আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চলের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৯-২২ ১০:১৩:৪৫

মামুনুর রশীদ :: ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কচুয়াবহর নোয়াটিলা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম দেওয়ান ইসহাক আলী, মাতা দেওয়ান কুলসুম বেগম, তিন ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী হিসেবে তিনি আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ নির্লোভ-নির্মোহ-স্পষ্টবাদী ছিলেন।

তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহকর্মীগনই তার ঘর সংসার, পরিবার সদস্যদের মত সর্বোপরি দেশ ও জনগনই ছিলো তার দিবারাত্রির মহাকাব্য। তিনি প্রতিনিয়ত বিশ্বাস করতেন স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি পারে জনগনের কল্যান বয়ে আনতে।কখনও একজন রাজনৈতিক কর্মী কুসংস্কার,ধর্মান্ধতা কিংবা পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত হতে পারেনা। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের রাজনীতি মানুষকে উদার করে পরমত সহিঞ্চু করে বানায় দেশপ্রেমিক।

৫০ এর দশকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিলেন।বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৬-এর ছয় দফা ও ৬৯-এর গনআন্দোলনে স্বাধীনতার চেতনা সেসময় সিলেটের ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।তিনি মনে করতেন তার দায়বদ্ধতা আছে দেশ-মাটি-মানুষের কাছে।দেশ ও দেশের মানুষের জন্য দায়বদ্ধতা এড়ানোর কোন সুযোগ নেই কারোরই।
সংগ্রামী মানুষের ভেতরের মুক্তির দ্বীপশিখাটি জাগিয়ে তুলতে তাই নিজের আলো অন্যের ভেতর ছড়িয়ে দিতে মাঠে ময়দানে কাজ করেছেন সংগ্রাম মুখর দিনগুলোতে।তাঁর মেধা মননে ছিলো বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক স্বপ্নের সোনার বাংলা।

১৯৭০ সালের গণপরিষদ নির্বাচনে তিনি কর্ণেল ওসমানীর পক্ষে দিনরাত কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে সিলেটে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনায় সিলেটের কৃতিসন্তান মুক্তিবাহিনী প্রধান জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম.এ.জি ওসমানী,প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ,প্রাক্তন মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদগাজী,আওয়ামীলীগ নেতা অ্যাডভোকেট লুৎফুর রহমান,এম.এ রহিম, সৈয়দ আবু নসর অ্যাডভোকেট,আ ন ম শফিকুল হক,ইফতেখার হোসেন শামীম,সিরাজ উদ্দীন আহমদ,আব্দুল খালিক মায়নের একসাথে কাজ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্থানীদের হাতে বন্দী হওয়ার আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন।বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পুলিশের ওয়্যারলেসে জেলায় জেলায় প্রেরণ করা হয়েছিল।সিলেট জেলায় তা পৌছে যায় তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান ফরিদ গাজীর কাছে।ওয়্যারলেস বার্তার সংবাদ পেয়ে ডা. দেওয়ান নুরুল হসেন চঞ্চল আওয়ামীলীগ সহ সিলেটের তৎকালীন সকল রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী ও জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্ততি নিতে বলেন। সিলেটের ছাত্র ও যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংস নিতে সাহস যোগান।হাজার হাজার যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষন ক্যাম্পে প্রেরণ করেন।৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙ্গালী জাতির ৩০ লাখ শহীদদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে হাজার বছরের কাঙ্খিত স্বাধীনতা লাভ করে।

ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল সিলেট জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, যুবলীগ কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের যুব আন্দোলনের নেতা হিসেবে ঘুরে বেড়িয়েছেন পুরো দেশ। তিনি স্বাধীনতা উত্তর সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।জননেতা ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সিলেট জেলায় তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের দেশ গড়ার কাজে নির্লোভভাবে কাজ করে যান।তিনি সিলেটে রিলিফ অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন।তিনি ফুটবল খেলতে ও কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন।

১৯৭৫ সালে বাকসাল গঠনের প্রতিবাদে জেনারেল ওসমানী সংসদ সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করলে সিলেট-৬ (ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) আসনে উপ-নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।১৯৭৫ এর ১৫ ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর সারাদেশে আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে জেল-জুলুম-নির্যাতন।সে সময়ের সামরিক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সিলেটের মাটিতে আওয়ামীলীগকে পুনর্গঠিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যান তিনি।স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১০ দলীয় ঐক্য নেতৃত্বে দূর্বার আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলেন সিলেটের মাটিতে।

১০৭৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে বিএনপির জয়জয়কার হলেও ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ইনামুল হক চৌধুরী (বীর প্রতীক) ৩ হাজার ৫শত ৭ ভোটের ব্যাবধানে বিএনপি প্রার্থী ফতেহ ইউনুস খাঁনকে হারিয়ে সংসদ নির্বাচিত হন।আওয়ামীলীগ প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল জানবাজি রেখে কাজ করেন সে সময়।

১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী জেনারেল এম এ জি ওসমানীর পক্ষে ও ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের পক্ষে কাজ করে যান ডা. চঞ্চল।১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের পক্ষে সিলেটে নেতৃত্ব দেন ডা. নুরুল হোসেন চঞ্চল।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল ১৯৮৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।বর্তমান প্রজন্ম জননেতা মরহুম ডা. নুরুল হোসেন চঞ্চলকে চিনেনা।ডা. দেওয়ান নুরুল হসেন চঞ্চলের মতো সংগঠক যোদ্ধা, রাজনীতিবিদকে জানা অবশ্যই প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের জন্য।তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সৈনিক হিসেবে আমৃত্যু কাজ কাজ করে গেছেন।আওয়ামীলীগ সংগঠক ছিলো তাঁর ধ্যান,জ্ঞান,সাধনা।আমৃত্যু তিনি সংগঠনের সঙ্গে ছিলেন, এক মুহূর্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে জলাঞ্জলি দেননি বরং তিলে তিলে একে ধারন করেছেন।সিলেটের রাজনৈতিক,সামাজিক,সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তাঁর দীর্ঘ উপস্থিতি এখানকার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডকে উর্বর ও বিকশিত করেছেন।দেশ,মানুষ ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিত প্রয়াত ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চলের মতো নেতার মৃত্যু নেই।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,রাজনীতিবিদ,চিকিৎসক,প্রভৃতি পরিচয়ে প্রয়াত ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল অমর হয়ে থাকবেন চিরকাল।৩৪ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।


লেখকঃ সাংবাদিক
দপ্তর সম্পাদক ফেঞ্চুগঞ্জ প্রেসক্লাব

সিলেটভিউ২৪ডটকম/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮/এফইউ/আআ

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন