Sylhet View 24 PRINT

হেরে গেলেন মেয়র আরিফ, জিতলো বিএনপি

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-১২-০৮ ২২:০৭:৩০

মুহাম্মদ তাজ উদ্দিন :: সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী নিয়ে ধোঁয়াশা কেটে গেছে। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলীয় চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা, শিল্পপতি খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার জন্য চিঠি প্রদান করা হয়েছে।
 
দলের এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রাথমিক লড়াইয়ে জিতে গেলেন খন্দকার মুক্তাদির। দলের নেতাকর্মীদের মতে, খন্দাকার মুক্তাদির মনোয়ন পাওয়ায় জিতে গেছে সিলেটের বিএনপিও। আর হেরে গেলেন সিলেট বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সিলেট নগরীতে দারুণ জনপ্রিয় সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
 
প্রায় সাড়ে ৫ লাখ ভোটার অধ্যূষিত সিলেট মহানগর ও সিলেট সদর উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সিলেট-১ আসনে বিএনপির উম্মিদওয়ার বা মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন ২ জন। এদের একজন হেভিওয়েট প্রার্থী, প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ চৌধুরী। অন্যজন ছিলেন তুলনামূলক নবীন বিএনপি নেতা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। দু’জনই দলীয় মনোনয়নের চিঠি পান। দু’জন-ই নির্বাচন কমিশনে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ অবস্থায় মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসনে কে হচ্ছেন বিএনপির প্রার্থী তা নিয়ে রীতিমত ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। দলের নেতাকর্মীরাও দুই প্রার্থীর পক্ষে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েন।
 
দীর্ঘ দিন মাঠের রাজনীতিতে অনুপস্থিত থাকলেও সিলেট-১ আসনে মনোনয়ন জমা দিয়ে সরবে মাঠে নামেন ইনাম আহমদ চৌধুরী। তাকে সিলেট-১ আসনে প্রার্থী করার দাবীতে দৌড় ঝাপ শুরু করেন সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি মহানগর বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মীকে সাথে নিয়ে ইনাম আহমদ চৌধুরীর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। এমনকি, তিনিসহ জেলা ও মহানগর বিএনপির ৫১ জন নেতাকর্মী ইনাম আহমদ চৌধুরীকে দলীয় প্রার্থী করার দাবীতে মহাসচিব বরাবরে চিঠিও প্রদান করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সে দাবী উপেক্ষিত হওয়ায় কার্যত: হেরে গেলেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
 
গত প্রায় ৫ বছর ধরে সিলেটের রাজনীতির মাঠে সরব পদচারণায় রয়েছেন সাবেক এমপি খন্দকার আব্দুল মালিকের পুত্র খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত খন্দকার মালিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সিলেট সদর উপজেলার সর্বত্র সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে তৃণমূলে ব্যাপক যোগাযোগ গড়ে তুলেন তিনি। গত ৫ বছর ধরে সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাগারে যাওয়া বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনা, জামিন লাভে সহায়তা করা, এমনকি কারাগারে থাকা নেতাকর্মীদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে নিজেকে তৃণমূল কর্মীদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হন খন্দকার মুক্তাদির।
 
কিন্তু তার চাষ করার উর্বর জমিনে হঠাৎ করেই মাড়াই দিতে নেমে যান দলের সিনিয়র নেতা ইনাম আহমদ চৌধুরী। সিলেটের স্থানীয় রাজনীতির সাথে ইনাম আহমদ চৌধুরীর কোন ঘনিষ্ট যোগাযোগ বা অবস্থান না থাকলেও তিনি সিলেট-১ আসনে মনোনয়ন জমা দেয়ায় অনেকটা বেকায়দায় পড়ে যান খন্দকার মুক্তাদির। আর ইনাম আহমদ চৌধুরীর পক্ষে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ বেশ কয়েক জন নেতা শক্ত অবস্থান নেয়ায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় তাকে।

এ অবস্থায় সিলেট-১ আসনে কে হচ্ছেন ধানের শীষের প্রার্থী তা নিয়ে গত ক’দিন ধরেই চায়ের কাপে ঝড় তুলেছেন বিএনপি নেতাকর্মীসহ রাজনীতি সচেতন সিলেটের মানুষ।

অবশেষে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সিলেট-১ আসনে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দের জন্য দলের মহাসচিবের পক্ষ থেকে চিঠি হাতে পান খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির।
 
সিলেট-১ আসনে কে হচ্ছেন বিএনপির প্রার্থী এ নিয়ে গত ক’দিন ধরে যেমন কৌতুহলী আলোচনা চলছিল, পাশাপাশি চলছিল তরুণ বিএনপি নেতা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের মনোনয়নের বিরুদ্ধে সিটি মেয়র আরিফ কেন অবস্থান নিলেন- তা নিয়েও আলোচনা সমালোচনা। দলের নেতাকর্মীদের মতে, তৃণমূলের মতামতকে মূল্য দেয়ায় কার্যত খন্দকার মুক্তাদিরের মনোনয়ন প্রদানের মধ্য জয় হয়েছে সিলেটের বিএনপি নেতাকর্মীর। আর চরম পরাজয় ঘটলো জনপ্রিয় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

কিন্তু, আরিফুল হক কেন খন্দকার মুক্তাদিরের বিপক্ষে অবস্থান নিলেন- এ বিষয়ে দলের নেতাকর্মীদের সাথে, কথা বলে পাওয়া গেছে নানা তথ্য। তারা অনেকগুলো ‘হাইপোথিসিস’ দাঁড় করিয়েছেন এ বিষয়ে,

যেমন,
১. আরিফুল হক চৌধুরীর উচ্চাভিলাস: মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসনে বিএনপি যদি ইনাম আহমদ চৌধুরীকে মনোনয়ন দিত, তাহলে বয়োজ্যেষ্ট ইনাম চৌধুরী আগামী নির্বাচনে হয়তো প্রার্থী হতে পারতেন না। আর ইত্যবসরে মেয়র হিসেবে মহানগররীতে নিজের অবস্থান শক্ত করে নিতেন আরিফুল হক চৌধুরী। ফলে, পরবর্তী নির্বাচনে আরিফুল হক হতে পারতেন মর্যাদাপূর্ণ- সিলেট-১ আসনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী। আর খন্দকার মুক্তাদির প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হলে তিনি সিলেটে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ‘সেট’ হয়ে যাবেন, ফলে সিলেট-১ আসন স্থায়ীভাবে তার হাত ছাড়া হওয়ার আশঙ্কা ছিল আরিফের। এ কারণেই খন্দকার মুক্তাদির যাতে দলের মনোনয়ন না পান সেজন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

২.মেয়রের কর্তৃত্ব: অতীতে এম. সাইফুর রহমান সিলেট-১ আসনে দলের এমপি হলেও কার্যত: মহানগরীর প্রশাসনসহ সকল কিছুর কর্তৃত্ব ছিল আরিফুল হকের হাতে। একই ভাবে, ইনাম আহমদ চৌধুরী সিলেট-১ আসনে এমপি হলে তিনি ঢাকা কেন্দ্রিক রাজনীতি ও সরকারী কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকতেন আর তার প্রতিনিধি হিসেবে সিলেট চালাতেন আরিফুল হক চৌধুরী। কিন্তু, সিলেটের সাথে খন্দকার মুক্তাদিরের ঘনিষ্ট যোগাযোগ থাকায় নিজের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার কর্তৃত্ব হারানোর আশঙ্কা থেকেই খন্দকার মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন মেয়র আরিফ।
 
৩. অর্থমন্ত্রীর ইঙ্গিত: সিলেট-১ আসনের বর্তমান এমপি, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সাথে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর রয়েছে ঘনিষ্ট যোগাযোগ। সিলেট-১ এ যাতে ইনাম আহমদ চৌধুরী মনোনয়ন পান, সেটি অর্থমন্ত্রীও চাচ্ছিলেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের সন্দেহ অর্থমন্ত্রীর ইঙ্গিতেই মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ইনাম আহমদ চৌধুরীর পক্ষে অবস্থান নেন।

৪. বিগত সিটি নির্বাচনে খন্দকার মুক্তাদিরের অবস্থান: বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। কিন্তু, মেয়রের ঘনিষ্ট জনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের সন্দেহ মেয়রকে বিজয়ী করতে আন্তরিক ছিলেন না খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। এ কারণেই সিটি মেয়র আরিফুল হক ও তার ঘনিষ্ট জনরা এ শোধ তুলতে দলের মনোনয়ন আদায়ে প্রতিবন্ধক হলে দাঁড়ান।
 
৫. পূর্বজনীন বিরোধ: ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের পিতা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। সে সময় সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনে বিএনপির প্রার্থীরা পরাজিত হলেও সিলেট-১ আসনে জয়ী হন খন্দকার আব্দুল মালিক। দলের বিপর্যয়ের মুখে খন্দকার মুক্তাদিরের বিজয়ে সিলেটে বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষা পায়। কিন্তু, শোনা যায়- কেন্দ্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী, বর্তমান মেয়র আরিফুল হকের গুরু এম. সাইফুর রহমানের বিরোধীতার কারণেই কেন্দ্রে মূল্যায়ন পাননি খন্দকার মালিক। এবারের নির্বাচনে সেই পূর্ব জনীন বিরোধেই মেয়র বিরোধিতায় নামেন খন্দকার মালিক পুত্র খন্দকার মুক্তাদিরের।
 
এ অবস্থায় দলের নেতাকর্মীদের একাংশের বিরোধীতার মুখে দলীয় মনোয়ন বাগিয়ে আনতে পারলেও দলের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব মোকাবেলা করে কতটুকু সফলতা অর্জনে সক্ষম হবেন তরুণ তুর্কী খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির- তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ থাকবেন সিলেট মহানগর ও সদর উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ।

লেখক: সাংবাদিক ও আইনজীবী।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/০৮ ডিসেম্বর ২০১৮/টিই/আআ

সম্পাদক : মো. শাহ্ দিদার আলম চৌধুরী
উপ-সম্পাদক : মশিউর রহমান চৌধুরী
✉ sylhetview24@gmail.com ☎ ০১৬১৬-৪৪০ ০৯৫ (বিজ্ঞাপন), ০১৭৯১-৫৬৭ ৩৮৭ (নিউজ)
নেহার মার্কেট, লেভেল-৪, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট
Developed By - IT Lab Solutions Ltd.