আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

মুক্তিযুদ্ধে এমসি কলেজ: পূর্বসূরীদের রক্তমাখা ইতিহাস আমাদের প্রাণীত করে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-১২-১৬ ১৬:২৮:৩৬

আশরাফ আহমেদ :: সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজ। ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন আসাম প্রদেশের একমাত্র এই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমসি কলেজ নামে পরিচিত। স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বাঙালির অধিকার আদায়ের  বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দান ও সংগ্রাম করে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে চায়ের দেশের এই বিদ্যাপীঠটা। দেশের সকল আন্দোলন সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও স্বাধীনতা যুদ্ধে এই কলেজের অবদান বিশেষ ভাবে অনস্বীকার্য। এসব কারণে বর্তমানে  প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে এমসি কলেজের একজন ছাত্র হয়ে নিজেকে নিঃসন্দেহে গর্বিত মনে হচ্ছে। পূর্বসূরীদের গর্বের ইতিহাসের খানিকটা তুলে ধরার প্রয়াস থেকেই আজকের কলম ধরা৷

মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো ইতিহাসে নিজের নামটিও স্বমহিমায় লিখে নিয়েছিল সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ। ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের ঘাটি তৈরি করে পাক হানাদার বাহিনী। এমসি কলেজের অবস্থান সিলেটের তামাবিল রোডের টিলাগড় এলাকায়।

বাংলাদেশে ঢুকতে ভারতের প্রবেশদ্বার হওয়ায় টিলাগড় কিংবা এর তৎসংলগ্ন এলাকাগুলো হানাদারদের কাছে  খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে হিসেবে দেশের সুনামধন্য বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজটা ছিল দোসরদের মুল টার্গেটের জায়গায়। যেকারণে যুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকেই এমসি কলেজকে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়, পাক আর্মি। পরবর্তীতে  সারাক্ষণই নজরদারিতে রাখা হতো কলেজটির ১৪৪ একরের বিশাল ক্যাম্পাসটিকে। ফলে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয় এই অঞ্চলে থাকা তখনকার একমাত্র এই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি৷ কলেজের ঐতিহাসিক অনেক ডকুমেন্ট, দলিল, জার্নাল, সহ গুরুত্বপূর্ণ  স্থাপনাগুলো পুড়িয়ে দেয়, হানাদারের দল।

এর আগে  বঙ্গবন্ধুর  স্বাধীনতা ঘোষণার পরেই আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধ শুরু হলে কলেজ বন্ধ করে দেয় এমসি  প্রশাসন।কলেজ হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীরা চলে যায় নিজেদের এলাকায়। নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে দল গঠন করে, তারা অংশ নেন স্বাধীনতার সংগ্রামে। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধে এই কলেজের অনেক শিক্ষার্থীই অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন। যাদের অধিকাংশের নামই পরবর্তীতে লিপিবদ্ধ করা যায়নি। "স্বাধীনতা সংগ্রামে সিলেট, ৭১ এর সিলেট, মুক্তিযুদ্ধে সিলেট", সহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কয়েকটি বইয়ের মাধ্যমে জানা যায়, , ৭১ এ এমসি কলেজের প্রায় শ'খানেক শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

অনেকের মধ্যে যাদের অবদান আকাশ চুম্মি , সেই বীরদের  মধ্যে কর্ণেল তাহের ও শহীদ শ্রীকান্ত অন্যতম।

মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক আবু তাহের আসাম প্রদেশের বাদারপুরে ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পরে আসাম থেকে তার পরিবার বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলায় আসেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করে পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে সিলেটের এমসি কলেজ  থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এমসি কলেজের এই ছাত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার হিসাবে  কমান্ডো প্রশিক্ষণ লাভ করেন এবং পরে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। স্বাধীনতার যুদ্ধে তিনি ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাহেরের রণকৌশল শত্রুদের হার মানাতে বাধ্য করতো। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সাহসী এই বীর সম্মুখ সমরে আহত হন এবং একটি পা হারান।  কর্ণেল তাহেরের সব ভাইবোন মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বে ১১ নং সেক্টরে যৌথভাবে যুদ্ধ করেছেন।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কর্ণেল তাহেরের বীরত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য।যেটা এমসি কলেজের জন্য একটা  গর্বের ইতিহাস হয়ে আছে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেক ত্যাগী পুরুষ এই কলেজেরই ছাত্র  শহীদ শ্রীকান্ত দাস। শ্রীকান্ত হবিগঞ্জ জেলার আজমীরীগঞ্জ উপজেলাধীন ২নং বদলপুর ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামে ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

স্থানীয় পাহাড়পুর স্কুল থেকে প্রাথমিক ও ১৯৬৯ সালে বিরাট এএবিসি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে মেট্রিকুলেশন পাস  করেন শ্রীকান্ত। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া শ্রীকান্ত পরবর্তীতে নানা সীমাবদ্ধতা মাড়িয়ে সে বছরই ভর্তি হলেন সিলেটের এমসি কলেজে। মেধাবী এই শিক্ষার্থী  কলেজ ছাত্রাবাসেই পেলেন থাকার জায়গা। টানাপোড়নের সংসারে দিন বদলের আভাস ছিলেন শ্রীকান্ত। স্বপ্নের সিঁড়ি দিয়ে আগাচ্ছিল মেধাবী এই শিক্ষার্থী। কিন্তু  যুদ্ধ শুরু হলে কলেজ থেকে বাড়িতে চলে যান শ্রীকান্ত।

মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে সেখান থেকে লুকিয়ে তামাবিল সীমান্ত পেরিয়ে  চলে যান ভারতে। প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি অংশ নেন মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার সংগ্রামে। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে একের পর এক সফলতা অর্জনের কারণে হানাদার বাহিনীর  কাছে এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছিলেন এমসির এই ছাত্র। ২৭ নভেম্বর বিকেলে সুনামগঞ্জের বৈশেরপাড়া ষোলগড়ের মাঝামাঝি ডলুরা নামক স্থানে  সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন শ্রীকান্ত। বিভিন্ন কৌশলে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে হানাদারদের বিপাকে ফেলে দেন, শ্রীকান্ত। পরবর্তীতে এক পর্যায়ে সেখানেই  পাকসেনাদের হাতে শহীদ হন তিনি। রাস্তায় পরে থাকা শ্রীকান্তের লাশটি  বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে দেহ থেকে তার  হৃৎপিন্ড ও চোখ খুলে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। পরে জয়বাংলা বাজার সংলগ্ন ডলুরা গণকবরে তাকে সমাহিত করা হয়। ডলুরা গণকবরে ৪৪ নং স্মৃতি স্মারকটি শহীদ শ্রীকান্ত দাসের।

পরবর্তীতে এমসির এই গর্বিত ছাত্রের নামে কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয় শহীদ শ্রীকান্ত ছাত্রাবাস। এমন অসংখ্য এমসিয়ান (এমসি কলেজের শিক্ষার্থীকে বলা হয়)  ৭১ এ প্রাণ দিয়েছিলেন, লাল সবুজের এই পতাকার জন্যে। দেশ প্রেমে পূর্বসূরীদের গর্বের এই ইতিহাসগুলো, সর্বদা আমাদের দেশ প্রেমের প্রতি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

লেখক:: শিক্ষার্থী, ৪র্থ বর্ষ, দর্শন বিভাগ, এমসি কলেজ সিলেট।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন