আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং

একটি আত্মহত্যা এবং একটি নষ্টস্বপ্নের গল্প

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০১-১৬ ০০:১৬:১৩

শামসুল ইসলাম শামীম :: একটি তরুণ বিয়োগ হলো, একটি তারুণ্য’র মৃত্যু হলো। প্রতিষ্ঠার পেছনে লেজ উচিয়ে দৌড়ানো মানুষেরা এভাবেই চলে যায়, মরে যায়! নষ্টস্বপ্নে বিভোর এমন তারুণ্যে কোন অহংকার থাকেনা। মেনিবিড়ালের মতো কাঁইকুঁই করে বেঁচে থাকা এসব নষ্টস্বপ্নবাজদের কাছে মানুষ কি আশা করতে পারে?

অন্তত আমি এদের থেকে কিছুই আশা করি না। বেহুদা জীবনের পিছনে দৌড়ে ঘাম ঝরানো এসব বেহুদা খোয়াববাজদের জন্য আমার করুণা হয়। এরা না পারে নিজের জন্য কিছু করতে না পারে পরের জন্য। অসুস্থ মানষিকতা তাড়িত এই মানুষগুলোর সামনে স্বপ্ন মানেই যেনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া, ডাক্তার, আমলা-গামলা, কর্পোরেট পদধারি, ব্যাংক লোপাটকারী হোমড়াচোমড়া; এইই এদের স্বপ্ন! এর বাইরে তাদের স্বপ্ন থাকে না।
এমনতর অসুস্থ স্বপ্নকে বুকে লালন করে ক্রমেই এই স্বপ্নবাজরা অসুস্থ মানুষিকতার দিকে ধাবিত হয়। ফার্মের মুরগি আর খোয়াড়ী বলদ জীবনে অভ্যস্থ এই কেঁচোরা কখনোই ’দে ছুট’ বলে ছুটতে পারে না। এদের স্বপ্ন কখনোই সাগরের গভীরতা ছুঁেয় আসতে পারেনা, নাইতে পারেনা ভরা পূর্ণিমার অমল-ধবল জোছনায়, পারে না নবধারা জলে অবগাহণ করতে, ভরা বরষায় বুক চেতিয়ে ভাসতে পারে না তাই বাঁচতেও পারে না।
আসলে দোষটা এদের নয়, দোষ এই পুঁজিবাদি সমাজ ব্যবস্থার, পুঁজিবাদি পরিবার আর পুঁিজবাদি মানষিকতার। ’ত্যানা’য় ’মুতা’র বয়সেই এদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয় চরম নষ্ট-ভ্রষ্ট শয়তানি খোয়াব। মানবিকতার বদলে দানবিকতার স্বপ্ন নিয়ে এরা ক্রমাগত বড়ো হতে থাকে, না ঠিক বড় নয়! বয়স্ক হতে থাকে। এদের দেহের বয়স বাড়ার আগেই মনে ’ধাতু দুর্বল্যে’ রোগ আক্রমণ করে! তারা ’ত্যানা’ ভেজানো বয়সেই ’ত্যানা’ হারানোর ভয়ে যখন শংকিত হয়ে পড়ে তখন তাদের সামনে স্বপ্ন বলতে আর কিইবা থাকতে পারে!

এদের সামনে জীবনের প্রতিষ্ঠা অথবা খোয়াব মানেই রিচ ব্যাংক ব্যালেন্স, নামি ব্রান্ডের গাড়ি, দামী বাড়ি, টাকাওলা হোমড়া-চোমড়া বাপের নাদুস-নুদুস নারী; এই অসহায় তারুণ্যের খোয়াব এই সব নষ্ট চৌহাদ্দি যেনো টপকাতে পারে না কিছুতেই। পরিবার ও সমাজ থেকে ক্রমেই নষ্ট করে তোলা এই ’নির্বোধ’গুলো তাই খুব সহজেই নেতিয়ে পড়ে, নতজানু হয়ে পড়ে! এদের ব্যাকবোন বলতে আদতে কিছু থাকে কি-না কে জানে!

এরা প্রতিবাদি হতে পারে না, প্রতিবাদে সোচ্ছার হতে পারে না, এরা শ্লোগাণে শ্লোগাণে জ্বলে উঠতে পারে না, মিছিলে মিছিলে মুখর হতে পারে না, নিজের অধিকারটাই বা কি আর কি ভাবে সেটা আদায় করে নিতে হয় তাও জানে না এই জ্ঞানীপাপীগুলো!

আতুঁড়ঘরে নষ্টস্বপ্ন ঠেলেঠুলে সেদিয়ে দেয়া এই শিশুগুলোর বয়স বাড়তে থাকে মরা মানুষের মতো! মরা মাছের ফ্যাকাসে চোখ নিয়ে বয়স বাড়তে থাকা এই ’অবোধ’দের চোখে তাই কোন সত্যস্বপ্ন থাকে না। মনের ভিতরে ক্রমেই বেড়ে উঠা নষ্টস্বপ্ন এদের মেরে ফেলে এক সময়। এদের নষ্টস্বপ্ন এদের সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয়, এরা কম মার্কস পাওয়ার আশংকায়, বিভাগে সুপারভাইজার না পাওয়ার হতাশায়, শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পুরণ না হওয়ার আশংকার সিলিং ফ্যানে ঝুলে পড়ে! তারা জানে না ’ছার’দের শার্টের কলার অথবা ঠুঁটি কিংবা কন্ঠনালী চেপে ধরে কিভাবে নিজের প্রাপ্যটুকু আদায় করে নিতে হয়। যারা নিজেদের পথ নিজেরা তৈরী করে নিতে পারে না তাদের কাছে গোটা জাতি কিছু আশা করলেও আমি অন্তত এদের থেকে আশার বদলে ’অসহায়’ এই ’চিরবুড়ো’দের করুণাই করি!

এদের কোন ছেলেবেলা থাকে না, থাকে না কোন কৈশোর! ’দূরন্ত’ শব্দটা এদের জীবনের অভিধানে থাকে না, এদের জীবনে থাকে না স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার গল্প, থাকে না হাই স্কুলের শেষ বছরে দেখা সহপাঠিনির পায়ের রক্তরাঙা গোড়ালি দেখে নির্ঘুম রাত কাটানোর গল্প, থাকেনা কিশোর প্রেমের প্রথম ছোঁয়া পাওয়া বুকের রক্ত টগবগ করে লাফিয়ে উঠার গল্প! আসলে এদের জীবনের কোন গল্পই থাকে না, এদের জীবনটাই একসময় করুণার গল্প হয়ে যায়!

আমার ছেলেবেলায়ও এইসব শয়তানি স্বপ্ন আমার ভেতরেও সেদিয়ে দেয়ার চেষ্ঠা করা হয়েছিলো। কিন্তু আমি সেই শয়তানির উপর ’মুতে’ দিয়েছি, আমি তো শার্টের কলার টেনে ধরতে জানি, তাই এই নষ্টস্বপ্ন থেকে আমি বেঁচে গেছি, কিন্তু যারা মেরুদন্ড টানটান করে ’মুত’তে জানেনা, কলার চেপে ’টানাটানি’ করতে জানে না তাদের বাঁচাবে কে?

লেখক: শামসুল ইসলাম শামীম, সিলেট ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন