় না নিষ্ক্রিয় করতে পরিবেশের প্রভাব থাকে, এ বিষয়টিকে এপিজেনেটিক্স বলা হয়ে থাকে। সমকামিতার কারন হিসেবে বিজ্ঞানীরা একটি জেনেটিক মার্কারের অস্থিত্ব পেয়েছিলেন অনেক আগেই। প্রায় দুই দশক আগে বিজ্ঞানী হ্যামার X ক্রোমোজমের Xq28 স্থানে একটি মার্কারের অস্থিত্ব পেয়েছেন। যা কিনা ‘গে’ বা ‘লেজবিয়ান’ হওয়ার জন্য দায়ী। হ্যামার তার পরীক্ষায় যে নমুনা নিয়েছিলেন তার প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ ধরণের জিনের অস্থিত্ব পাওয়া যায়। অতি সম্প্রতি ৮ নাম্বার ক্রোমোজমেও এক ধরণের মার্কারের অস্থিত্ব পাওয়া যায়, যা ‘গে’ হওয়ার জন্য দায়ী।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমকামিতা সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধের পাশাপাশি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধর্তব্য।

লেখক: সিলেট ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন