আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং

দেবী ও জয়া

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১১-০২ ০০:৫২:২৮

ইমদাদুল হক মিলন :: আলমগীর রহমান আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু। সেই চুয়াত্তর সাল থেকে আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব। গেন্ডারিয়ার রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি তাদের। পাটুয়াটুলীতে বাংলাদেশ বুক করপোরেশন নামে বিশাল প্রকাশনা সংস্থা। স্বাধীনতার বহু আগ থেকেই আলমগীর ভাইয়ের বাবা প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তখন নাম ছিল পাকিস্তান বুক করপোরেশন। স্বাধীনতার পর আলমগীর ভাইয়ের বড় ভাইও যুক্ত হয়েছেন সেই ব্যবসায়। কিন্তু আলমগীর ভাই চলে  গেলেন অন্য লাইনে। চমৎকার ছোট গল্প লেখেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স মাস্টার্স করে ঢুকেছেন সাংবাদিকতার জগতে।

ফজলুল হক মণি সম্পাদিত ‘বাংলার বাণী’-তে ঢুকেছিলেন। পরে ওই গ্রুপেরই সাপ্তাহিক সিনেমা পত্রিকাতে কাজ করতেন। ‘প্রান্তরে অশ্বারোহী’ নামে অসামান্য একটি ছোটগল্প লিখেছিলেন কামাল বিন মাহতাব সম্পাদিত ছোটগল্প পত্রিকায়। আলমগীর ভাই তারপর যুক্ত হয়েছিলেন শাহাদৎ চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য়। সেই সময়টার কথা আমার খুব মনে পড়ে। কত জ্বালাতন যে আলমগীর ভাইকে আমি করেছি! কত রাত থেকেছি আলমগীর ভাইদের বাড়িতে। কত খাইয়েছেন তিনি আমাকে, কত যত্ন করেছেন। একজীবনে সেই ঋণ কখনো শোধ করা যাবে না। আপাতদৃষ্টিতে খুবই রাগী এবং ঠোঁটকাটা মানুষ আলমগীর ভাই। যা বিশ্বাস করেন সরাসরি মুখের ওপর বলে দেবেন। তাতে আপনি খুশি হন কিংবা বেজার আলমীর ভাই ভাববেনও না। কিন্তু মনটা তাঁর শরীরের তুলনায় হাজার গুণ বড়। একটু মোটা ধাঁচের আলমগীর ভাইয়ের হৃদয় অনেকখানি দেখেছি আমি। তাঁর তুলনা তিনি নিজে। পরবর্তীকালে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গেও গভীর বন্ধুত্ব হয় আলমগীর ভাইয়ের। ‘দখিন হাওয়া’য় হুমায়ূন আহমেদ আর অন্যপ্রকাশের মাজহারের ফ্ল্যাট পাশাপাশি। হুমায়ূন ভাইয়ের ঠিক নিচের ফ্ল্যাটই আলমগীর ভাইয়ের। এই ফ্ল্যাটে কতদিন কতকিছু রান্না করে আমাদের খাইয়েছেন আলমগীর ভাই। কী অসামান্য আনন্দে ভরে থাকত আমাদের তখনকার প্রতিটি সন্ধ্যা।

হুমায়ূন ভাই চলে গেলেন, আমাদের সেই আনন্দের জীবনও শেষ হয়ে গেল। হুমায়ূন ভাই চলে যাওয়ার পর দখিন হাওয়ায় আমি আর যাই না। বইমেলা ছাড়া আলমগীর ভাই কিংবা মাজহারের সঙ্গে দেখা বলতে গেলে হয়ই না। দু-চার মাসে এক আধবার টেলিফোনে কথা হয়। হুমায়ূন আহমেদ তখন ধা ধা করে জনপ্রিয় হচ্ছেন। আলমগীর ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন প্রকাশনা সংস্থা করবেন। হুমায়ূন আহমেদের বই দিয়ে যাত্রা শুরু করবেন। চুরাশি সালের শেষদিক কিংবা পঁচাশির শুরু। মুনতাসীর মামুনের বাসায় বসা হলো এক বিকালে। মামুন ভাই থাকেন মগবাজারের ইস্পাহানি কলোনিতে। একতলা বিল্ডিংয়ের সামনে লন বাগান গাছপালা ঘেরা ভারি সুন্দর পরিবেশ। বিকালবেলা সেই বাসায় উপস্থিত হয়েছেন বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদৎ চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ, শাহরিয়ার কবির, আলমগীর রহমান এবং আমি। মুনতাসীর মামুন তো আছেনই। সেদিনই প্রকাশনার পরিকল্পনা জানালেন আলমগীর ভাই। প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিক হলো ‘অবসর’।

কে কে লিখবেন সেসব নিয়ে শুরু হলো আলোচনা। বেশ কয়েকজনের নাম লিস্ট করা হলো। তবে প্রথম বইটা লিখবেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁকে দু হাজার টাকা অ্যাডভান্স দেওয়া হলো। ছোট্ট একটা স্লিপে সই করে টাকাটা নিলেন তিনি। তারপর উদাস হয়ে সিগ্রেট টানতে লাগলেন। আমি তীক্ষ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম মাথায় গল্প খেলা করছে। বাড়ি গিয়েই লিখতে শুরু করলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই লিখে ফেললেন অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে আশ্চর্য এক উপন্যাস ‘দেবী’। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের কলমের ডগা থেকে বাংলা সাহিত্যে এসে অবতীর্ণ হলো এক অবিস্মরণীয় চরিত্র মিসির আলি। ‘দেবী’ প্রকাশিত হলো বৈশাখ-১৩৯২। এপ্রিল ১৯৮৫। ক্রাউন সাইজের পেপার ব্যাকের দাম ১৩ টাকা, হার্ড বাইন্ডিং ২৩ টাকা। প্রচ্ছদ আঁকলেন বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদৎ চৌধুরী। প্রকাশের পর শুরু হয়ে গেল এক হুলস্থূল কাণ্ড। মাস শেষ হওয়ার আগেই এডিশন শেষ। একের পর এক এডিশন হতে লাগল। এ পর্যন্ত কতগুলো সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে দেবীর সেই খবর নেওয়া হয়নি। মিসির আলি নিয়ে দ্বিতীয় বই ছিল ‘নিশিথিনী’। আলমগীর ভাইই ছাপলেন। চট করেই দাঁড়িয়ে গেল ‘অবসর’। অবসরের সঙ্গে পরে আলমগীর ভাই আরও একটি প্রতিষ্ঠান করলেন ‘প্রতীক’। তার পুত্রের নামে। দুটো প্রতিষ্ঠানই এখন বাংলাদেশের প্রথম সারির প্রকাশন সংস্থা। হুমায়ূন আহমেদের অনেক বই করেছেন। খণ্ডে খণ্ডে ছেপেছেন তাঁর উপন্যাস সমগ্র। দেবীর মঞ্চনাট্যরূপ বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে। উপন্যাস প্রকাশের ৩৩ বছর পর দেবীর চলচ্চিত্রায়ণ হলো। উদেযাগ নিলেন জয়া আহসান।

‘দেবী’ লেখা হওয়ার ঠিক দশ বছর পর জয়ার সঙ্গে আমার পরিচয়। পঁচানব্বই সালের একদিন জয়া আমার গেন্ডারিয়ার বাসায় গিয়েছিলেন। আমার দুই মেয়েই তখন খুব ছোট। মেয়ে দুটি এবং তাদের মা জয়াকে দেখে মুগ্ধ। এত সুন্দর মেয়ে? কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে আমার ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। মাত্র হাতে এসেছে বইটি। জয়াকে এক কপি দিয়েছিলাম। তারপর জয়া আমার বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছেন। আমরা ছয়বন্ধু মিলে একটা প্রতিষ্ঠান করেছিলাম ‘সিক্সথ সেন্স’। সেই ব্যানারে টেলিফিল্ম লিখলাম আমি। ‘ছবির মতো মেয়ে।’ পরিচালক আফজাল হোসেন, ক্যামেরায় সালাউদ্দিন লাভলু। অভিনয় করছেন আফজাল হোসেন নিজে, মৌসুমী, জয়া, শহীদুজ্জামান সেলিম আর চৈতি নামের একটি মেয়ে। চিটাগাং আর কক্সবাজারে শুটিং। বিরাট বহর নিয়ে শুটিংয়ে চলে গেলাম আমরা। সেখানে গিয়ে আমি পড়লাম জ্বরে। জয়াও আক্রান্ত হলেন পেটের পীড়ায়। ডাক্তার হাসপাতাল ছোটাছুটি। তারপরও কাজটি শেষ করে ফিরে এসেছিলাম সবাই। সেবারই লক্ষ্য করেছিলাম কতটা আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে অভিনয়টা করেন জয়া। বিচ্ছিন্নভাবে আমার কয়েকটি নাটক করলেন।

‘আমাদের ছোট নদী’ নামে তেরো পর্বের একটি ধারাবাহিক করলেন। দিনে দিনে টেলিভিশন পর্দায় জনপ্রিয়তম মুখ হয়ে উঠলেন জয়া। অসাধারণ কিছু নাটক করলেন। ঢুকলেন চলচ্চিত্র জগতে। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলা জয় করে ফেললেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের নাম্বার ওয়ান নায়িকা তিনি। জয়ার কথা ভাবলেই তাঁকে নিয়ে আমি খুব গৌরব বোধ করি। আমাদের জয়া দেখতে দেখতে কত উচ্চস্তরে পৌঁছে গেছেন। তারপর সরকারি অনুদানে হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’ নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন জয়া। তার সঙ্গে পরিচালক হিসেবে যুক্ত হলেন অনম বিশ্বাস। জয়া হলেন রানু, মিসির আলি চঞ্চল চৌধুরী, নিলু শবনম ফারিয়া, আনিস অনিমেষ আইচ আর একটি বিশেষ চরিত্রে ইরেশ যাকের। ‘কিশোর আলো’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জয়ার সঙ্গে দেখা। বললাম, আমার বড় মেয়ে ‘দেবী’ দেখে মুগ্ধ। জয়া বলল, আপনি কবে দেখবেন বলুন। দেখে আমাকে জানাবেন ছবি কেমন হলো। দুই দিন পর ‘দেবী’ দেখলাম। চমৎকার ছবি। পরিচালনা এবং অভিনয় গুণে, ক্যামেরার কাজে এবং মিউজিকে, সাউন্ড ইফেক্টে ‘দেবী’ অসামান্য হয়ে উঠেছে। কাকে বাদ দিয়ে কার অভিনয়ের প্রশংসা করব। জয়ার না চঞ্চল চৌধুরীর? শবনম ফারিয়ার না ইরেশ যাকেরের? নাকি অনিমেষ আইচের?

আমি জানি অনিমেষের খুব প্রিয় চরিত্র মিসির আলি। মিসির আলিবিষয়ক দু-তিনটি টিভি নাটক তিনি পরিচালনা করেছেন। সেইসব নাটক দেখে হুমায়ূন আহমেদ মুগ্ধ হয়েছেন। হুমায়ূন ভাই একদিন আমাকে বলেও ছিলেন, অনিমেষ ছেলেটা ব্রিলিয়ান্ট। তাঁর পরিচালনার সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম। তিনি যে এত ভালো অভিনেতা জানা ছিল না। সবকিছু মিলিয়ে ‘দেবী’ আমাদের চলচ্চিত্রে এক মেধাবী সংযোজন। আর সবকিছু ছাপিয়ে জয়ার অভিনয় চোখে লেগে থাকার মতো। জয়া, তোমাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। হুমায়ূন আহমেদের রানুকে তুমি জীবন্ত করে রাখলে। হুমায়ূন ভাই জীবন্ত করেছেন লেখায়, তুমি করেছ অভিনয়ে।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন