আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ইং

সৈয়দ মহসিন আলী: একজন মানবিক রাজনীতিবিদ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৯-১৪ ১৫:৫২:৪৪

মাহমুদ এইচ খান :: সেদিন আমি গ্রামে ছিলাম। তারই মধ্যে একজন মানুষের বিয়োগের খবর আসলো। সন্ধ্যার সাথে সাথে কর্মস্থল থেকে ফোন। সেই প্রয়াতের বাড়ির অবস্থা জানতে হবে। এবং ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ করতে হবে। আমি একজন ‘খবিশের’ আর বাড়ি থাকা হলোনা। একটু অবাক হয়েই শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। খবিশ বলাতে অনেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন সেই মানুষটির প্রতি। অপসাংবাদিকতার ছড়াছড়িতে আমি একদম স্বাভাবিক ছিলাম তখন। কারণ এই কথাগুলোর জন্য সেই শ্রেণী দায়ী, যেসকল মূলধারার সাংবাদিকদের মাথার উপর দিয়ে অপসাংবাদিকতা উড়ে বেড়ায়, আমরা হায় শব্ধটি বলিনা। বলছিলাম স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত সাবেক সমাজ কল্যানমন্ত্রী একাত্তরের লড়াকো বীর মুক্তিযুদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলীর প্রয়ানের কথা।

বাড়ির ফটকের বাইরে দু’জন মহিলা মুখছাপিয়ে কাঁদছেন আর বলছেনে, আল্লাহ তুমি নেওয়ার লাগী আর মানুষ পাইলায় নানি? ওখন কিতা আর আমরা এই বাড়িত ঢুকতে পারমু নি।ও মামা তুমার মতো কেউ আমরারে আপন ভাববোনি?। কান্নার আওয়াজ আর আর্তনাদ শুনে আমি ভেবেছিলাম মৃতের নিকট আত্মীয় কেউ হয়তো। কিন্তু ঘন অন্ধকার টেলে কাছে এসে দেখতে পেলাম ওদের হাতে চুপসানো ভিক্ষার একেকটি বেগ ঝুলছে। তখন আমার বুঝতে বাকি নেই কাদের জন্য এই আক্ষেপ আর আহাজারী। কষ্টই লাগল, ভীষণ কষ্ট। আমরা সহজ-সরল একজন মহসিন আলীকে নিয়ে কতভাবেই কত কঠিন খেলা খেলেছি। যিনি গণমুখী একজন নেতা শুধু ছিলেননা, সেই সব মানুষদের অভিবাবকও ছিলেন যাদের আমরা দূর হ’ বলে তাড়িয়ে দেই। যিনি আশ্রয়হীন মানুষদের জন্য ঢাকার বাড়িটি উন্মোক্ত রেখেছিলেন। জটিল রোগক্রান্তদের নিজ খরচে চিকিৎসা করাতেন।

উনার মৃত্যুর তিনমাস পর মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল থেকে একটি ফোন আসে আমার কাছে। তখনও আমি সমাজকর্মী হিসেবে বেশ সক্রিয়। হাসপাতালের ্েকেজন স্টাফ জানালেন- এক রোগী আজ ১৫দিন থেকে হাসপাতালে ভর্তি উনার স্বজন বলতে কেহ নেই। একজন হৃদয়বান মানুষ তাকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। কিন্তু চিকিৎসার ব্যয়ভার উনি নেয়ার সক্ষমতা রাখেন না। আমি ও বন্ধু নাদিয়া ছোটে গেলাম এবং ঘটনার বিবরণ শুনে জনৈক ঐ হৃদয়বানকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কোন বিশেষ ব্যাক্তির কাছে গিয়েছিলেন সাহায্যের জন্য? অনেক বড় বড় ব্যক্তিরা আছেন এই শহরে তাদের একেক জন চাইলেই তো একেক জন করে রোগীকে চিকিৎসা করাতে পারে।উত্তরে উনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, এই শহরে একজন মহসিন আলী কি আছে আর! নাকি জন্ম হবে কখনও? গিয়েছিলাম উনার বাড়িতে...। তখন আমি আবার উপলব্ধি করলাম কে ছিলেন এই মহসীন আলী।

আমার দেশের মিডিয়ার বহুবার বহুভাবে মহসিন আলীকে নিয়ে অপব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্যাখ্যা খুঁজেনি উনার এই জনপ্রিয়তার। গণমাধ্যম হতে পারেনি গণমুখী অথচ মহসিন আলী ছিলেন গণমানুষের আকাঙ্খা আর শেষ ভরসা। মিডিয়া কোনদিন লিখেনি কোটিপতির সন্তান মহসিন আলী লাখপতিতে পরিনত হওয়ার গল্প। দেখতে চায়নি মানুষের জন্য তার উদারতাকে। দেখতে চায়নি রাজনৈতিক বৈষম্যে অবিশ্বাসী এক মহসিন আলীকে। মিডিয়া দেখেনি গ্রামের বাড়িতে মহসিন আলী আছেন তা বুঝার উপায় কি ছিলো? মলীন জামা পরা চুল বিগড়ানো গ্রামের কৃষকরাও তার বাড়ির গেইট থেকে বের হচ্ছেন। যে কেউ অনায়াসে তার বাসায় ঢুকছে এবং হাসিমুখে বেরিয়ে আসতেছে। সাধারণের এমন আনাগোনা ছিলো মন্ত্রী যে বাসায় আছেন তার প্রমাণ। তাও মিডিয়া দেখেনি। দেখেছে তার সিগারেটের গভীর চুমুক। সমাজের নানা অনিয়ম নিয়ে অতিষ্ট হয়ে একজন অসাম্প্রদায়িক মহসিন আলীর বেফাঁশ কিছু কথা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম বিতর্ক ছড়িয়েছে শুধু।

সেদিন ইউটিউবে একটি ভিডিও চোখে পড়লো। গান বাংলা টিভির একটি সাক্ষাৎকারে মহসিন আলী। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগী হারানোর স্মৃতিচারণ করে একটি গান ধরলেন।সেই গান যার জন্য একজন সাংস্কৃতিমনা মহসীন আলীকে বিতর্কিত হতে হয়েছিলো। ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা ‘ গানটির দু’চরণ গেইে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। তখন আবার প্রমান হয় আবেগী এই মহসিন আলীকে উনি কে ছিলেন। দেশের জন্য কতটা আবেগ বাসা বেধেছিলো তার হৃদয়ে।

সংগীতের প্রতি উনার এতোটা টান ছিলো হয়তো আমরা তা ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। এই তো গত বছরেরর কথা। একটি সাংস্কুতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে শহরে। শীতের রাতে ভিআইপি সারিতে একা একজন মানুষ ধ্যানমগ্ন হয়ে কুয়াশা মাড়িয়ে গানশুনছেন। কাছে আসতেই স্পষ্ট হলো তিনি সাইফুর রহমান বাবুল ভাই। সেই শুরু হলো মহসিন আলী টপিক নিয়ে আলোচনা। একজন মহসিন আলীয় যেন তার কাছে সব বিষয়ের মূলবস্তু। কথার এক পর্যায়ে বললেন ‘এই গানের অনুষ্ঠান থেকে আমি কি আর উঠে যেতে পারি? মহসিন আলী হলে কি কখনও উঠে যেতেন? জীবদ্ধশায় মহসীন আলীর সবচেয়ে কাছের এই ব্যক্তির এমন কথায় আমাকে ভাবিয়ে তুললো একজন সাংস্কৃতিমনা মহসিন আলীকে নিয়ে।

মহসিন আলী জীবনী আমাদের শিক্ষা দেয় দেশপ্রেম, ভালোবাসা, সহানুভুতির, সহমর্মীতার, আবেগের, সংস্কৃতি প্রেম ও মানবিকতার। সর্বপরি মানুষ মানুষ মানুষের জন্য তা মহসিন আলী আমাদে;র বুঝাতে চেয়েছেন। বাস্তবে এরকম এক ব্যক্তি কি সহজে ধরা দেয়? তবে মহসীন আলীকে আকড়ে ধরতে উনারই সে প্রিয় গান যদি আমরা গাইতে পারি“মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য”তবে তার এই কৃতিত্ব বহাল থেকে যায় আমাদের মাঝে। এই জনপদের আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়াবে অমর এক কৃতির নাম। একজন মানবিক মহসিন আলী এদেশের রাজনীতিবিদদের মানবিকতার আহবান করে সর্বদা। জাতির এই গর্বিত সন্তানের ৩য় প্রয়ান দিবসে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: সংবাদিক ও সংগঠক।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন