আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মৌচাক হায় একলা আজি!

::শামসুল ইসলাম শামীম::

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০১-১৯ ০০:০৮:০৬

দুপুর থেকেই বুকর খুব গহীণে, খুব ’একলা’ কোথাও একটা চিনচিনে ব্যাথা ঠাহর করছি। ব্যাথাটা ঠিক কেন তা পুরোদস্তুর আয়ত্বে আনতে না পারলেও ’হঠাৎ একলা’ হওয়া একজন ব্যস্ততম মানুষের একলাবোধটাই এই ব্যাথার কারন বলে মনে হয়!

পেশাদারিত্বের কর্তব্য পালন ছাড়া তার কাছে যাওয়া হয়নি কখনোই, কিন্তু কোথায়, কেমন করে যেনো এই মানুষটির জন্য একটা ভালোলাগার আবেশ তৈরী হয়ে গিয়েছে নিজের অজান্তেই। তার কাছে আমার কোন স্বার্থ ছিলোনা কখনোই। তার কাছে এক ঈদের সকালে ’ঝাড়ি’ খেতে হয়েছিলো আমাকে! কিন্তু অবাক করা ব্যপার হলো এই ’ঝাড়ি’ হজম করার পর তার প্রতি উষ্মা বা বিদ্বেষ জন্মানোর বদলে ’প্রেম’ জন্ম নিলো! এই মানুষটিকে আমার কাছে কখনো একটা চলমান পাঠাগার, আবার কখনো অর্থনীতি বিষয়ের একটা বিশ্ববিদ্যালয় বলে মনো হয়! আমি তার কাছের মানুষ ছিলাম কখনোই, কিন্তু তাকে আমি খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছি একাধিকবার।

তার যেমন জ্ঞানক্ষুধা আছে, তেমনি কখনো কখনো এই ক্ষুধা নিবারণের অমৃত হয়ে যান তিনি নিজেই। আমার খুব মনে আছে, তখনো মন্ত্রণালয়ে যাননি তিনি। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ব্যস্ত মানুষ তিনি। তখন ’আড্ডা’ নামে সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি ছোট কাগজ সম্পাদনা করি আমি। দিনক্ষণ মনে নেই। একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যেগ নিয়েছি, পরামর্শের জন্য তখন গণমানুষের কবি দিলওয়ার এবং মুসলিম সাহিত্য সংসদের তৎকালীণ লাইব্রেরিয়ান মনির ভাইর দরজায় আমি ছিলাম ’নিতভিখারী’! বাপের কড়ি খরচ করে বিনা বিজ্ঞাপনে প্রকাশিত হতো আড্ডা’র প্রতিটি সংখ্যা। তাই পরামর্শকদ্বয়ও পরামর্শ দিতেন বিনাকড়িতে! এমনই অবস্থায় প্রকাশিতব্য সংখ্যার জন্য কার কার লেখা চাওয়া যায়-এমন এক পরামর্শে মনির ভাই বললেন, ’পারলে মুহিত সা’বের লেখা যোগাড় করো।’ তরুণ বয়স, লোহা চিবিয়ে খাওয়ার মর্দামী শক্তি শরীরে! শুরু হলো অভিযান! মনির ভাই এই অভিযানের নাম দিয়েছিলেন ’মুহিত আবিষ্কার অভিযান’! একদিন অভিযান ঠিকই সফল হলো। ’বাঙালীর বৈশাখ’ নামে একটি লিখা উদ্ধার করেছিলাম তার কাছ থেকে।

এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষটি একসময় মন্ত্রী হলেন, অর্থমন্ত্রণালয়ের মতো জটিল মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। মন্ত্রী হওয়ার পর একটি বেসরকারী টেলিভিশনের জন্য সিলেট থেকে আমিই প্রথম তার ইন্টারভিয়্যু করি। তারপর থেকে তার কাছে যাওয়া হতো আর দশজন পেশাদার সাংবাদিকের মতো। রাজনীতিতে নামার পর তার প্রথম নির্বাচনের সময় আওয়ামী যুবলীগ নেতা আব্দুর রহমান জামিলের অনুরোধে আমি মুহিত সাহেবের গণমাধ্যম বিষয়টা ক’দিন দেখভাল করি। এখানে কোন স্বার্থের পরাকাষ্ঠা ছিলো না। শুধুই ভালোলাগার যায়গা থেকে এই ’গুরুদায়িত্ব’টুকু পালন করি। সেই জ্ঞানতাপস মানুষটি আজ সিলেট ফিরলেন। অথচ, কোন আড়ম্বর ছিলোনা, ছিলোনা অভ্যর্থনার কোন আয়োজন। নিজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাত ধরেই ঘরে ফিরলেন তিনি। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুহিতের এই ফেরার প্রেক্ষাপটটা খুব বেশি ’স্বাভাবিক’ মনে হয়নি আমার কারেছ। শুক্রবার দুপুরে নভোএয়ারের একটি ফ্লাইটে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেন মুহিত। এই ক’দিন আগেও মন্ত্রীসভায় যার দুর্দÐ প্রভাব ছিলো।

যার ’হুঙ্কার’-এ প্রায়ই কম্পমান হতেন অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-ককর্মচারী থেকে শুরু করে দলীয় নেতৃণমূল নেতাকর্মীরাও। যার ’হুঙ্কার’-এর জবাব মাঝে-মধ্যে বিরোধীদলকেও দিতে হতো, মুখ টিপে গণমাধ্যমকর্মীদেরও এই ’হুঙ্কার’ হজম করে নিতে হয়েছে! ওসমানী বিমানবন্দরে গতকাল ’প্রায়ই শোনা’ সেই হুঙ্কার ছিলোন! ছিলোনা ঝাঝাঁলো শ্লোগাণ, মিছিলে-মিছিলে প্রকম্পিত হয়নি বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ। লাউঞ্জের ভিতরে-বাইরে ছিলোনা মুহিতের তথাকথিত ’কাছের মানুষ’দের হুড়োহুড়ি-ঠেলাঠেলি! একেবারে নিরিবিলি, অনেকটা নির্জনে বিমানবন্দর ছাড়েন ক্ষমতাসীন দলের এই বর্ষিয়ান নেতা। বিমান থেকে নেমে সিলেটের মাটিতে পা রেখেই সাবেক এই অর্থমন্ত্রীর স্বভাবসুলভ ’অনসিন্ধিৎসু’ চোখজোড়া এক লহমায় ঘুরে আসে পুরো বিমানবন্দর এলাকা! কিন্তু নাহ! ’কোথাও কেউ নেই’! ভিআইপি লাউঞ্জের বিরাণ অভ্যন্তর আর ’শুণ্য’ বহিরাঙণ ডাকসাইটে এই নেতাকে হয়তো মুহুর্তকয়েকের জন্য হতবাক করেছিলো! এই ’বিরাণ সভ্যতা’ হয়তো গুটিকয়েক মুহুর্তের জন্য তার হৃদয়কে বেদনাদ্র করেছিলো! ’অচেনা’ এই নীরবতা কিছুসময়ের জন্য হলেও হয়তো ’রাজনৈতিক বাস্তবতা’র দীক্ষা দিয়েছে সাবেক এই মন্ত্রীকে।

দেশের বাজেট ঘোষণায় রেকর্ড ভাঙ্গার দ্বোরগোড়ায় এসে অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অবসর নেয়া এই অর্থনীতিবিদ একাধিকদফায় ক্ষমতাসীন সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি এরশাদ সরকারেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী মুহিত যখনই সিলেট এসেছেন, তখনই তাকে দলীয় নেতাকর্মীদের মিছিল-শ্লোগাণ আর চেনা ’কাছের মানুষ’দের মধ্যমণি হয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে। অথচ, মন্ত্রীসভা থেকে অবসর নেয়ার পর সময় পেরিয়েছে আঙুলের দাগগোণা মাত্র ক’টি দিন। এরই মধ্যে তিনি এতোটা ’নি:সঙ্গ’ হয়ে যাবেন, হয়তো তিনি নিজেও ভাবেননি কখনো। এই ’রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় দাঁড়িয়ে সাবেক এই মন্ত্রী ’কাছের মানুষ’ চিনতে কি ভুল করেছিলেন? বিমান থেকে নেমে সাবেক এপিএস জনিকে সাথে নিয়ে হুইল চেয়ারে করে রানওয়ের ’ধুসর প্রান্তর’ পাড়ি দেন মুহিত। তার হুইলচেয়ারটি ধরার জন্য তখন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া আর কাউকেই পাওয়া যায়নি! খাঁখাঁ ভিআইপি লাউঞ্জ তার শুন্যতার দাঁত দেখিয়ে সাবেক এই অর্থমন্ত্রীকে উপহাস করেছিলো কি? ভিআইপি লাউঞ্জ পেরিয়ে মুহিত সরাসরি যান স্টেডিয়ামে, সেখানে বসে অখন্ড অবসরে থাকা এই অর্থনীতিবিদ নিজের দলের খেলা উপভোগ করেন।

এখানেও তার হুইলচেয়ার ’ঠেলতে’ দেখা গেছে জনৈক কর্মচারীকে। ’এখানে-ওখানে’ কোথাও দেখা যায়নি চেনা কোন ’মৌয়াল’কে! সেই মৌয়ালেরপাল যখন বুঝে গেছে এই চাক থেকে আর মধু পাওয়া যাবেনা, তখন তারা নিজেরাই চাক ভাঙ্গার শ্রমে রণেভঙ্গ দিয়েছে! মৌচাক হায় একলা আজি! নি:সীম শুণ্যতায় বসে ’কাছের মানুষ’দের কি চিনতে পেরেছেন এই বুদ্ধিজীবী? স্বার্থের রসবোধক অংকের যোগফল মিলিয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই অর্থনীতিবিদ?


লেখক: শামসুল ইসলাম শামীম, সিলেট ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন