Sylhet View 24 PRINT

নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৯-২৫ ০১:১০:১৯

আল-আমিন :: বাংলা সব ঋতুই আমার পছন্দের। শরৎটা একটু আলাদা। মানুষের মনের আকাশের সাথে শরতের আকাশের আবহাওয়ায় প্রকৃতির অসাধারণ মিল খুজে পাই। কালো মেঘ নতুবা নীল আকাশ,এই রৌদ্র নতুবা ঝিরিঝিরি হাওয়ায় নৃত্যের তালে বৃষ্টি আমার ভালোলাগার। হেমন্ত আগমনের হিম শীতল হাওয়া যখন বয়ে চলে বিস্তর কাশবনের উপর দিয়ে তখন ইচ্ছে করে দুই হাত দিয়ে কাশফুলের পরশ পেয়ে অবাধ ছুটে চলতে। আকাশের নীল আর সাদা মেঘের সংমিশ্রণ যখন নীল ঢেউয়ের তালে তালে উদ্বেলিত হয় তখন শীতল হাওয়া কাশফুলের মৃদু ছন্দ তালে ঢেউ খেলে যায় আমার হৃদয়।
আমি বেখেয়ালেই আনমনে চেয়ে দেখি এই দৃশ্য। আমি গ্রাম দেখেছি। দেখেছি চিলাই নদীর ভাদ্র মাসের নৌকা বাধা খেয়াঘাট। আটিবাধা আখ বোঝাই নৌকার মাঝির সলাৎ সলাৎ বৈঠা দেওয়া। নদীর পাশে দিয়ে বয়ে যাওয়া কাশফুল আর বিকেলের পখর রৌদ্রের আলোয়ে শরতের সবুজ ধান খেতের মাঠ আর হিমেল বাতাসে কাশফুলের ঢেউ। দেখেছি গ্রামের ছেলে মেয়েরা কাশবনে ছুটে বেড়ানোর দৃশ্য।
ওদের আনন্দ আমি কাছ থেকে দেখেছি। ওদের অবাধ ছুটে চলায় দুই একটা কাশফুল থুবড়ে পড়ার দৃশ্য এখনো ভুলিনি। শরতের এই সৌন্দর্য সবার। কিশোর-কিশোরীরা চার দেয়ালে বন্দি না থেকে ছুটে চলতে চায় আনন্দে। মিশে যেতে চায় কাশফুল বনের অকৃত্রিম হাসিতে। এ হাসি অমূল্য,প্রিয়তমার ভালোবাসার মতো।

আমি শরৎ প্রকৃতির মিষ্টি গন্ধে আনন্দিত হই। অভিমান করা রিমঝিম বৃষ্টির আওয়াজ বারান্দায় এসে উপভোগ করতে আমারও ভালো লাগে। এই বৃষ্টির ফোটায় অবলীলায় ঝরে অজস্র শিউলি ফুল। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পরশ নিয়ে, নগ্ন হাতে কিশোরীর ফুল কুড়ানোর দৃশ্য অসাধারণ। শরতের অনিন্দ্য-সুন্দর-সুভাসিত শিউলিমালা সবার জন্য। খোপায় গুজে নিও হে প্রিয়তমা, গুজে দিও হে প্রিয়তম। পবিত্র হাতে অপার ভালোবাসা মিশিয়ে একগুচ্ছ কাশফুল শিহরিত হোক ভালোবাসার।

হুম! কাশফুলের অধীর শিহরণ নিয়ে আর শিউলির সুমিষ্ট সুবাস নিয়ে শরৎ বাংলার দোর গোড়ায়। বসন্ত যদি ঋতুরাজ হয় আর হেমন্ত যদি ঋতুরানী হয়, আমার কাছে শরতের নাম ঋতুর রাজকন্যা। যে রাজকন্যার পরনে থাকবে কাশফুলের শাড়ির আবরণ।এলোকেশে সৌন্দর্য ছড়াবে শিউলিমালা ! আমি বারবার দেখব সেই রাজকন্যাকে। আর মুগ্ধতা নিয়ে ভেবে নিবো প্রিয়তমার কথা।

বাঙলা সাহিত্যে কবি কালিদাস শরৎকে নিয়ে লিখেছেন- "প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।"
কবি ঋতুসংহার শরৎকাল বিষয়ে লিখেছেন- "কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ,অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।"

শরতের সাথে প্রকৃতি ও নারীর এই উপমা দেখে অভিভূত করে। বাংলা সাহিত্যের আরেকজন কবি চণ্ডীদাস তার কবিতায় বলেন-"ভাদর মাঁসে অহোনিশি আন্ধকারে শিখি শিয়াল আর ডাহুক করে কোলাহল।"

বাংলাসাহিত্যের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ নিয়ে কবিতা-গান রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। শরৎকে করেছেন সৌন্দর্যময়। তিনি লিখেছেন-"শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি। শরৎ, তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে-বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।"

তিনি শরতের বিকেলের নীল আকাশে মেঘেদের দলবেঁধে ছুটে বেড়ানোকে শিমুল তুলার সাথে উপমা দিয়ে লিখেছেন- "অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া।"

এছাড়াও কবির শরৎ নিয়ে রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে আমার প্রিয় পঙ্ক্তিগুলো - "আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা,নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।"

"ওগো শেফালি বনের মনের কামনা, শিউলি সুরভিত রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে।"
"শরৎ প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে,হৃদয় কুঞ্জবনে মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা।"
রবীন্দ্রনাথের হাতেই শরৎকালীন প্রকৃতির অমেয় রূপের সৌন্দর্যময় অসাধারণ ভাবে ফুটে ওঠেছে।

ভাদ্র-আশ্বিন জুড়ে শরতের রাজত্ব। বর্ষার শেষে প্রকৃতি "নববধূ" সাজে সজ্জিত হয়ে উঠে। তরুন -তরুনীর মাঝে আনন্দের ঝর্ণা ছড়িয়ে দেয় এই ঋতু। শরতের নিজস্বতা মিশে রয়েছে কাশফুলের সঙ্গে। গাছে গাছে ফুটে দোলনচাঁপা, বেলি, শিউলি,টগর, মল্লিকা, মাধবী, কামিনী, নয়নতারা, ধুতরা সহ নানা জাতের ফুল। ফুলের সুভাসে বিমোহিত হয়ে ওঠে বাংলার প্রকৃতি। ঋতুরাজ বসন্তের অভাব পূরনের সৌন্দর্য মিলাতে হাজির হয় ঋতুকন্যা শরৎ। আকাশে সাদা মেঘের পালক উড়ে বেড়ানো প্রকৃতির এমন রূপের বাহারে প্রবল আবেগ আর উৎসাহ এসে জমা হয় কবি-সাহিত্যিকদের মনোজগতে। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে প্রকৃতির সাথে মিশে রচনা করে সাহিত্যজগৎ।

শরৎ বন্দনায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অবদানও কম নয়। তিনি অসংখ্য গান ও কবিতায় শরতে বাংলার প্রকৃতি তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন -"শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ,এসো শারদ প্রাতের পথিক।" সহ অনেক গান শরৎ প্রকৃতির রূপ নিয়ে রচনা করেছেন। শরতের অসম্ভব চিত্ররূপময়তা ফুটে তুলেছেন এসব রচনায়।

"এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে, এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে।"

বাঙলার প্রকৃতিতে শরৎ আবিস্কার করে নদীর তীরে কাশফুলের সাদা হাসির প্লাবন। মাঠে মাঠে সবুজের হৃদয় মাতানো মেলা। নদীর তীরে কাশফুলের কমল-ধবল রূপে জ্যোসনা-প্লাবিত রাতে জাগে স্বপ্নের শিহরণ। অনুপম রূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত শরৎ ঋতু। শরতের মধ্যেই বাংলাদেশের হৃদয়ের সৌন্দর্যরূপ স্পর্শ মেলে।

শরতের মন প্রকৃতির মতো রোদ-বৃষ্টির মধ্যে অভিমানের মেঘ জমে। এই বৃষ্টি! আবার কখনো হয়ে ওঠে রৌদ্রকরোজ্জ্বল। এজন্য কবি জসীমউদ্দীন শরতকে তুলনা করেছেন "বিরহী নারী" সাথে।

তিনি বলেছেন-"বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস।"

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাস তার রূপসী বাংলা’ কাব্যের "এখানে আকাশ নীল" কবিতায় বলেন-"এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল ফুটে থাকে হিম শাদা-রং তার আশরতের এ সময় মাঠ জুড়ে থাকে সবুজ ধানের সমারোহ। ধানের কচি পাতায় জমা হওয়া শিশিরের ওপর প্রভাতের তরুণ আলো মুক্তার মতো ছড়ায়। তখন দেশের কৃষকরা নবান্নের আশায় দিন গোনে। শরৎতের জল-ঝরা শাদা শাদা মেঘ উড়ে যায়।"

শরৎ যেমন প্রকৃতিকে অপরূপ রূপে সাজিয়ে যায় তেমনি সংস্কৃতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন করে মানুষের ক্লান্তি মোচনের ক্ষেত্র তৈরি করে। অবসাদগ্রস্ত মনে নতুন প্রেরণার সঞ্চার করে। শরতের কাশবন আর জ্যোৎস্নায় প্রিয়জন সান্নিধ্যে হারিয়ে যাওয়ার বাসনা প্রবল হয়।

লেখক: কথা সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.