আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ইং

সিলেটের থিয়েটারপাড়া এবং সবিনয় নিবেদন

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৯-০১-২২ ০০:০০:০৩

শামসুল ইসলাম শামীম :: চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ‘আলকাপ লোক গান’ বা ‘আলকাপ পালা গান’ বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের দুশো বছরের ঐতিহ্য। অঞ্চলভিত্তিক সাংস্কৃতিক এমন ঐতিহ্য রয়েছে প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই। জারী, সারী, কাওয়ালী, মুর্শিদি, ঘাটু-এমন ধাঁচের গান বঙ্গীয় অঞ্চলের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে রেখেছে যুগের পর যুগ। স্থান কাল পাত্র ভেদে আমাদের মৌলিক সংস্কৃতির অনন্য এই অনুষঙ্গগুলো যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য সংশ্লিষ্টরা চেষ্ঠা-তদবিরও কম করছেন না। সুযোগে এমন ধারার সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গকে নিয়ে আসা হয় মঞ্চের মধ্য আলোয়। সংস্কৃতিপ্রেমিরীও মঞ্চের সামনে এসব আয়োজনে বুঁদ হয়ে থাকেন।

সোমবার সন্ধ্যায় সিলেট কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে মঞ্চায়ন হলো 'আলকাব পঞ্চরস'-এর। 'নাট্যমঞ্চ সিলেট'র আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে 'প্রথম জাতীয় লোক নাট্য উৎসব'। ২০ থেকে ২৮ জানুয়ারী অনুষ্ঠিতব্য এই আয়োজনের প্রতিপাদ্য 'লোকবাংলার আহ্বানে মঞ্চ জাগাও জয়গানে'। চিরায়ত বাংলার লোকসংস্কৃতির প্রতি যাদের দুর্মর প্রেম তাদের পক্ষে এই আহ্বাণে সাড়া না দিয়ে গত্যান্তর কি!

আমি থিয়েটার কর্মী থেকে থিয়েটারপ্রেমি! মানে এখন স্রেফ এক নাদান দর্শক। সিলেটের থিয়েটার পাড়ায় মঞ্চ আলোকিত হবে, আর আমি সেখানে দর্শক হবো না- এমনটি আমার জন্য দুর্ঘটনার মতো! থিয়েটারের একজন 'নিতভিখেরী' হিসেবে আমি যেমন আপ্লুত হই তেমনি কদাচিৎ হতাশও হই। 'আলকাপ পঞ্চরস'র একজন দর্শক হিসেবে আমি হতাশ হয়েছি। জানি, আমার হতাশায় কারো কিছু যায় আসেনা। না আয়োজক, না প্রযোজক; কেউই টু' শব্দটি করবেন না! এসব মহারতিদের ঠিকিটির নাগাল পাওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই।

'আলকাপ পঞ্চরস'র মূল্য প্রতিপাদ্য ছিলো 'ভ্যাসেকটমি'। পরিবার পরিকল্পনার আওতায় পুরুষের জন্য স্থায়ী বন্ধ্যত্বকরন পদ্ধতিই এই ভ্যাসেকটমি। ভ্যাসেকটমিতে ছোট অপারেশনের মাধ্যমে শুক্রবাহী নালীর কিছু অংশ বেঁধে কেটে ফেলে দিয়ে বা কটারী করে স্থায়ীভাবে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাকে বন্ধ করে দেয়া হয়। পুরুষদের স্থায়ী পদ্ধতি বাংলাদেশে ‘ভ্যাসেকটমি’ বা ‘পুরুষ-বন্ধ্যাকরণ’ নামে অধিক পরিচিত। ইদানিং ছুরি ব্যবহার না করে একটি ছোট ছিদ্র করে এই অপারেশনটি করার ফলে এটি নন স্কালপেল vasektomy বা ‘এনএসভি’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে । অদূর অতীতে বাংলাদেশে এই পদ্ধতিটি জনপ্রিয় করতে মাঠ পর্যায়ের পরিবার পরিকল্পনাকর্মীদের ঘাম ঝরাতে হয়েছে। নগদ টাকার বিনিময়েও শেষ পর্যন্ত এই কর্মসূচি লক্ষ্যের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি বলে মনে হয়।

এই ভ্যাসেকটমিকে মূল উপজীব্য করে সফিকুল সরকার ও তার দল মঞ্চায়ন করে 'আলকাপ পঞ্চরস'। পরিবেশনাটি আসলে কোন পর্যায়ে পড়ে তা আমার 'মুর্খ দর্শক'র মনে প্রশ্নই থেকে যায়। যাত্রাপালা, মর্ডান ড্যান্স', নাটক; কোন অভিধায় পড়ে এই পরিবেশনা তা আমার বোধগম্য হয়নি! প্রায় ১ঘন্টা ১০ মিনিটের পুরো পরিবেশনাজুড়ে একমাত্র নারীচরিত্র রূপায়নকারী পুরুষের সাজ-সজ্জা আর নাচ উপস্থিত দর্শকদের 'ত্রাহি-ত্রাহি' অবস্থায় ফেলে দিয়েছিলো, অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। পুরো পরিবেশনায় 'মাগি' শব্দটা মোট কতোবার উচ্ছ্বারিত হয়েছে তা গুণে দেখার দাবী রাখে। ব্যাকরণগত কারনে 'মাগি' শব্দটির ভিন্ন অর্থ থাকলেও লোকমুখে প্রচলিত এই শব্দটি ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে, বিষয়টি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের মাথায় রাখা উচিত ছিলো।

সিলেটের থিয়েটার পাড়া আমাদের আবেগ-অনুভুতি আর অহংকারের একটি ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রটি যেনো কোনভাবেই আমাদের হতাশ না করে- এ ব্যাপারে আন্তরিক হওয়ার জন্য সিলেটের থিয়েটার পাড়ার মহারথিদের প্রতি আমার এই সবিনয় নিবেদন।

অতিসম্প্রতি এই অডিটোরিয়ামে মঞ্চায়ন হয়েছিলো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের এক কিংবদন্তি পুরুষের জীবনালেখ্য ভিত্তিক নাটক। 'নাচে গানে ভরপুর' সেই নাটকটি আমাকে রীতিমত হতবাক করেছিলো। একজন কঠিনপ্রাণ জমিদারের চরিত্র যেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো যৌনাসক্ত, ভুমিলুটেরা ভাঁড় হিসেবে। মর্মাহত হতে হয়, থিয়েটার আন্দোলন যেখানে সিলেটের থিয়েটার পাড়ার গৌরবোজ্জল ভূমিকা রয়েছে সেখানে মাঝেমধ্যেই কেন এই হতাশার প্রদশর্নী?

সিলেটের থিয়েটারগুলোর প্রযোজনা আর পরিবেশনার যে চমৎকৃত পরিবেশনা রয়েছে তার পাশাপাশি এসব 'ত্যানাটানাটানি' পরিবেশনা আমাদের থিয়েটার আন্দোলনে সফলতা নয়, গ্লাণি যোগ করছে। থিয়েটারের দর্শকরা কিন্তু সিনেমা বা যাত্রাপালার দর্শক নন। সিনেমা বা যাত্রাপালায় ভ্যাম্পগার্লরা কাহিনীর ফাঁকফোকরে দর্শকদের রস যোগাতেন। সেই সুড়সুড়ি দেয়া রসের যোগান কেন থিয়েটারের মঞ্চ কলুষিত করবে? থিয়েটারের পরিবেশনায় কখনো দেখিনি একজন আর্টিস্ট তার ডায়লগ থামিয়ে 'হ্যালো-হ্যালো' বলে ফুঁ দিয়ে মাইক্রোফোন টেস্ট করতে! আলকাপ পঞ্চরস'-এ তা-ই দেখলাম! নতুন অভিজ্ঞতা যোগ হলো বৈকি!
আমাকে যতোখুশি গালমন্দ করুন আপত্তি নেই, শুধু আমার সবিনয় নিবেদনটুকু কৃপা করে একটু ভেবে দেখুন।

লেখক: শামসুল ইসলাম শামীম, সিলেট ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন