আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বিতর্কের সমাধান বিতর্কেই…

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০১-৩১ ১১:৩৩:৪২

ফেরদৌস আব্বাস চৌধুরী :: সাধারণত কোন বিষয়ের সাথে কোনরুপ বিতর্ক বা তর্ক শব্দের অবতারণা ঘটলে অনায়সে অনেকেই ঘাবড়ে যান কিংবা দিব্যি আতংকিত হয়ে পড়েন।মূলত দৈনন্দিন জীবনে সকল প্রকার বিতর্কের ঊর্ধে থাকার প্রয়াস সকলের ই কম বেশী থাকে।এই বিতর্ক শব্দের আভিধানিক অর্থের খোঁজ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে কোন একটি বিষয় কে কেন্দ্র করে যুক্তির সহিত তা উপস্থাপন বা মীমাংসায় পৌঁছানোর প্রচেষ্টাকে বুঝায়। অর্থাৎ বিতর্ক মানে কোন বিশেষ তর্ককে বোঝায়।

তর্কে যুদ্ধে অবতীর্ণ তার্কিকগণ নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে যতটা যুক্তির প্রয়োজন তা উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের সকল তর্ক জ্ঞানকে পরাস্ত করে নিজেদের এজেন্ডা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন ততটা সুবিধাজনক অবস্থানে সে ও তার দল থাকবে। আপাতত দৃষ্টিতে এর মধ্য দিয়ে এক পক্ষের জয় ও অন্য পক্ষ্যের পরাজয় নির্ধারিত হয় তাদের যুক্তি উপস্থাপন ও বিষয়বস্তুর পর্যালোচনার পারদর্শীতার উপর।

তবে প্রকৃতপক্ষে যুক্তির এ যুদ্ধে উভয় পক্ষ্যের জয়-পরাজয়কে ছাপিয়ে জয় হয় বিতর্ক চর্চার যা অমীমাংসিত বিষয়ের শান্তিপূর্ণ সমাধান এনে দেয়। দেশ-বিদেশে বিদ্যমান ও চলমান নানা বহুমূখী সমস্যার সমাধান বিতর্কের আয়োজনের মধ্য দিয়ে সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস।বিতর্কের টেবিলে কিংবা মঞ্চে উভয় পক্ষের চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ এক দিকে যেমন জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে অন্যদিকে উত্থিত নানা বিতর্কের“ক্লিননেস” বিষয়টিও প্রতিষ্ঠিত করবে।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সুষ্ঠু ধারা অব্যাহত রাখতেও “ওপেন ডিবেট” বা মুক্ত সংলাপের কোন বিকল্প নেই। তৃতীয় বিশ্বের দেশ বাংলাদেশের প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষাপট নিয়ে একটু ভাবলেই হয়তো অনেক সমস্যা, সমালোচনা আর তা নিয়ে জটলা বাঁধা নানা বিতর্কের চূড়ান্ত কনক্লুশনে যেতে হলে বর্তমান সময়ে ওপেন ডিবেট বা বিতর্ক আয়োজনের মোক্ষম সময় বলে আমি মনে করি।

সামনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাকে পূঁজি করে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছে। উপমহাদেশের রাজনীতি নিয়ে গবেষনা করলে একটা বিষয় স্পষ্ট এখানে নির্বাচনকে ঘিরে সকল দলের ভেতর একপ্রকার ট্রাস্টনেসের অভাব পরিলক্ষিত হয়।বাংলাদেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচনকে ঘিরে বহুদিন যাবত বিশ্বাস ও আস্থার সংকট রয়েছে ,যা দিনকে দিন বেড়েই চলছে।সরকার কিংবা বিরোধী দলের নানা কর্মকান্ডের সাথে নানা বিতর্ক সারা বছরই রাজনৈতিক অঙ্গনকে রাখে উত্তপ্ত।

বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সময়ে বিতর্কের উত্তাপ যেন হাজারো ডিগ্রির সেলসিয়াসকেও হার মানায়। নির্বাচন কে কেন্দ্র করে দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। শুধু তাই নয়, দেশের নির্বাচন কমিশনের গঠনতন্ত্র ও তার কার্যবিধি নিয়েও উঠে নানা প্রশ্ন। নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাবে দেখা দেয় চরম সংকট। বিশ্বাস-আস্থা আর দলগুলোর ভেতর সংলাপের অভাবে কোন কোন সময় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বয়কট বা নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখে।ফলশ্রুতিতে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সুষ্ঠ ও মসৃণ ধারা হয় ব্যাহত আর বিদ্যমান সমস্যাগুলো হচ্ছে আরো ঘনীভূত।

তবে এক্ষেত্রে বৃহৎ রাজনৈতিক দল তথা দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ওপেন ডিবেট বা মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা গেলে ঘনীভূত সমস্যাগুলো কিঞ্চিৎ হলেও শীতল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরা যাক, প্রেসিডেন্ট  নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীগণ তাদের নিজ নিজ দলের হয়ে এক ওপেন ডিবেটে তাদের দলীয় এজেন্ডা জনগণের সামনে পেশের মাধ্যমে নির্বাচনী ঝান্ডা তুলে ধরেন। টিভি বিতর্ক বা মঞ্চ বিতর্কে তারা নিজ দলের নানা কর্মকান্ড, প্রতিশ্রুতি এবং নির্বাচনী ম্যান্ডেট যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে তুলে ধরার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ দলের নানা কর্মকান্ড নিয়ে সমালোচনা ও বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যমান বিতর্কগুলোকে উসকে ফায়দা লুটার প্রাণপণ চেষ্টা করে যান প্রার্থীবৃন্দ।

উদাহরণস্বরূপ,মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্রের ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসের ইউনিভার্সিটি অব নেভাডায় ফক্স নিউজের প্রেজেন্টার ক্রিস ওয়ালেসের সঞ্চালনায়, প্রায় দেড় ঘণ্টার এক বিতর্কে অবতীর্ণ হোন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারী ক্লিনটন।উভয় প্রার্থী প্রায় ৪০ মিনিট করে সময় পান তাদের প্রতি উঠা নানা অভিযোগ এবং বিতর্কগুলোর বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন ও যুক্তি খন্ডনের।

তবে এর পূর্বে তারা আরো দুটি বিতর্কে অংশগ্রহণ গ্রহণ করেন। তার ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্ক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর তৃতীয় ও শেষ টেলিভিশন বিতর্ক। যেখানে বিতর্ক হয় দুই দলের সেয়ানে-সেয়ানে এবং সমানে-সমানে। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত এই বিতর্কের পর সিএনএন ও ওআরসি-র করা এক তাৎক্ষণিক জরিপে হিলারি জয় পেলেও চূড়ান্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কিন্তু জয় লাভ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম টিভি বিতর্ক শুরু হয় আজ থেকে ৫৬ বছর আগে।

১৯৬০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নেন জন কেনেডি ও রিচার্ড নিক্সন। তবে ১৮৫৮ সালের লিংকন-ডগলাস বিতর্ককেও আধুনিক বিতর্ক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় যেখানে আব্রাহাম লিঙ্কন ও স্টেফিন ডগলাস একটি সিনেট আসনে ইলিনয়ের বিভিন্ন শহরে দিনব্যাপী সিরিজ বক্তৃতা করেন। মূলত এই বিতর্ক আয়োজন গণতন্ত্র শাসন ব্যবস্থায় এক প্রকার স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে তাই এই বিতর্ককে গনতন্ত্রের মণিস্বরুপ হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে।আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এরুপ বিতর্ক আয়োজন বিদ্যমান নানা সমস্যার মীমাংসা এনে দিতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

সেটা নির্বাচনকালীন সময়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মধ্যেও হতে পারে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ নেতাদের মধ্যেও অনুষ্ঠিত হতে পারে।এতে এক দিকে যেমন গণতান্ত্রের সুষ্ঠু চর্চার পথ মসৃণ হবে অন্যদিকে নির্বাচন কালীন নানা সমস্যা ও তা নিয়ে উত্থিত নানা বিতর্কের অবসানও ঘটবে।তাছাড়া সরকারের নানা মেগা প্রজেক্ট যেমন পদ্মা সেতু ও কয়লা ভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে উত্থিত নানা বিতর্ক নিয়ে ওপেন ডিবেটের আয়োজন করা যেতে পারে যেখানে প্রকল্পের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে যেমন জনগণ জানতে পারবে অন্যদিকে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা সরকারের জবাবদিহিতার জায়গাও সৃষ্টি হবে।শিক্ষাব্যবস্থায় প্রশ্ন ফাঁসের মত সেনসেটিভ বিষয়ে কিভাবে মনিটরিং বাড়ানো যায় এবং তা রোধ করা যায় তাতেও বিতর্ক চর্চা এক বিরাট “ফ্যাক্টর” হিসেবে কাজ করতে পারে।শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্তে হত্যা বন্ধ, জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষা ও তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ন্যায্য হিস্যা আদায় বা রোহিংগা ইস্যুর মত জায়গায় প্রোপার নেগোসিয়েশন প্রয়োজন আর তাতে প্রকৃত “Track” নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এ বিতর্ক চর্চা। বলা বাহুল্য যে, যেকোন সমস্যার মাঝেই তার সমাধান নিহিত থাকে সেরূপ সকল প্রকার বিতর্কের সমাধান সম্ভব বিতর্কেই…

 লেখক: ফেরদৌস আব্বাস চৌধুরী
সাবেক সহ-সভাপতি, লিডিং ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং ক্লাব।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন