Sylhet View 24 PRINT

'জীবনের গল্প'

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১০-২২ ০০:৩৬:০৭

ডা. সহেলী আহমেদ সুইটি :: 'নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস'— সত্যিই তাই। আমরা মানুষ প্রতিদিন সুখের সন্ধানে ছুটে চলেছি অবিরত। কিন্তু প্রকৃত সুখ কী সে সেটি হয়তো বেশির ভাগ মানুষই উপলব্ধি করতে পারেন না।

প্রবাসে বসে প্রতিদিন বাংলাদেশকে মিস করছি, হয়তো জীবনের প্রয়োজনে কিংবা উচ্চতর প্রশিক্ষণের প্রত্যাশাতেই নিজেকে আরও বেশি যোগ্য থেকে যোগ্যতর করার জন্য দেশকে প্রবাসের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায় অন্যদের মতো আমার স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখাটা ব্যতিক্রম কিছু না। বাংলাদেশকে আজীবন ভালোবাসি, ভালোবাসবো- এ প্রত্যয় জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। আজকের লেখাটা লিখব একটু ভিন্ন রকমভাবে।

জীবনের প্রয়োজনে গবেষণার পাশাপাশি সুযোগ হয়েছে কোনো এক প্রবাসের বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা কিছু দুঃখী মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার। প্রবাস জীবনের যান্ত্রিকতায় নিজেকে অনেক সময় দুঃখী মনে হতো। কিন্তু যখন আমার থেকেও অনেক বেশি দুঃখী কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায় তখন বোঝা যায় সত্যিকার অর্থে দুঃখ কী কিংবা দুখী কারা? আমরা ভাবি বাংলাদেশের মানুষই সবচেয়ে কষ্ট করে কিন্তু প্রবাসে বসে হলফ করে বলতে পারি প্রবাসের জীবন কতটা কষ্টেও, কতটা যন্ত্রণার। বাংলাদেশে আমরা অনেক ভালো আছি। আশা করি ভবিষ্যতেও ভালো থাকব।

'জীবনের গল্প'-হুম... সত্যিই তাই তবে সত্যিকার অর্থে কারও সত্যি নাম ব্যবহার করব না। যদিও গল্পটি লিখছি প্রত্যেকের সম্মতি নিয়ে। এখন এ মুহূর্তে যার গল্প শেয়ার করছি ধরে নিলাম তার নাম এলিজাবেথ, না রানী এলিজাবেথ না। তার বয়স ৬৫ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। প্রথম যখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় প্রায়ই দেখতাম তার অভিযোগ অনুযোগের কমতি নেই। অন্যদের সঙ্গে প্রায়ই মতবিরোধ। কিছু অভিযোগ অনুযোগ করতে করতেই কান্নাকাটি শুরু করত। খুব মায়া হতো তাকে দেখে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি, প্রায়ই মনে পড়ে যেত তাদের কথা।

বিশেষ করে আব্বুকে প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ত। যাই হোক কেন জানি এলিজাবেথ আমাকে খুব পছন্দ করলেন এবং বললেন তুমি আমাকে একটু সময় দেবে? আমিও আগ্রহী হলাম। এলিজাবেথ আমার সামনে দাঁড়িয়ে একটি চেয়ার এগিয়ে নিয়ে নিজেই বসল, তারপর শুরু করল তার জীবনের গল্প। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। মাত্র চার মাসের বিবাহিত জীবনে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন তিনি।

এরপর বাচ্চার বয়স পাঁচ বছর হলে স্কুলে একদিন বাচ্চাটি গেলে তাকে প্রতিনিয়ত ভালো টিফিন, পর্যাপ্ত টিফিন না দেওয়ায় এবং অবহেলার কারণে 'চাইল্ড এইড সোসাইটি' মার কাছ থেকে বাচ্চাকে নিয়ে আলাদা 'ফোস্টার প্যারেন্ট'- এর কাছে লালন পালন করতে দেয়।

মনে মনে ভাবলাম হায়রে গাড়িতে বসে কতদিনই কত অবুঝ শিশুকে দেখেছি মনে মনে কষ্ট পেয়েছি কিন্তু কতটুকুই বা করতে পেরেছি মানুষের জন্য। কারও প্রশ্রয়ে না থেকে অন্তত যে যার অবস্থান থেকে সাধ্যমতো কিছুই করতে পারলেও সবাই মিলে দেশকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। অঙ্গীকার করলাম, দেশে না থাকলেও দেশের জন্য নিজে কিছু করার চেষ্টা করব, অন্যকেও উত্সাহিত করব কাউকে দোষারোপ না করে সমাজের জন্য, দেশের জন্য নিজের অবস্থানে থেকে মানুষের জন্য ভালো কিছু করুন।

এবার চলে আসি গল্পে। এলিজাবেথ মেয়েকে ছাড়া এক বছর থাকলে তার জীবনের একটি অস্বাভাবিক অবস্থা চলে আসে। মেয়েকে ফিরে পায় এক বছর পর। এরপর ভালোই চলছিল তার জীবন কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তির নির্মম পরিহাসে মেয়েটি সাত বছর বয়সে মারা যায়। যা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না কোন মা, আর তাই তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বহু বছর পর তার দ্বিতীয় বিয়ে হয় একটি ছেলের সঙ্গে।

কিন্তু নিয়তি প্রতিনিয়ত খেলছিল তার সঙ্গে। তার স্বামী মারা যায়। এককভাবে সন্তানকে লালন করে বড় করে প্রতিষ্ঠিত করে সে। হায়রে জীবন সেই সন্তান একদিন বৃদ্ধা মাকে রেখে যায় বৃদ্ধাশ্রমে। তার চোখের পানিতে লেখা ছিল তার জীবনের গল্প। শুধু দেশ বা বিদেশে নয় জীবন এতই যান্ত্রিক ভালোবাসার বন্ধন মানুষকে কাছে টানে না, সবাই সুখের সন্ধানে ছুটছি আমরা। এলিজাবেথ চায় কেউ যেন তাকে সময় দেবে, তাকে গল্প শোনাবে, তাকে সাহায্য করবে, তাকে ঘুম পাড়াবে। আসলে বয়সের পাশাপাশি মানুষের চাই ভালোবাসা। আপন মানুষের নিবিড় সান্নিধ্য।

'জীবনের গল্প' লেখা জীবনের প্রয়োজনে লিখলাম। আসুন যাদের বাবা-মা বা বয়োজ্যেষ্ঠ আপন মানুষদের সময় চায় আমরা তাদের সময় বরাদ্দ করি, ভালোবাসি, আপন করে নেই। তাদের অভিযোগ অনুযোগগুলোকে মূল্য দিয়ে তাদের দিকে ভালোবাসার শ্রদ্ধা নিবিড় সান্নিধ্যের হাতটি বাড়িয়ে দেই। দেশেই থাকি আর প্রবাসেই থাকি 'জীবনের গল্প' থেকে প্রথম পর্বে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বলতে চাই সবাই ভালো থাকি, সবাইকে ভালো রাখি।

লেখক : কিডনি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ,
পোস্ট ডক্টোরোল ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ফেলো,
ডিরেক্সেল ইউনিভার্সিটি।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.