আজ মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ ইং

‘ফাটা-ফুতাইলে ঘষাঘষি আর মাঝখানো মরিছর খারাফি!’

:: শামসুল ইসলাম শামীম ::

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০১-১৭ ২২:৪৪:১০

শামসুল ইসলাম শামীম :: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার পর স্বপ্রণোদিত হয়ে সিলেট ভিউ’র মুক্তমতে আমাকে দু’কলম লিখতে হয়েছিলো। ‘হয়েছিলো’ এ কারনেই বললাম- আমার ভেতর থেকে কেউ আমাকে লেখাটিলিখতে তাড়না দিচ্ছিলো বারংবার। আমি অনেকটা ঠোঁটকাটা স্বভাব দোষে দুষ্ট! এটি যেমন আমার স্বজনরা জানেন তেমনি কিছুটা ধারণা করতে পারেন আমার দু’য়েকজন ফেসবুক বন্ধুও। লিখাটি প্রকাশের পর তা আমি ফেসবুকে শেয়ার করলে আমার ক’জন সুহৃদ তা নিজেদের ওয়ালে পাবলিক্লি শেয়ার করেন। আর যায় কোথা! যা হবার তাই হলো। আমার দফারফা অবস্থা! এ পর্যন্ত যে পরিমাণ ‘ভদ্রগালিগালাজ’ আমাকে শুনতে হচ্ছে এবং হবে তা রীতিমত ‘ভয়াবহ’! এমন ‘স্তুতিবাক্য’ শুনলে ‘ব্রাম্মণেরও পৈতা ছিঁড়িবার সাধ জাগিলেও জাগিতে পারে’! তাদের কেউকেউ আমাকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দালাল বলেছেন, তেমনি কেউকেউ আবার ‘অশ্লিললোক’ বলেও গালি দেন! খারাপ না, লোকটা আমি অশ্লিলই বটে!

শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার পর তার বোনসহ পরিবার একতরফা বলে গেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যম ‘গরম’ করে ফেলেছেন। এখন ‘পার্ট’ নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ভিসি সাহেব এক বক্তব্যে এই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার জন্য শিক্ষার্থীর পরিবারকে দায়ী করেছেনে। তার এই বক্তব্যের পেছনে তিনি যুক্তিও উপস্থাপন করেছন। আমার ‘পীড়া’টা এখানেই। এই যে দুই পক্ষ ঘষাঘষি করছেন, আপনারা তো সমাজের জ্ঞানদিপ্ত শ্রেণি। হুদাই কেনো জল ঘোলা করছেন বলেন তো? দেশ থেকে আইন আদালত কি উঠে গেছে? দায়িত্বটা তাদের কাধেই দিননা! পেঠ বাঁচাতে হোক আর পিঠ বাঁচাতেই হোক-আপনাদের এই জল ঘোলার বিষয়টি গোটা বিশ্ববিদ্যালযের সুনামকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এই বোধশক্তিটাও কি লোপ পেলো?

পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া সম্পদের কদর একটু কমই হয় ব্যাটার কাছে। বাপই জানে সম্পদ যোগাতে কতো পুকুর ঘাম তার ঝরাতে হয়েছে। ব্যাটা গরীব ঠ্যাং’র উপর ধণী ঠ্যাং তোলে কয়- ‘আমরা বংশগত টাকাওয়ালা’! আমি বলি বাপরে! চাপাটা বন্ধ কর। বাপের অর্জণরে এভাবে ঠেলা মেরে গাঙে ফেলে দিছনা। পরিবার আর বিশ্ববিদ্যালয়-এই দুইপক্ষকেই বলি। আপনারা কি জানেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সিলেটবাসীকে ত্যাগের কি মর্মান্তিক পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো? আপনারা তো পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে দিব্যি আছেন! ঘাম ঝরাতে হয়েছে এই সিলেট অঞ্চলের মানুষকে, আর আপনারা
চর্বিতে চিকচিক করছেন! এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আজকের নয়, ৭০ বছরের ত্যাগের ইতিহাস। বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক, অধ্যাপক জফির সেতুর জবানীতেই শুনুন কি প্রেক্ষাপঠ ছিলো সে আন্দোলনের-’১৯১২ সালে মুরারিচাঁদ কলেজ রাষ্ট্রায়ত্ত হয় এবং প্রথম শ্রেণির কলেজেও উন্নীত হয়। ১৯১২ ও ১৯২০ পৃথক দুই ‘দরবারে’ তদাননিন্তন আসামের দুই চিফ কমিশনারের বক্তব্য সিলেটের উচ্চশিক্ষার নতুনভাবে উন্মোচিত হয়। এই দুই চিফ কমিশনার হচ্ছেন যথাক্রমে স্যার আর্চডেল আর্ল ও স্যার এনডি বিটসন বেল। এরা দুজনই মুরারিচাঁদ কলেজকে কেন্দ্র করে সিলেট-আসামে উচ্চতর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। চিফ কমিশনারের একজন বলেছিলেন, এখানে শুধু একটা কলেজ স্থাপনের সূচনা করছেন না, বরং অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ জাতীয়ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করছেন। এই কথার প্রতিধ্বনি ছিল পরবর্তীজনের বক্তব্যেও। সেই-বক্তব্য অনুষ্ঠান থেকেই বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন সিলেটিদের মাথায় ঢুকেছিল। শুরু হয়েছিল সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আন্দোলন-সংগ্রাম। সেটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সময়কালেই, সে হিসাব ধরলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সিলেটিদের আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে কমপক্ষে ৭০ বছর।’

একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এখানেই শেষ নয়। এই আন্দোলন প্রসঙ্গে অধ্যাপক জফির সেতু বলেন, ’ আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকে আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং পরের বছর ৩০ এপ্রিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর আগে একজন সচিব রাষ্ট্রপতি এরশাদকে বুঝিয়েছিলেন, সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় হলে, এখানে কেউ পড়তে আসবে না। তাই বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় করাই যুক্তিযুক্ত। ফলে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় এই অঞ্চলের মানুষের জন্য দুরাশাই রয়ে গেল আজ অবধি। তাও হতো না, যদি না মন্ত্রীসভায় থাকতেন সিলেটের কৃতীসন্তান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, তাও, তিনি এরশাদকে রাজি করিয়েছিলেন খোদ মক্কাশরিফে, হজে গিয়ে ওয়াদা করিয়ে নিয়েছিলেন। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য,সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয়-বঞ্চনার পেছনে আসাম থাকাকালে অসমীয়াদের বাঙালিবিদ্বেষ এবং পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে অসিলেটিদের
সিলেটি-বিদ্বেষ কাজ করেছিল। এধরনের বিদ্বেষ যে আজও তিরোহিত হয়েছে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই।’

সিলেটের আঞ্চলিক একটি প্রবাদ আছে, ’ফাটা-ফুতাইলে ঘষাঘষি আর মাঝখানো মরিছর খারাফি’! আপনাদের এই ঘষাঘষির মাধ্যে ফেলে এই বিশ্বদ্যিালয়ের অর্জন আরসুনামের ’খারাফি’ করবেন না দয়া করে। নিজেদের চাপায় লাগাম দিন- অনুরোধ দু’পক্ষকেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্রেফ আপনাদের চর্মে ঘি যোগালেও সিলেটবাসীর আবেগ অনুভ‚তি আর দীর্ঘ সংগ্রামের অনিবার্য অংকার। ত্যাগী এই মানুষগুলোর আবেগ অনুভুতি আর অহংকারে আঘাত করা সমুচিন হবেনা।

লেখক: শামসুল ইসলাম শামীম, সিলেট ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন