আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ইমরান আহমদ : সোনালী ইতিহাসের পুনর্জাগরণের মহানায়ক

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০১-১৩ ১৭:১৩:১৪

আব্দুল হাই আল-হাদী :: ’হেরি সাহেব বাহাদুর
বিনা দোষে মাইলরে সোনার জৈন্তাপুর
ছাতক তনে আইল হেরি যাইত বদরপুর
সিলেট আইয়া জিজ্ঞেস করে জইন্তা কতদূর।।
ছাবাল বয়সী ইন্দ্র সিং মুখে ছাপ দাড়ী
বন্দী করি তইলো নিয়া মুরারী চান্দ’র বাড়ী
হদিন থাকি আন্দাইর হইল সোনার জইন্তাপুর
বিনাদোষে মাইলোরে সোনার জইন্তাপুর।।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ধনে-জনে-সভ্যতায়-সংস্কৃতিতে আলোকিত, পান-পানি আর নারীর দেশ খ্যাত স্বাধীন-সার্বভৌম রাজ্য ছিল জৈন্তিয়া। সে রাজ্যের রাজারা শতাব্দীর পর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অত্যন্ত দাপটের সাথে রাজ্য শাসন করেছেন । দাপুটে রাজাদের মতো সেখানকার মানুষরাও ছিলেন সাহসী ও ক্ষমতাবান। কিন্তু পলাশীর মতো আরেক নির্মম ট্রাজেডির মুখোমুখী হয়ে এ রাজ্যের স্বাধীনতা সূর্য্য অস্তমিত হয় ১৮৩৫ সালে। পাতানো বন্ধুত্বের ছলে প্রতারণার আশ্রয়ে ব্রিটিশরা বিনা যুদ্ধে এ রাজ্যের পতন ঘটে। স্বাধীনতা অস্তমনের সাথেই দূর্ভাগ্য এখানকার মানুষ ও মাটির নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠে। মানুষের জীবনে  ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরও এখানকার কোন নেতার কেন্দ্রীয় সরকারের রাজকারবারে সরাসরি যুক্ত না হওয়াই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। অবহেলা আর বৈষম্যের বেড়াজালে আবদ্ধ মানুষেরা দিশেহারা নাবিকের মতো হয়ে পড়ে নেতাহীন। সে নিকষ কালো অন্ধকারে আলোর প্রদীপ হয়ে আবির্ভূত হন ইমরান আহমদ। অসহায়ের সহায়, দিশেহারা মানুষ তাদের যেন খুঁজে পেল আশ্রয়ের নিড়। সেজন্য তারা তাকে ছ’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে। জৈন্তিয়ার শেষ স্বাধীন রাজা ইন্দ্র সিংয়ের পর ইমরান আহমদ-ই একমাত্র ব্যক্তি ও নেতা-যিনি প্রায় দু’শ বছর পর মন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। হয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী । ওপার জৈন্তিয়া অর্থাৎ মেঘালয়ের ইস্ট ও ওয়েস্ট জৈন্তিয়া হিলস জেলার কোন নেতাও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কোন মন্ত্রী-মিনিস্টার হতে পারেননি। মাননীয় সংসদ সদস্য ইমরান আহমদ মন্ত্রী হয়ে শুধু নিজেকে ধন্য করেছেন, তা কিন্তু নয়। একইসাথে তিনি ধন্য করেছেন সাবেক জৈন্তিয়া রাজ্যের উত্তরসূরি মানুষদের। পরিণত হয়েছেন সোনালী অতীতের পুনর্জাগরণের মহানায়ক।

ব্যক্তি ইমরান আহমদ কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। নিরহংকার, পরোপকারী, মেহনতী মানুষের কন্ঠস্বর, পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব ও সততার খ্যতির জন্য তিনি সবার কাছে সুপরিচিত। এলাকার মানুষের কাছেও তিনি আপনজন, আত্বার আত্বীয়। সেজন্য মানুষেরা তাকে ছ’বার নির্বাচিত করে সংসদে পাঠিয়েছে।কিন্তু এলাকার বাইরের অনেকেই তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানেননা, জানলেও জানেন ভাসা ভাসা। সেজন্য তার সম্পর্কে আলোকপাত খুবই প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে  সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হল।

ইমরান আহমদ ১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়রি ভারতের আম্বালায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম ক্যাপ্টেন রশিদ আহমদ এবং মাতা মরহুম কমরুন নেছা। তিনি ১৯৬৪ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট এবং একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৬৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পাস করেন। ১৯৬৯ সালে প্রাচ্যের অক্রফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মান ও পরে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষার পাঠ চুকিয়েই তিনি কর্মজীবন প্রবেশ করেন। ১৯৭০ সালে জেমস্ ফিনলের চা বাগানে তিনি ব্যবস্থাপনায় যোগ দেন এবং পরবর্তীতে অনেক গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি নিজেই একাধিক চা বাগানের স¦ত্বাধিকারী হিসেবে সেগুলো পরিচালনা করছেন।

১৯৮৬ সন থেকে সরাসরি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং নিজেকে জনহিতকর কাজে নিয়োজিত করেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর নিজের আন্তরিকতায় অল্প সময়েই তিনি এলাকার মানুষের মন জয় করতে সমর্থ হন। এলাকাবাসীও তাকে নিজের স্বজন করে নিতে মোটেও কার্পণ্য করেনি। যার প্রমাণ ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন । এটি ছিল তার জীবনের প্রথম সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করছেন।  এছাড়া তিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  তিনি সপ্তম জাতীয় সংসদে সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নবম জাতীয় সংসদে লাইব্রেরি কমিটি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দশম জাতীয় সংসদে তিনি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ইমরান আহমদ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। তিনি রাংপানি ক্যাপ্টেন রশিদ হাইস্কুল এন্ড কলেজ, ইমরান আহমদ মহিলা ডিগ্রি কলেজ, গোয়াইনঘাট ইমরান আহমদ বালিকা বিদ্যালয়, ইমরান আহমদ কারিগরি কলেজ, কোম্পানীগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়াও তিনি গোয়াইনঘাট কলেজ, জৈন্তিয়া ডিগ্রি কলেজ, সারিঘাট উচ্চ বিদ্যালয়, সালুটিকর কলেজ, আলীরগাঁও কলেজ, হাজী সোহরাব আলী স্কুল এন্ড কলেজ, রুস্তমপুর কলেজ  এবং হযরত শাহজালাল (রহ.) ডিগ্রি কলেজের দাতাসদস্য সহ বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত।

তিনি বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ও উর্দূ ভাষায় দক্ষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে তিনি দক্ষিণ কোরিয়া এবং কাতার সফর করেন। তাছাড়া বিভিন্ন সময় সরকারিভাবে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীন, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ত্রিনিদাদ, যুক্তরাজ্য, আজারবাইজান, সিঙ্গাপুর, উগান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাম্বিয়া, ক্যামেরুন, সুইজারল্যান্ড, কলম্বিয়া এবং হল্যান্ড সফর করেছেন। এছাড়া ব্যক্তিগত ভাবে ভুটান, যুক্তরাজ্য, মালেয়েশিয়া, জাপান, ফ্রান্স, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেছেন। দেশ ভ্রমণ ছাড়াও সমাজসেবা তাঁর অন্যতম শখ।ব্যক্তিগত জীবনে ইমরান আহমদ এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। 

ব্যক্তি ইমরান আহমদের হাত ধরেই সোনালী ইতিহাসের পুনর্জাগরণ ঘটেছে। প্রমাণ হলো, আমরাও পারি। সময়ের সাথে নিস্তেজ হয়ে পড়েনি আমাদের সব।এত হলো মুদ্রার একপিঠ, আরেক পিঠের খবর অনেকেরই জানা নেই। তাই  ইতিহাসের সোনালী দিনগুলো হাতছাড়া হওয়ার ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত জরুরী। 

১৮৩৫ সালের ১৬ মার্চ । সেদিনও সূর্য উঠেছিল পূর্বাকাশে, পুবালী বাতাস বয়েছিল মৃদুমন্দে। পাখীরা গেয়েছিল গান, সাত সকালে কলশী কাখে বধুরা নিয়ে এসেছিল পানি। শঙ্খধ্বনি বেজেছিল মন্দিরে, জেলেরা গিয়েছিল মাছধরতে। রাজাও অন্দরমহলের কাজ-কারবার করেছেন অন্যদিনের মতো স্বাভাবিকভাবে, রাজন্যবর্গের সাথে করেছেন বৈঠক । প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে রাজ্যের কাজ-কর্ম শুরু হয়েছিল যথারীতি। এরমধ্যেই যেন কী হয়ে গেল!! কালো মেঘের ছায়া ভর করলো রাজ্যের উপর। রাজবাদুয়া এসে রাজা ইন্দ্র সিংকে খবর দিলেন, হ্যারি ইনগলিস অনেক সেনাসহ রাজধানীতে প্রবেশ করেছেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই হ্যারি নিজেই এসে হাজির হলেন রাজদরবারে। সসন্যে রাজধানীতে আগমনের কারণ জানতে চাইলে হ্যারি জানান যে তিনি ভ্রমণে এসেছেন। সরলহৃদয় রাজা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

সিলেট লাইট ইনফ্রেন্ট্রির অধিনায়ক ও বৃটিশ পলিটিকেল এজেন্ট ক্যাপ্টেন লিস্টার ছাতকের চুনাপাথর ব্যবসায়ী হ্যারি ইনগলিসের সহায়তায় প্রতারণার মাধ্যমে জৈন্তা জয় করেন। হ্যারি ইনগলিসের সাথে খাসিয়া সর্দারদের ছিল খুব ভাব।একইসাথে তিনি  জৈন্তাপতির সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন। রাজার সাথে আলাপচারিতার মধ্যেই বন্ধুর সৈন্যরা নগরে লুটপাট শুরু করে দেয়। ব্রিটিশদের অন্যায়-অত্যাচারের খবর প্রধান সেনাপতি রাজাকে অবহিত করেন। রাজা এ অশুভ সংবাদ শুনে কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। মন্ত্রী ও সেনাপতি রাজার কাছে যুদ্ধেও অনুমতি প্রার্থনা করলেন, কিন্তু রাজা সে অনুমতি দিতে ইতস্তত: বোধ করলেন। তিনি ভাবলেন, নগরে যুদ্ধ আরম্ভ হলে অনেক নিরীহ নাগরিকের প্রাণহানী ঘটবে। ব্রিটিশ সৈন্যরা অল্পক্ষণের মধ্যেই রাজবাড়ীতে প্রবেশ করে এবং সমস্ত সম্পদ লুটপাট করে। তারা রাজাকে বন্দী করে সিলেট শহরের দিকে রওয়ানা হল।  সেনাপতি রাজাকে পুনরায় রাজার নিকট নিবেদন করেন-আদেশ করুন, জাহাপনা। প্রাণ থাকতে আপনাকে বন্দী করে নিয়ে যেত দেবনা। ভাবুক রাজা যুদ্ধ করতে নিষেধ করলেন।  পরবর্তীতে তাকে সিলেটে মুরারী চাদের বাড়ীতে নিয়ে বন্দী করে রাখা হয় । বৃটিশরা পরে জৈন্তারাজ্যের সমতল অংশ ছেড়ে দেওয়ার শর্তে পার্বত্য ১২ পুঞ্জি রাজাকে ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব দিলে রাজা তা  ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন । ১৮৬১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উল্ল্যেখ্য মাত্র ২০ বছর বয়সে রাজা ইন্দ্র সিং ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেন। রাজাকে মাসে ৫০০ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করা হলে তিনি তা-ও প্রত্যাখান করেন।

ব্রিটিশরা সে রাজ্যটি করায়ত্ব করলেও ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দলইগণ সে রাজ্যের শাসন কাজ পরিচালনা করেন। ব্রিটিশরা খুব একটা নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারেনি তখন পর্যন্ত।  ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশরা সে অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করতে থাকে এবং নিজেদের ক্ষমতার পাকাপোক্তকরণের দিকে মনোযোগ দেয়। এতে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে আস্তে আস্তে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী জীবন ও সংস্কৃতির উপরর আস্তে আস্তে হস্তক্ষেপ করলে ১৮৬০ জৈন্তিয়ারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। সে বিদ্রোহ প্রচন্ড যুদ্ধে রুপলাভ করে এবং ১৮৬২ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। ইতিহাসে ব্রিটিশবিরোধী সে বিদ্রোহ  সিন্টেং বা জৈন্তিয়া ব্রিদ্রোহ নামে পরিচিত । সে বিদ্রোহের অকুতোভয় নেতা উ কিয়াং নাংবাহকে ১৮৬২ সালের ৩০ ডিসেম্ভর জোয়াইতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের মাধ্যমে সে বিদ্রোহ দমন করে জৈন্তিয়া অঞ্চলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। পরবর্তিতে সে রাজের সমতল অংশ সিলেটের সাথে এবং পাহাড়ের বিস্তৃত অংশ আসামের সাথে যুক্ত করা হয়।

এরপর যা হওয়ার তা হল। ব্রিটিশরা তাদের চিরাচরিত নিয়মে ’ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি গ্রহণ করলো জৈন্তিয়া রাজ্যের সমতল অংশকে সিলেটের সাথে, গোভার অংশ আসামের নোয়াগাও ও কাছাড় জেলার অন্তর্ভূক্ত করে এবং পার্বত্য ১২ পুঞ্জির অংশকে প্রথমে হস্তক্ষেপমুক্ত রাখলেও পরবর্তিতে ভারতের মেঘালয়ের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৮৩৬ সালের ২১ শে মার্চ ঢাকা কাউন্সিলের এক প্রশাসনিক আদেশে সমতল অংশকে সিলেট জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৮৭৭-১৮৮২ সালে সিলেটের প্রশাসনিক বিন্যাসের মাধ্যমে মহকুমার বাস্তবায়ন হয় কিন্তু জৈন্তাকে মহকুমার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। ১৯০৫ সালে সিলেটের অধিকৃত অঞ্চল হিসেবে আসাম প্রদেশের অংশ হয় জৈন্তিয়া। ১৮৯০ সালে জৈন্তাপুরে এবং ১৯০৮ সালে কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাটে পুলিশ স্টেশন স্থাপন করা হয়।

অনেকেই বলছেন, প্রাচীন জৈন্তিয়ার সমতল অংশ থেকে ইমরান আহমদ-ই প্রথম মন্ত্রী হননি। তাদের মতে, ১৯৬০ সালে কানাইঘাটের এম.এ.সালাম (মিনিস্টার সালাম) প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। তথ্যটি মোটেও ভুল নয়। কিন্তু যে ব্যাপারটি লক্ষ্যনীয়, তা হচ্ছে এমএ সালাম ছিলেন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান প্রদেশের মন্ত্রী। কিন্তু ইমরান আহমদ এমপি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। সুতরাং ১৮৩৫ সালের পর ইমরান আহমদ-ই স্বাধীন বাংলাদেশের রাজকারবারে যুক্ত প্রথম ব্যক্তি।  

দীর্ঘ ছ’বারের নির্বাচিত এমপি ইমরান আহমদ মন্ত্রী হয়েছেন । তিনি বড় হয়েছেন, তাই তার উপর দায়িত্বের ভারও পড়েছে অনেক বেশি। মন্ত্রী তিনি সারা বাংলাদেশের, কিন্তু এমপি তিনি সিলেট-৪ আসনের । তাই এখানকার মানুষের চাওয়া-পাওয়া আর আকঙ্খাও তার কাছে বেশি থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। সিলেটের এ অঞ্চলটি প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে সাজিয়েছে আপন হাতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল সিলেট-৪। বাংলাদেশের ১ম গ্যাস ও তেলের খনির অবস্থান জৈন্তাপুরের হরিপুরে। কিন্তু ১৯৫৫ সালে গ্যাস আবিস্কৃত হলেও এখনো এখানকার লোকজন গ্যাস সংযোগ পাননি। জ্বালানীর জন্য মানুষকে একমাত্র প্রাকৃতিক বনের উপর নির্ভর করতে হয়। পর্যটন কেন্দ্র রাতালগুল, শ্রীপুর, লালাখাল, বিছনাকান্দি, জাফলং, ভোলাগঞ্জ, লাল শাপলার বিল  ইত্যাদির অবস্থান এ অঞ্চলে। তাছাড়া উত্তর-পূর্ব সিলেটের এ অঞ্চলের এক অনন্য ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এখানে পাশাপাশি সহবস্থান করছে হাওর-বাওর-জলাভূমি-টিলা-পাহাড়-সমতলভূমি-নদী-নালা-ঝর্না। তাই পর্যটকরা এক সফরে প্রকৃতির সকল স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। রয়েছে প্রাচীন সোনালী অতীতের অগণিত কীর্তি। একইসাথে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ অথচ প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় পরিণত এ অঞ্চলের অনেক স্থান ও নদী। রয়েছে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি। সব মিলিয়ে চমৎকার এক পর্যটন বান্ধব পরিবেশ এখানে বিদ্যমান। নদী-খাল-বিল-হাওর-বাওড়-পুরাকীর্তি বিনাসী তৎপরতার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সব মিলিয়ে পর্যটন, খনিজসম্পদ, পানিসম্পদ, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালকে সম্পৃক্ত করে প্রাণ, প্রকৃতি ও জনবান্ধন একটি সামগ্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। এতে পর্যটনের বিকাশের সাথে সাথে মানুষেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। 

মহানায়ক এসেছেন।এসেছেন বিজয়ী হয়ে, জয়ের মুকুট পরে। আরও কিছু করার, আরও এগিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থেকেই নিশ্চয় তাকে মন্ত্রী করা হযেছে। প্রায় দু’শতাব্দী পর ,যুগান্তরের সাধনার পর কাঙ্খিত নেতাকে পেয়ে  খুশি হয়েছেন দল-মত-নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ। মানুষের যুগান্তরের আর্তি আর প্রার্থনা ইমরান আহমদ’র মধ্য দিয়েই বিশ্বপ্রতিভূ বাস্তবতা দান করেছেন। আমাদের বিশ্বাস- গণমানুষের চাওয়াকে পাওয়ায় পরিণত করবেন ইমরান আহমদ এমপি। সুকান্তের ভাষায় বলতে হয়, হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।

*লেখক: গবেষক ও পরিবেশকমী।
ইমেইল: hyehadi@gmail.com

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন