আজ বুধবার, ০৮ মে ২০২৪ ইং

বড়লেখায় এক পরিবারে ১৪ শিক্ষক

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৩-০৬ ১৯:০০:১০

সাইদুল ইসলাম :: শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষকরাই জাতি গড়ার কারিগর। তাইতো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘরে ঘরে শিক্ষিত মানুষ তৈরির এক অপ্রতিরোধ্য প্রত্যয় নিয়ে রোজ সকালে বেরিয়ে পড়েন স্বর্না দেবী(২৮)। কখনো রিক্সায় আবার কখনো হেঁটে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌছে যান কলাজুরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর অন্যরকম এক ভাললাগা কাজ করে। কারন তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা এ বিদ্যালয় থেকেই শুরু এবং সময়ের ব্যাবধানে আজ তিনি এই স্কুলেরই শিক্ষক। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় স্বর্না দেবী ২০১৪ সালে  সিলেটের মদনমোহন কলেজ থেকে ব্যাবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স সমাপ্ত করে শিক্ষকতার মত মহান পেশায় নিজেকে জড়িয়ে নেন।

বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার চা বাগান ঘেঁষা গ্রাম জ্যোতিরবন্দে। তাঁর মা প্রতিভা রাজকুমারী , বাবা কুঞ্জেশ্বর সিংহ,বোন সোমা দেবী, চাচা রামচন্দ্র সিংহ,চাচী সাইরেম বেনু দেবী ও চাচাত ভাই সঞ্জয় কুমার সিংহ সহ পরিবারের ১৪ জন সদস্য শিক্ষকতার মত মহান পেশায় জড়িত। বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এ পরিবারের সদস্যরা অত্র অঞ্চলে শিক্ষার অালো ছড়িয়ে চলেছেন আপন মহিমায়।

স্বর্নার চাচা রামচন্দ্র সিংহ জানান, ১৯৭৫ সালে মাসিক ১০ টাকা বেতনে টিউশনি শুরু করে টানা ২২ বছর টিউশনি করেন। পরবর্তীতে দক্ষিণভাগ নবীন চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে জাতি গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি বলেন, তিনি একজন শিক্ষক হিসেবে জাতি গড়ায় শামিল হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করেন। রামচন্দ্রের স্ত্রী সাইরেম বেনু দেবী সিলেটের মংলোবাজার শরীফপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি শ্বশুর বাড়ির নিকটস্থ কলাজুরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে চলে আসেন। এখান থেকে তিনি ২০০৭ সালে দীর্ঘ ২৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ইতি টেনে অবসরে যান। এই দম্পতির বড় ছেলে সঞ্জয় কুমার সিংহ লেখাপড়া শেষ করে বাবা মায়ের মত শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন। ২০০১ সালে দক্ষিণভাগ মেরিট কেয়ার একাডেমী থেকে শিক্ষকতা শুরু করে বর্তমানে রাঙ্গাউটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার বীজ বপন করে চলেছেন। ছোট ছেলে রামেন্দ্র সিংহ এম বি বি এস পাস করে  ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত।

স্বর্নার বাবা কুঞ্জেশ্বর সিংহ ১৯৮১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বর্তমান জুড়ী উপজেলার ছোট ধামাই উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০০ টাকা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৮৬ সালের পহেলা অক্টোবর প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হন।  এবং দীর্ঘ ৩৭ বছর একই স্কুলে শিক্ষকতা করে ২০১৭ সালে অবসরে যান। কুঞ্জের্শ্বর সিংহ বলেন, "মানুষের মধ্যে জ্ঞান বিতরনের পাশাপাশি এ পেশায় সৎভাবে আয় করা যায়, তাই তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা এ পেশাকেই বেছে নিয়েছেন।" তাঁর স্ত্রী প্রতিভা রাজকুমারী ১৯৮৪ সালের পহেলা জানুয়ারি কমলগঞ্জ  উপজেলার মাধবপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন। কুঞ্জেশ্বর সিংহকে বিয়ে করে ১৯৮৮ সালে নিজ গ্রাম কলাজুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে চলে আসেন। সেই অবধি এখনও পর্যন্ত তিনি ছোট ছোট বাচ্চাদের পাঠদানে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। এই দম্পতির ছোট মেয়ে সোমা দেবীও ২০১৬ সালের ২৪শে জানুয়ারি থেকে   উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আসছেন। তাঁদের ছোট ছেলে সন্তোস কুমার সিংহ বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে লেখাপড়া করছেন।

স্বর্নার বড় ফুপুর ৬ মেয়ের সবাই শিক্ষক। বিরতী দেবী দক্ষিণভাগ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, শ্যামলী দেবী জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার  হোমেরজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, অনুকা দেবী সুজানগর বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, নন্দিতা দেবী মাঝের গাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, জোতিকা দেবী ধামাই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও অনুরাধা দেবী আধাকানি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে   শিক্ষকতা করছেন। স্বর্নার আরেক ফুপাতো ভাই সুনীল সিংহ হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

অন্য অনেক পেশা রেখে শিক্ষকতায় কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বর্না দেবী জানান, "পারিবারিক ঐতিহ্য এ পেশায় আসতে আমাকে অনুপ্রানিত করেছে। তাছাড়া মায়ের আদর দিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষার ভীত যখন আমার মাধ্যমে তৈরি হচ্চে, এর চেয়ে গর্বের, ভাললাগার আর কি হতে পারে"? এই শিক্ষক পরিবারের সকল সদস্য বছরে তিন-চার বার বিভিন্ন পারিবারিক বা ধর্মীয় উৎসবে একত্রিত হোন। তখন তারা শ্রেনী কক্ষের পাঠদানের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একে অন্যের সাথে আলাপ আলোচনা করে থাকেন।

এ বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের সদস্য আজিম উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ' এ রকম একটি পরিবার গোটা সিলেট বিভাগে অন্যটি আছে কিনা আমার জানা নেই। এই পরিবারের আমিও একজন ছাত্র এবং এই শিক্ষক পরিবার অত্র অঞ্চলে শিক্ষার আলো যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা এই অঞ্চলের মানুষ আজীবন কৃতজ্ঞতার সহিত শ্রদ্ধায় স্মরন রাখবে'।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন