আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

রহস্যময় জগৎ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১১-০১ ০০:২৫:৫৬

আবু তাহের খোকন :: আজ থেকে ১৪০ বছর আগের এক রাত। ১৩ বছর বয়সী ভাতিজা কুইন্টসহ চারজন সঙ্গী নিয়ে ভার্জিনিয়ার লুরে শহরের পশ্চিমে এক পাহাড়ের পাদদেশে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে রহস্যের গুহার সন্ধানে অভিযানে নেমেছিলেন এন্ড্রিউ ক্যাম্পবেল। সে অভিযানে গুহার রহস্যের সন্ধানে সহায়তা করেন বেনটন স্টেবিনস নামে স্থানীয় এক ফটোগ্রাফার। প্রথম গুহায় প্রবেশপথ খুঁজে বের করতে হবে তাদের। পাহাড়ের একটি স্থানে খনন শুরু করল তারা। চার ঘণ্টা খোঁড়াখুঁড়ি করে কিছু পাথর সরানোর পর দেখতে পেল সুড়ঙ্গপথ। সামনে ফাঁপার মতো কিছু একটা বোঝা যাচ্ছে। ক্যাম্পবেল ও কুইন্ট দড়ির সাহায্যে একটু নিচে নামল। সেখানে যা দেখল তা অবিশ্বাস্য।

বিশাল গুহা। রহস্যে ভরা গুহা। একটি নয়, দুটি নয়, অসংখ্য। আর সেই গুহায় অপরূপ দর্শন অসংখ্য স্টেলেকটাইট ও স্টেলেগমাইট। স্টেলেকটাইট হচ্ছে প্রকৃতি থেকে হাজার হাজার বছরের বিন্দু বিন্দু জল ও খনিজ পদার্থের সংমিশ্রণে জমাটবদ্ধ হয়ে গুহার উপরিভাগে সৃষ্ট চুনদণ্ড ও স্টেলেগমাইট হচ্ছে গুহার তলদেশে জমা চুনদণ্ড। এর প্রতি কিউবিক ইঞ্চি তৈরি হতে পানির ধারার ওপর নির্ভর করে ১২০ থেকে ৩০০ বছর সময় লাগে। ক্যাম্পবেল ও কুইন্টের সেদিনের সেই আবিষ্কারই ‘লুরে ক্যাভার্ন’।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থানসমূহের একটি। ওয়াশিংটনে কয়েকবার যাওয়া হয়েছে,  হোয়াইট হাউস ওয়াশিংটন মনুমেন্ট বা স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামগুলো দেখে চলে এসেছি। সময়ের অভাবে দূরে কোথাও তেমন একটা যাওয়া হয়নি। লুরে ক্যাভার্ন বা শ্যানোনডোয়াহ যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবার সময় ছিল আমদের বন্ধু উজ্জ্বল ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন লুরে ক্যাভার্ন দেখাবেন। আমি সাইফুলের পরিবার, আমাদের নিয়ে উজ্জ্বল ভাই রওনা দিলেন। রাস্তার দুই পাশে চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য।

ঘণ্টা আড়াইয়ের মতো ড্রাইভের পর বহুল প্রত্যাশিত লুরে ক্যাভার্নের গেট। জনপ্রতি টিকিট ২৫ ডলার। সবার মতো লাইন ধরে টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ৩০/৪০ জনের দল বেঁধে এক একজন গাইড গুহার ভিতরে দর্শনার্থীদের নিয়ে যাচ্ছে লেকচার দিতে দিতে। গাইড মাঝবয়সী এক শ্বেতাঙ্গিনী। গাইডের কথা শোনার থেকে সবাই যে যার মতো ছবি তোলায় ব্যস্ত। সমতল থেকে গুহায় ঢোকার পর ১০ তলার সমান নিচে নামলাম সিঁড়ি বেয়ে। অসম্ভব সুন্দর সব নিদর্শন। চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে বাড়তি যা যুক্ত হয়েছ তা হচ্ছে অপূর্ব লাইটিং। গুহার মাঝখান দিয়ে ৩/৪ ফুট চওড়া করে হাঁটার রাস্তা। সেখান দিয়েই দর্শনার্থীদের হাঁটতে হয়।

ছেলে বেলায় বইয়ে কত গুহার কথা পড়েছি। কত গুহার ছবি দেখেছি। সিনেমা দেখেছি গুহা নিয়ে। অথচ সেসব কোনোটির সঙ্গে মিল নেই এই লুরে ক্যাভার্নের। কী আশ্চর্য সুন্দর এই গুহা। হাজার হাজার বছর ধরে পানি চুঁইয়ে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে কী অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক স্থাপত্য। গুহায় ঢুকতেই প্রথম  স্টেলেগমাইটটির নাম ওয়াশিংটন; একজোড়া পিলারসদৃশ  স্টেলেগমাইট যার সঙ্গে স্টেলেকটাইট মিলে গিয়ে একাকার। এই জায়গাটি নিয়ে রয়েছে একটি কিংবদন্তি। এখানে অনেকে বিয়ে করতে আসেন। কারণ এখানে বিয়ে করলে নাকি বিয়ে এই পিলারের মতো মজবুত হয়।

সামনেই দেখা মিলল একটি সরোবর। যেখানে লোকজন মানত করে পয়সা ছুড়ে গুহা মালিকের সম্পদ বাড়িয়ে চলছে। গুহার এক জায়গায় রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের তালিকা। গুহার তাপমাত্রা ছিল এদিন ৬৫/৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো। দারুণ আরামদায়ক। গুহায় যে কতরকম স্টেলেগমাইট আর  স্টেলেকটাইট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তার হিসাব নেই। গাইড একটি স্থানে থেমে বললেন, এই গুহার বিভিন্ন স্থানে মানুষের হাড়গোড় পাওয়া গেছে। একটি মেয়ের মরদেহও নাকি পাওয়া যায়। মেয়েটিকে সম্ভবত তার আত্মীয়-স্বজন কবর দিয়ে চলে যায়; পরে মাটি ধসে পড়লে সে সরাসরি গুহায় পড়ে যায়। রেড ইন্ডিয়ান মেয়েটির সম্মানে ওরা স্থানটির নাম দিয়েছে দ্য প্রিন্সেস চেম্বার। জীবিত থাকলে সে এই সম্মান পেত কিনা কে জানে?

একটি জায়গায় চুঁইয়ে পড়া পানি জমা হয়ে একটি সরোবরের মতো সৃষ্টি করেছে। ওখানে স্টেলেকটাইটের ছায়া এত স্পষ্ট দেখা যায় যে, মনে হয় সব পানির নিচে স্টেলেগমাইট! অসাধারণ সুন্দর এই প্রতিচ্ছায়া কাচের ওপর প্রতিফলনের চেয়েও বাস্তব! এক স্টেলেকটাইট অন্তত তিনতলার সমান উঁচু। এক জায়গায় কর্মচারীরা ভুলে দুটি মিনি সাইজের স্টেলেগমাইট ভেঙে ফেলেছিল। ফলে দেখার সুযোগ হয় এই পাথরগুলোর ভিতরটা দেখতে কেমন। দেখতে তা হুবহু ডিমভাজির মতো, মধ্যখানে একটা খনিজ কুসুম আর বাইরে ডিমের শ্বেতাংশের মতো জমা হওয়া পাথর।

পর্যটকদের সুবিধা ও আকর্ষণ করা মতো সব ব্যবস্থাই রয়েছে এখানে। তিন একর জায়গায় সমতল থেকে শ’দেড়েক ফুট মাটির নিচ পর্যন্ত এক বিস্ময়কর রহস্যময় জগৎ এই লুরে ক্যাভার্নের।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন