Sylhet View 24 PRINT

অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে মধুর হাসি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১১-৩০ ১৫:৫৪:৫৩

লেখক

আল-আমিন :: বাংলা ঋতুতে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস নিয়েই হেমন্তের যাত্রা। হেমন্তকে বাংলা ষড়ঋতুর অন্যতম লাজুক ঋতু বলা হয়। এই হেমন্ত ঋতুকে ঘিরে বাংলা সাহিত্যে যোগ হয়েছে গল্প, উপন্যাস, নাটক ওও কবিতা।

হেমন্তের মতো সৌন্দর্যরূপ ঋতু থাকায় বাংলা সাহিত্যও দিনদিন সমৃদ্ধি হয়েছে। কবিতা সেজে ওঠেছে নিজস্ব ঢঙে। কবিতার রূপ-রস-গন্ধ ছড়িয়েছে নবান্নে সুরভির মতো। শিউলি, কামিনী, মল্লিকার সৌরভে সুরভিত হয় চারদিক। অগ্রহায়ণে পায়েসের শুভ্রতায় প্রাণ ফিরে পায় পুরোনো জীর্ণতা।

কিষানীর উঠানের ধুলোর গন্ধ কবিতার শরীরের সাথে মিশে যায় নিপুণভাবে। ফসলি মাঠ আর শীতের হাওয়া দোল দেয় গ্রামের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় লিখেছেন-"আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে,জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে। শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার, রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।" এখানে কবি হেমন্তের বিচিত্র স্তব্ধ রূপ তুলে ধরেছেন। হেমন্তের পথে পথে হেঁটে কবি যে রঙরেখা এঁকেছেন তা সত্যিই কল্পনার বাইরে। হেমন্তের অগ্রহায়ণের মিষ্টি রোদ ডানা মেলে উড়ে যায় শীতের সীমান্তে। কিষানের গোলাভরা ধানে বুক ভরে যায় অন্য রকম সুখে।

কবি সুফিয়া কামাল হেমন্তের বন্দনায় লিখেছেন-
"এই তো হেমন্ত দিন, দিল নব ফসল সম্ভার
অঙ্গনে অঙ্গনে ভরি, এই রূপ আমার বাংলার
রিক্তের অঞ্চল ভরি, হাসি ভরি, ক্ষুধার্তের মুখে
ভবিষ্যৎ সুখের আশা ভরি দিল কৃষকের বুকে
শিশিরের সিক্ত দ্বারা বুকে তৃণাঞ্চল জাগে
সোনালী ধানের ক্ষেতে ঈষৎ শীতার্ত হাওয়া লাগে।"
বাংলা সাহিত্যে হেমন্তকালীন ফসলের রূপ বর্ণনা হয়েছে ভিন্নমাত্রায়। শিশিরভেজা ফসলের রূপ কবিতায় ফুটে উঠেছে একান্তভাবে।

কবি জীবনানন্দ দাশের অবসরের গান কবিতায় তিনি লিখেছেন-"চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল।"
কবির এই কবিতায় স্পষ্ট বোঝা যায়, শিশিরভেজা ফসল কখনো কখনো ফলবতী নারীর ভূমিকাও পালন করে। নারী যেমন সৌন্দর্যের প্রতীক তেমনি হেমন্তের শিশিরভেজা ফসলও এই ঋতুর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় যথার্থই তুলে ধরেছেন হেমন্তের বন্দনা।

হেমন্তকে নিয়ে তরুন কবিদের কবিতায় মানুষের মনের কথাগুলো তুলে ধরেছেন। কবিতায় মূলকথা সরাসরি প্রকাশ না করে কবিতায় প্রকৃতির দর্শন ক্ষেত্রও তৈরি করেছেন। ভিন্নভিন্ন মাত্রায় কবিতায় তুলে ধরেছেন শিশির ভোরবেলা, মিষ্টিরোদ, স্নিগ্ধ দুপুর, মেঘমুক্ত বিকেল, কুয়াশায় ভিজে যাওয়া পাতার সংসার নিয়ে সন্ধ্যা আর মুখরিত রাত। একই সাথে এখন সংস্কৃতিকওয়ালা মনগুলো নতুনভাবে যুক্ত করেছেন পিঠাপুলির উৎসব। বাংলার এসব প্রথা দিনে দিনে পরিবর্তিত হচ্ছে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণে, পরিবর্তন এসেছে বাংলা সাহিত্যের কথা ও কবিতায়। যেমন-"ওই যে সবুজ ছুঁয়ে সন্ধ্যা নামে দেখো আসলে সবুজ নয়, এ হলো কবির কল্পনার বনভূমি এবং সন্ধ্যার মতো কুয়াশার গাঢ় কিছু চিত্রকল্প, যার প্রান্ত ছুঁয়ে ফুটে আছে কমলালেবুর মতো লাল সূর্য, চিত্রকল্পে সন্ধ্যা মনে হয়।"

হেমন্তে দেখা মেলে ফসলি মাঠের প্রাণবন্ত উজ্জ্বলতা। এই প্রাণবন্ত জীবন-জীবিকা ফুটে উঠেছে কবিতার বিভিন্ন পাতায়। কবি জীবনানন্দ দাশকে হেমন্তের ষোলআনা কবি বলা হয়। তার কবিতায় উঠে এসেছে সৌন্দর্যের কারুকার্য। হেমন্ত-ভাবনায় শামসুর রাহমানও ছিলেন জীবনানন্দীয় চিত্রকল্পের বিপরীতে। আবার আল মাহমুদের কবিতায়ও হেমন্ত ধরা দিয়েছে মানুষের প্রেমে ও প্রকৃতির নবলোকে। তিনি অঘ্রাণ কবিতায় লিখেছেন-"আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে। রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে।" এখনকার সময়ের লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো বেশি প্রখর, তাদের চিন্তা-চেতনার সাথে সাধারণ জীবন-জীবিকা একাকারভাবে মিশে যায়। যেমন-
"সূদীর্ঘ আঁধার ভেঙে জেগে ওঠে আমার সুদিন

আমার আশ্চর্য আনন্দের ভোর কিছুটা শিশির মাখা কিছুটা কুয়াশা হিম বাকিটা কোমল আর্দ্রতায় অবনত নীলের উঠোনে কেউ যেনো লিখে গেছে হেমন্তের নাম, হেমন্ত আমার হেমন্ত।" প্রকৃতির সাথে মানুষের অস্তিত্বের সম্পর্ক নিবিড়ভাবে মিশে আছে আদিকাল থেকেই। প্রকৃতি ছাড়া মানুষ কল্পনা করা অসম্ভব।

কবিতার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে হেমন্তের প্রেম, বিরহ, বিদ্রোহ কিংবা লাজুকতার চিত্রকল্প। জীবনানন্দ দাশ তার "আবার আসিব ফিরে" কবিতায় সাহসী ভূমিকা দেখিয়েছেন-
তিনি লিখেছিলেন- "আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।"
হেমন্তবিষয়ক কবিতা বেশ খোরাক জুগিয়েছে সাহিত্য প্রেমীদের। ঋতু ছাড়া কোনো কবিই প্রকৃতির সুস্থ বন্দনা করতে পারেন না।এখনকার কবিতায় কবি বেশ সচেতনভাবে তাদের কাব্যশৈলী দেখিয়ে থাকেন নানান ভূমিকায়। হেমন্ত বন্দনার জন্য কবিদেরকে হাঁটতে হয়েছে বহুক্রোশ পথ, অপেক্ষা করতে হয়েছে সময়ের পর সময়, ভাবতে হয়েছে প্রকৃতির নির্দশন নিয়ে। চিত্রকল্প কিংবা দৃশ্যকল্পের অবতারণাও হয়েছে হাজারো দৃশ্যায়নের পর। লাউয়ের ডগার মতো লিকলিকে শরীরে কবিতা লিখেও কবিগন সমৃদ্ধি করেছেন হেমন্তকে।
"সকাল বেলায় শিশির ভেজা, ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে। হালকা মধুর শীতের ছোঁয়ায়,শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে। হেমন্ত তার শিশির ভেজা, আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়। চুপে চুপে রং মাখাল,আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।"

প্রমকবি জীবনানন্দ দাশ হেমন্তকে নিয়ে তার কবিতায় লিখেছেন-"এদেহ অলস মেয়ে,পুরুষের সোহাগে অবশ,চুমে লয় রৌদ্রের রস,হেমন্ত বৈকালে,উড়ো পাখপাখিদের পালে উঠানে পেতে থাকে কান, শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ অঘ্রাণের মাঝরাতে।"

কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও হেমন্ত এক অপরূপা সুন্দরী। ঋতুকন্যা হৈমন্তীর প্রেমে হাবুডুবু খায় পুরো প্রকৃতি। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে আমাদের মাঝে বহে যায়। প্রকৃতি ভিন্ন রূপে সেজে সবাইকে মুগ্ধ করে নবান্নের উৎসবে। শিশির ভিজা শিউলি ফুল,কৃষকের নতুন ধান কাটার ব্যস্ততা, নতুন ফসল ঘরে তুলার আনন্দে কৃষানীর হাসিমুখ,ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর উৎসব,মিষ্টি হিমেল হাওয়া এ যেন প্রকৃতির অপার মহিমা। শরতের সাদা মেঘের ভেলা উড়িয়ে হিম মৃদু কুয়াশার স্তর ও নতুন ধানের মিষ্টি গন্ধ হেমন্তের আগমন জানান দেয় প্রকৃতিতে।

ষড়ঋতুর মধ্যে এ ঋতুই একটি সৌন্দর্যরূপের শান্ত, স্নিগ্ধ, মধুর হিমেল ভরপূর্ণ ঋতু। এই ঋতুর যেন সৌন্দর্যরূপের তুলনা হয় না। প্রতি বছর ঋতুর পালাবদলে সোনালি রঙের সৌন্দর্য্য নিয়ে হেমন্তের হিম শীতল হাওয়ায় হাওরের সোনালি ধানের শিষে ঢেউ খেলে যায়। কিচিরমিচির পাখির ডাক, শিশিরে ভেজানো দূর্বাঘাস, শুকিয়ে যাওয়া পথঘাট, পাকা ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণের সাথে মিষ্টি সূর্যের হাসি ছড়িয়ে, নবান্নের আমন্ত্রণে হেমন্ত হয় শিল্পীর ছবি আঁকার মতো বাংলাদেশ। এসময়ে কৃষক-কৃষাণীর মুখে হাসি থাকে নতুন ফসল ঘরে তুলার আনন্দে, গাছের ছায়ায় রাখাল বালকের মধুর বাঁশির সুরে প্রকৃতি মিশে যায় হেমন্তের ভালোবাসায়। বাউলদের মনে জাগে ভাব আর ছন্দ। তারা একতারা বাজিয়ে মেঠোপথ দিয়ে দূর সীমানায় মিশে যান বাউল গানের আসরে। গ্রামের ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় বাড়ির আঙিনা। নবান্ন আর পিঠেপুলির আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। নতুন ধানের চালের ফিরনি, পায়েস অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়ায়- প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করেন।

গ্রামে হেমন্তের এই সময়ে বিভিন্ন ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, পুঁথিপাঠসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক আনন্দ উদযাপন করেন। এ ঋতুতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি প্রভৃতি। হেমন্তকালে বৃক্ষরাজি থাকে সবুজে ভরা। খাল-বিল, নদী আর বিলজুড়ে দেখা যায় সাদা-লাল শাপলা আর পদ্মফুলের মেলা।

হেমন্তের রাতের আকাশে দেখা যায় অসংখ্য তারার মেলা। আকাশে জমাটবাঁধা মেঘের অদৃশ্য বলে মিটিমিটি তারা জ্বলে সারারাত ভর। সেই সাথে চাঁদের শরীর থেকেও জোছনা ঝরে পড়ে পৃথিবীজুড়ে। ঝিরিঝিরি বাতাস আর মৃদু আলোর ঝলকানিতে তৈরি হয় মায়াময় এক রাত। অন্যদিকে, খুব ভোরে একটু শীতল বাতাস, সেই সাথে ঘাস ও ধানগাছের ডগায় জমতে শুরু করা শিশিরের বিন্দুবিন্দু কণা জানিয়ে দেয় হেমন্তের তাৎপর্য।

হেমন্তের শুরুতে ক্ষেতের ধানগাছগুলো সবুজ ঢেউ খেলা থেকে এগিয় যায় ফাঁকা মাঠের দিকে। ফসল ঘরে এসে ঠাঁই নেয় কৃষকের। এরপর বিশাল মাঠে কুয়াশা পড়ে জমা হয়ে বিরাট শূন্যতার পাহাড় তৈরি করে। এ শূন্যতা দেখতে নিদারুণ।
হেমন্তকে আমাদের সামনে বিপুল আড়ম্বরের সঙ্গে স্থাপন করেছেন কবিগন। হেমন্ত যে বাংলাদেশের ঋতু, আবহমান বাংলার সঙ্গে যে তার নাড়ির টান, তা জীবনানন্দ পড়ে আমরা অনুভব করি। কুয়াশা, বিষণ্নতা, ফাঁকা মাঠের দৃশ্যকল্প আমাদের টেনে নিয়ে যায় কৈশোরে।

জীবনানন্দ দাস এখানেও বলেছেন-"যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়, যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে,যখন চড়ুই পাখি কাঁঠালিচাঁপার নীড়ে ঠোঁট আছে গুঁজে,যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরি পাতায়,যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়।

এ সময়ে কৃষকের গরু ও মহিষের গাড়িও দেখা যায় এ পথ থেকে অন্য পথে চলতে। শহরে থাকা তরুন ছেলেটিও গ্রামে যায় হেমন্তকে কাছ থেকে উপভোগ করার জন্য। তার দু’চোখে ভাসে ফেলে আসা দিনগুলোর দুরন্ত শৈশব, কৈশোর, আর আগামীর স্বপ্ন। মাঠে কাজ করা কৃষকের কন্ঠে শুনা যায় ভাওয়াইয়া, মারফতি ও মুরশিদি গানের সুর। তখন আমরা অনুভব করি ভালোলাগার ঋতু হেমন্ত। হেমন্ত ভালোবাসার ঋতু। হেমন্তের ভালোবাসা লাগুক সবার প্রাণে।


লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.