আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বৈশাখী আবহে গ্রামীণ শৈশব

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৪-১৪ ২১:১২:৪৯



|| সাইফুর রহমান ||
মফস্বলে বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের শৈশব সমৃদ্ধ করে রাখে গ্রামীণ পরিবেশে কাটানো চাঞ্চল্যে ভরা দুরন্তপনা দিনগুলো। আমার শৈশব গ্রামে কেটেছে। সেই সুবাদে গ্রামীণ জীবনের প্রায় সকল রসদ আত্মস্থ করার সুযোগ হয়েছিল। যা আজও স্মৃতিপটে অনুরণন জাগায়। কিছু স্মৃতি মনে হলে এখনো সুখের উদ্রেক ঘটে আবার কিছু কিছু বিদঘুটে স্মৃতি এখনো ভয়ংকর হয়ে ভাসে চোখের সামনে। 

তার মধ্যে কালবৈশাখী ঝড় ছিল  সুখ ও বিদঘুটে ভয়ংকর অনুভূতির মিশ্রিত প্রতিরূপ। এখনও বৈশাখী আবহ যেন তা নিপুণভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়।

কালবৈশাখী ঝড় যখন ক্ষেপে গিয়ে তার যৌবনের সমস্ত শক্তি নিয়ে ধেয়ে আসতো, তখন গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে গাঁওগেরামের মানুষগুলার দৌড়ে বেড়ানোর দৃশ্যপট ভুলবার নয়। উঠোনের কোণায় ধান, কাঁচা আমের আমচুর কিংবা লাকড়ি শুকাতে দেওয়া মা, চাচিদের ব্যস্ততা হুট করে বাড়িয়ে দিত রাগান্বিত ঝড়ের পূর্বাবাস। অকাজের কাজী খেতাবপ্রাপ্ত ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চাই তখন সহায় হয়ে উঠতাম  ।

বাতাস শুরু হতেই বাঁশের লম্বা কঞ্চির ডগায় ব্যাগ বেঁধে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বিশেষ খেলার আয়োজন হতো । যার ব্যাগ আগে থাকবে সেই জয়ি। পুরো দমে ঝড় না আসা পর্যন্ত উঠানের দখল আমাদের। বাতাস তীব্র থেকে আরো তীব্রতর হয়ে শুরু হতো ঝড়।

ঝড় তেমন একটা ভয় পেতাম না। তবে চোখ খুলে যখন আশেপাশের গাছের মাতম অবলোকন করতাম। মনে হতো এই বুঝি গাছ পড়ে অক্কা পাবো। আম্মুর দুই  হাত আকঁড়ে চেপে ধরতাম আমারা দুইভাই। আমাদের অবস্থা দেখে আম্মু তখন প্রচন্ড জোরে হাসতেন। বিপদে তিনি হাসেন এমনটা না। আমাদের অবস্থা দেখে হয়তো তাঁর এতো হাসি পেত। ভয়ে শঙ্কিত আমি তখনও মনে মনে অপেক্ষার পালা গুনতাম কখন শেষ হবে ঝড় কেননা সবার আগে আমতলায় যেতে হবে । 

রাগান্বিত ঝড় তার সমস্ত ক্ষোভ ঝেড়ে যখন শান্ত হত, দৌড়ে চলে যেতাম আম কুড়াতে। কাদায় লেপটে পড়ে থাকা কাঁচা আম, কে কত বেশি পেলো, কার আম কত বড়, তার যেন দিব্যি একটা মহড়া চলত। পাথরে ঝিনুক ঘষে আম ছুলনি তো আগে থেকেই পকেটে ঢুকিয়ে রাখতাম। কষে ভরা কাঁচা আম ঝিনুকের ছুলনি দিয়ে ছেলে খেতে এক ধরনের যে খাট্টা স্বাদ, সেটা যে খেয়েছে, একমাত্র সেই বুঝতে পারবে। 

তীব্র বাতাসে দিগন্ত জুড়ে নুয়ে পড়া সবুজ বোরো ধানক্ষেত, কচুরীপানাভরা পুকুর, খাল-বিল, নালা-নর্দমা আর ছোট ছোট জলাশয়। যেখানে বর্ষার জল জমে ঝাঁকে ঝাঁকে ব্যাঙাচি আর শোলমাছের পোনা কিলবিল করতো। আমরা পাড়ার ছেলেমেয়েরা সবাই দলবেঁধে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে নেমে পড়তাম মাছ ধরতে। শুকনো জমিতে ছোট ছোট জমে থাকা  টেপা পানিতে ব্যাঙের জোরালো ডাক। যেন একটু পানি পেয়ে আনন্দের শেষ নেই, তাই গলা উঁচিয়ে জোরালো শব্দে আনন্দ উল্লাস করছে।  

ডাঙ্গায় মাছ ধরার অভিজ্ঞতা অনেকেরই নেই বললেই চলে। তবে বছরের এই সময়টায় বৃষ্টির পানির সঙ্গে পুকুর থেকে কই মাছ কান বেয়ে উঠে আসে ডাঙ্গায়। একবার এরকম  বাড়ির পাশের শুকনো জমিতে বেশ কতগুলো কই মাছ দেখে আনন্দে আত্মভোলা হই । যেই না ধরতে গেলাম হাতে কাটার খোঁচা খেয়েসেই থেকে কই মাছের সাথে জীবনের দুশমনি ঘোষণা করলাম।

তবে কই মাছের সঙ্গে যতই  দুশমনি ঘোষণা করি না কেন প্রতি বছর এই সময়ে তারা ডাঙ্গায় উঠবেই। গাছে গাছে আমের মুকুল পরিপক্ব হয়ে বাচ্চা আম বড় হতে শুরু করবে, আমার মতো হাজারো মফস্বলের দুরন্তপনা বাচ্চারা পাথরে ঝিনুক ঘষে আম ছুলনি পকেট ভরে রাখবে । জলাশয়ে হালকা জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে ব্যাঙাচি আর শোলমাছের পোনা কিলবিল করবে ।  ঝড় শেষে গলা উঁচিয়ে জোরালো শব্দে ব্যাঙেরা আনন্দ উল্লাস করবে। যখন তখন রাগান্বিত ঝড় হানা দিবে।

আর এ সব কিছুই গ্রামীণ আবহে  জানান দিবে, 
"আইলো আইলো আইলো রে
রঙ্গে ভরা বৈশাখ আবার আইলো রে"
 
লেখক: সিকৃবি প্রতিনিধি, সিলেট ভিউ ও শিক্ষার্থী, কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ (৪র্থ বর্ষ), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। 

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন