সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০১-২১ ১৬:০৩:৩৫
লিনু ফারজানা ::
(খান জাহান আলি মিয়া)
নিজের জ্বলজ্যান্ত সুস্থ মা ও কিছু নিকটাত্মীয়কে কয়েকদিন পর পর ছারকাতে (মৃত্যু যন্ত্রণায়) রেখে আমাদের ড্রাইভার খান জাহান আলির চাকুরি জীবনের দশম বছর পার হলো আমাদের সাথে।
অন্যান্য আত্মীয়ের কথা নাই বা বললাম, খান জাহান আলীর মা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন, এমনকি সুস্থও আছেন।
আকস্মিক যায় যায় দশা খান জাহান আলিকেও আক্রমণ করে।
মূমুর্ষ দশা থেকে তুতলায় তুতলায় ফোন দেয়, মামানি আমার শরীল খুব খারাপ, একেবারে যায় দশা, আইজকা আইতে পারতাম নায়।
এতটুকু বলার জন্য তাকে রাত্রিব্যাপী রিহার্সেল করা লাগেনা, যখন তখন কাতর কণ্ঠে সে তার অসুখের কথা বলতে পারে।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেই সেরেছে। সর্বাঙ্গে ব্যাথার ফিরিস্তি শুনে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও দাওয়াই দিতে নির্ঘাত অকূলে পড়বেন।
আমি নিজ দায়িত্বে বুঝে নেই এই যায় দশা নামক দুরারোগ্য ব্যাধি জলদি সারবেনা। ভোগাবে সপ্তাহ খানেকের বেশি। কখনো কখনো ভোগান্তি আবার স্বল্প মেয়াদেই শেষ হয়ে যায়। সবকিছু নির্ভর করে খান জাহান আলির প্রয়োজন ও পরিস্থিতির উপর।
বেশিরভাগ সময় আমার অনুমানের কানাকড়িও মিথ্যা প্রমাণিত হয় না। যায় দশা খান জাহান আলিকে আক্রমণ করে না, করে আমাকে।
তার অনুপস্থিতি জনিত যাবতীয় দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে রিক্সার উপর কেটে যায় মোটামুটি চার প্রহর। শরীরের নাটবল্টু খুলে না পড়লেও ঢিলা হয়, মেজাজও হয় চরম খিটখিটে।
চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, এইবার খান জাহান আলি মিয়ার চাকুরী নট।
নিজ দায়িত্বে পদত্যাগ পত্র রেডি করে রাখি, আসা মাত্র টিপসই নিয়ে আলাইকুম সালাম বলে আলবিদা জানাবো।
সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত, হাকিম নড়বে তো হুকুম নড়বে না।
ইতিমধ্যে তার সহকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট উপযুক্ত প্রমাণ সহ হাতে পৌছে যায়। অসুখের কথা বলে সে চিত্তসুখে দিনাতিপাত করছে।
তার নিজের কোন একটা বোকামির কারণেই তদন্ত কমিটি হাতে আসা শক্ত প্রমাণ আরেকটু পোক্ত হয়।
মিছামিছি যায় দশা থেকে আরোগ্য লাভ করে কুকাতে কুকাতে একদিন খান জাহান পুনরায় কাজে যোগদান করে।
তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সাথে খান জাহানের জবানবন্দির কোন মিল নেই। তার মুখে দুর্দশার বর্ণনা শুনে দুর্দান্ত পাষাণ হৃদয়ের মহিলা আজবেলা ও মালেকা হামিরার মন গলে কাঁই হয়ে যাবে। মালেকা হামিরার পিসতুতো, মাসতুতো কোন সম্পর্কীয় ভগ্নি হিসেবে আমারও দিল গলে ল্যাটলেটা। সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারি না। মাফ করে দেই খান জাহান আলিকে।
মিথ্যা বলায় পারদর্শী হলেও অকারনে মিথ্যা বলে খানজাহান যে কতবার বিপদে পড়েছে তার হিসেব নেই।
২০১৩/১৪ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দেশ খুব উত্তপ্ত। জামায়াত ইসলামীর নেতাদের ফাঁসি নিয়ে ঘন ঘন হরতাল ডাকা হচ্ছে।
এর মধ্যে শুরু হয়েছে জঙ্গি দমন তৎপরতা।
কোন এক হরতালের আগের রাত্রে অব্যাহত চিরুনি অভিযানের অংশ হিসেবে পুলিশ হানা দিয়েছে চিকনাগুল বাজার ও মাদ্রাসায়। খান জাহান আলি মিয়া দীর্ঘমেয়াদী হরতাল উদযাপন করতে একটা বিরাট পরিকল্পনা করে রেখেছেন। ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা ফুর্তির অংশ হিসেবে এক দোকানে বসে লুডু খেলায় ব্যস্ত।
বেরসিক পুলিশের আকস্মিক তাণ্ডবে লুডু খেলা খালি পণ্ড হলনা, অর্ধশত লোককে জামায়াত কর্মী বানিয়ে পুলিশের গাড়িতে তোলা হলো।
স্থানীয় গন্য মান্য ব্যক্তিদের সুপারিশে তাৎক্ষনিকভাবে কয়েকজনকে সাথে সাথে ছেড়ে দেয় পুলিশ। কিন্তু সম্ভাব্য সন্ত্রাসীর তালিকাভুক্ত করে খানজাহান কে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় জৈন্তাপুর থানায়। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত আসামিকে গাদাগাদি করে গরাদে রাখা হয়। ভোরের আলো ফুটলেই কোর্টে চালান দেয়া হবে।
খান জাহান আলি যে পুলিশের জালে আটকা পড়েছে তার পরিবার সেটা জানেনা। অনেক রাত পর্যন্ত বাড়ি না ফেরায় বউয়ের খবর হয়, তার গুনধর জামাই গেলো কই?
শিশুপুত্রকে সাথে নিয়ে বেচারি বউ তারে খুঁজতে বাজারে যায়। খান জাহান আলি মিয়া এই এলাকার নতুন বাসিন্দা। সবাই তাকে চিনেও না। তবুও অনুমানের উপর সবাই জানিয়ে দেয়, খান জাহান আলীকে পুলিশ ধরেছে।
মধ্যরাতে খান জাহানের বউয়ের ফোন পেয়ে আমরাও চিন্তিত, আসলেই কি পুলিশ ধরেছে? নাকি অন্য কোন ঘটনা। বউও বেশি কিছু বলতে পারছে না।
প্রথমে শাহপরান থানায় পরে জৈন্তা থানায় খবর নেয়া হলো। কোথাও খান জাহানের খবর নেই। এইদিকে নিখোঁজ স্বামীর খোঁজে আর ক্রসফায়ারের ভয়ে খান জাহানের উৎকন্ঠিত বউ খুব ভোরে বাসায় এসে হাজির।
বউয়ের কান্না ও বিলাপে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে আমাদেরও বেদিশা অবস্থা। এরমধ্যে মহিলার কান্না থামানো যাচ্ছে না।
আসলেই কিছু না বলে খান জাহান গেল কই?
থানা পুলিশ শেষ করে পুত্র কন্যাদের বাবা কোর্টে গেলেন।খবর এসেছে সব আসামীকে কোর্টে তোলা হবে আজকে।
স্বস্তির কথা অনেক আসামীর ভীড়ে আমাদের খান জাহান আছে। কিন্তু আসামীর তালিকায় খান জাহানের নাম নেই।
অনেকের জামিন হলেও তালিকায় নাম না থাকার কারনে সেদিন খান জাহানের জামিন হলোনা। কোমরে দড়ি বাঁধা খান জাহান আছে চোখের সামনে, অথচ তার নাম নেই আসামির তালিকায়।
কি একটা জটিল অবস্থা।
সারা দিন কোর্টের এ মাথা ও দৌড় ঝাঁপ করে পুত্র কন্যার বাপ পুরো হতাশ। দাগী আসামিদের সাথে আমাদের খান জাহান আলিকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হচ্ছে। তার লুডু খেলার সাথীদের সবার জামিন হয়েছে কিন্তু তার হলো না। অথচ ধৃত আসামির তালিকার চিপায় চাপায় তার নামই নেই।
উকিল ঠিক করে জামিনের আবেদন করলেন পরের সপ্তাহে। কেচো খুঁড়তে গিয়ে মাটি সাপ একটা বেরিয়ে আসলো। জানা গেল শাহ আলম নামে এক আসামীর নাম আছে, কিন্তু গরাদে আসামির অস্তিত্ব নেই। খান জাহান নামে আসামি আছে কিন্তু তালিকায় নাম নেই।
পরের দিন পুত্রকন্যার বাবা জেলখানায় গিয়ে খান জাহান আলীর সাথে দেখা করলেন। সাথে নিয়ে গেলেন তার শালাকে। কথায় কথায় আসল খবর বের হলো। গ্রেফতারের পর আমাদের করিৎকর্মা খান জাহান আলী পুলিশকে নিজের নাম বলেছে শাহ আলম।
পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার ফন্দিতে সে এই মিথ্যা কথাটা বলেছে। তার ধারণা ভুল নাম বললে তাকে জেলে যেতে হবেনা।
অতি চালাকের গলায় দড়ি। নামের ভুলে আইনি জটিলতায় জড়িয়ে তার জামিন আটকে যায়।
জেলখানার সম্বল থালাবাটি কম্বল।
চোখের জল, নাকের জল এক করে অনেক দিনের জন্য তার জায়গা হয় শ্রীঘরে।
প্রতিবার তার মামা মানে আমার পুত্রকন্যার বাপ দেখা করতে গেলেই সে হাপুস নয়নে কান্নাকাটি করে। মামা আমারে বাইর করেন, আমি কান ধরছি, জীবনেও লুড্ডু খেলাইতাম নায়।
লুডু খেলার অপরাধে নয় স্বভাব সুলভ মিথ্যা বলার অপরাধে আজ তার এই অবধারিত গর্দিশ।
আবারও আঁটি আঁটি কাঠখড় জ্বালিয়ে ছাঁই কয়লা বানিয়ে দীর্ঘ চার মাস গারদ বাসের পর তার একসময় জামিন হয়। কিন্তু হরতালে নাশকতা সৃষ্টির কারণে দায়েরকৃত মামলা আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি।
"একের ভেতর দুই"। পুলিশ বাদি হয়ে তার নামে মামলা দিয়েছে দুটো।
দুইটা মামলা ঘাড়ে নিয়ে প্রতিমাসে অন্তত একবার তাকে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়।
তারপরও অকপটে মিথ্যা বলা ও আগুলঠাইয়্যামি তার থেমে নেই। ইচ্ছায় হউক আর অনিচ্ছায় হউক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ তার পিছু ছাড়েনা। কিছু বিপদ থেকে টেনে তুলতে আমাদের ঝক্কি পোহাতে হয় অনেক। প্রতিবারই জোরেশোরে তার চাকুরি নটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু অনুনয় বিনয়ের পর আবারও রাখতে হয়।
(চলবে)