আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

ছাত্রলীগের জন্মদিনে শেখ হাসিনার কাছে সবিনয় নিবেদন

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০১-০৫ ০০:৩৩:৪৩

পীর হাবিবুর রহমান :: রবিবার ইংরেজি নববর্ষের সন্ধ্যায় একটি সুন্দর সময় যখন কাটাচ্ছিলাম, ঠিক তখন বন্ধু টিটনের ফোন, ছানা ভাই মারা গেছেন। আমি স্তম্ভিত। আমাদের সবার প্রিয় ছানা ভাই মানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি বজলুর রহমান ছানা। একজন ন্যায়বিচারক হিসেবে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সততা ও দক্ষতার নজির রেখে অকালে চলে গেলেও তার বর্ণাঢ্য সোনালি যৌবনটি ছিল ছাত্রলীগের রাজনীতিতে  নিবেদিত।

পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের ঘোর অমাবস্যার অন্ধকার সময় যখন নেমে এসেছিল, তখন সারা দেশে ছাত্রলীগের রাজনীতিকে যারা পুনর্জন্ম দিয়ে সুসংগঠিত, শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করেছিলেন তাদের একজন উত্তরের জনপদ থেকে উঠে আসা প্রতিভাদীপ্ত ছাত্রনেতা বজলুর রহমান ছানা। মানুষকে সহজে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা, মেধা, যোগ্যতা, নেতৃত্বের দ্যুতি আর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিকে শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করেছিলেন। যমজ ভাইয়ের মতো তার পাশাপাশি ছাত্রলীগের আরেক নেতার নাম উঠে এসেছিল সেদিনের ইতিহাসে, তিনি হলেন খন্দকার জাহাঙ্গীর কবির রানা। সরল পরিশ্রমী ছানা ভাই ছিলেন চেইন স্মোকার। ছাত্ররাজনীতিতে আমি সক্রিয় হই তিনি চাইতেন না। সমাজ পরিবর্তনের উজ্জ্বল দুটি চোখ নিয়ে সরলতা আর বড় ভাইয়ের দায়িত্ববোধ থেকে বলেছিলেন, মতি রাজনীতি করে, সে করবে। তোমাকে নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সবাই ছাত্ররাজনীতি করলে একটি পরিবার শেষ হয়ে যায়। ছানা ভাই রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিতেই উপযুক্ত ছিলেন। কেন পারেননি আপাদমস্তক সৎ, নির্লোভ, কমিটেড সাহসী মানুষটি বলব না আজ। আইন পেশায় সবিতারঞ্জন পালের সঙ্গে ছিলেন। শিক্ষকতা করেছেন। টাকাটা চিনেননি। বিচারক জীবন ছোট হলেও সফল ছিলেন। তার সঙ্গে কত স্মৃতি। কত সাধারণ ছিল তার জীবন। তখন ছাত্রনেতারা কত আদর্শবান ছিলেন।

একদিকে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের দমননীতি, অন্যদিকে ক্যাম্পাসভিত্তিক হঠকারী, উগ্র ও চরমপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিরোধের মুখে পাঁচ দফা আন্দোলন নিয়ে অমিত সাহসের সঙ্গে বজলুর রহমান ছানা ও জাহাঙ্গীর কবির রানা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাটি উড়িয়েছিলেন গৌরবের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে অগ্রজ হিসেবে পাশে ছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম রাকসু ভিপি নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু। ’৭৯ সালের রাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের ছানা-রানা পরিষদ জিএসসহ ১২টি পদে জয়লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ভিপি পদে আজকের ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার কাছে ছানা ভাই হেরে গেলেও সিনেটে বিজয়ী হন। জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর কবির রানা।

কিছু দিন আগে যখন শোনলাম ছানা ভাই ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত তখন দেখতে যেতে চেয়েছিলাম, ঠাণ্ডু ভাই জানালেন, সিঙ্গাপুর গেছে। কবে ফিরে এলেন জানি না। টিটনের টেলিফোন সংবাদে বুকের ভিতরটা হু হু করে কেঁদে উঠল। ’৭৫-উত্তর সুনামগঞ্জ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন আমার অগ্রজ মতিউর রহমান পীর। তার সঙ্গে ছানা ভাইয়ের ছিল আদর্শিক সম্পর্কের গভীর বন্ধন। সেই বন্ধনের সুতো কখনো ছেঁড়েনি। আমাকে ছানা-রানা দুজনেই ভীষণ স্নেহ করতেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাশাসক এরশাদ জামানার শুরুতে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল সময়ে চারবার গিয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল। মধুর ক্যান্টিন থেকে ছানা ভাইয়ের চিঠি নিয়ে তার লতিফ হলের ২০১ নম্বর কক্ষে উঠেছিলাম হাড় কাঁপানো শীতের ভোররাতে। ছানা-রানা দুজনই তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছেন। অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত শিবির হত্যাকাণ্ডের মিথ্যা মামলার দায়ে সামরিক আদালত কর্তৃক তারা দুজনই যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সেনাশাসক এরশাদের সংলাপে সব দলই অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন ১৫ দলের নেত্রী শেখ হাসিনা সংলাপে যোগ দিয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন ছাত্রনেতার দণ্ড মওকুফের দাবি আদায় করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ’৭৭ সালে এমএ আওয়ালকে ছাত্রলীগের আহ্বায়ক করা হয়। পরে সেই বছরই সম্মেলনে কারাবন্দী ছাত্রনেতা ওবায়দুল কাদেরকে সভাপতি ও মাঠের পরিশ্রমী বিনয়ী ব্যবহারের সংগঠক বাহালুল মজনুন চুন্নুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ষাট দশকে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ছড়িয়ে দেওয়া থেকে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং ’৬৯-এর গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির গণজাগরণ ঘটাতে জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে জাতীয় ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে আওয়ামী লীগের চেয়ে ছাত্রলীগ ও তার নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল অনন্য সাধারণ এবং গৌরবময়।

তেমনি ’৭৭ সালে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে যে আওয়ামী লীগ মহাদুর্দিনে পুনর্জন্ম নেয়। ’৭৮ সালের কাউন্সিলে কারামুক্ত জননেতা আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদকই নির্বাচিত হননি; তিনিই হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের মধ্যমণি। তাকে ঘিরেই যে আদর্শিক, গণমুখী রাজনীতির চরিত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীরা সুসংগঠিত হন সেখানে ছাত্রলীগের নেতাদের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। কেন্দ্রে ফজলুর রহমানের বক্তৃতা সারা দেশের ছাত্রসমাজকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো টেনেছিল ছাত্রলীগের পতাকাতলে। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, খ ম জাহাঙ্গীর, র আ ম ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী, মুকুল বোস (যাকে ’৭৫-এর পরে বস্তাবন্দী করে কারা নির্যাতন করা হয়েছিল), হেয়ামেত উল্লাহ আওরঙ্গরা দুঃসাহসী ভূমিকা রাখেন। একদিকে সামরিক শাসক ও তার দালাল আরেকদিকে আওয়ামী লীগ ও মুজিববিদ্বেষী উগ্র ও চরমপন্থিদের মোকাবিলা করে সংগঠনকে এগিয়ে নিতে তারা দুর্দান্ত ভূমিকা রাখেন। ঢাকার বাইরে থেকে ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করে নেতৃত্বের মহিমায় যারা উদ্ভাসিত হয়েছিলেন ছাত্রসমাজের আস্থা অর্জন করে তাদের মধ্যে উত্তর জনপদের মতিহার ক্যাম্পাসের ছানা-রানা, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদীপ কর, আবদুল মান্নান, চাকসু বিজয়ী জিএস জমীর চৌধুরী, বরিশালে শহীদ খান, জাহাঙ্গীর কবির নানকদের নাম নিতেই হয়।

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে গিয়ে ’৭৯ সালে ফিরে আসা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদের ভূমিকা অনন্য সাধারণ। গোটা বাংলাদেশের নেতা-কর্মীদের চৌদ্দ আনাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে উত্তরাধিকারিত্বের নেতৃত্ব নিয়ে উদ্ভাসিত আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এ ধারাটিকে কোণঠাসা করতে অনেকেই ‘বাকশাল’ বলে কটাক্ষ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এই ধারাটি বিশ্বাস করেছিল, জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সিআইএ জড়িত। তাই দলের মার্কিন ঘেঁষা নেতাদের বিপরীতে আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে থাকা নেতৃত্ব ছিল আস্থাশীল। একদিকে দুই সুপার পাওয়ারের লড়াইয়ে তারা ছিল মার্কিন বিরোধী, অন্যদিকে বিশ্বাস করেছিল সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তার ভারতই আমাদের প্রকৃত বন্ধু। সেদিন দলীয় গ্রুপিং রাজ্জাক-তোফায়েলের নামে হলেও দুজনের সম্পর্ক ছিল সহোদরের মতো। মানিক-জোড়। শালীনতার পর্দা সরানোর শিক্ষা তারা তাদের কর্মীদের দেননি।

’৮১ সালে ইডেন কাউন্সিলে দলের নেতৃত্বের বিরোধ যখন তুঙ্গে, ভাঙনের মুখে আওয়ামী লীগ। ভাঙনের আশায় বঙ্গভবনে রাত জেগে বসেছিলেন সেনাশাসক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সেই রজনীতে দিল্লি নির্বাসিত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য নতুন টার্নিং পয়েন্ট করা হয়। ’৮১ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে আদর্শনির্ভর তরুণরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একপক্ষের নেতৃত্বে বাগ্মিতায় ছাত্রসমাজের মধ্যে ঢেউ খেলানো ফজলুর রহমান ও বাহালুল মজনুন চুন্নু সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হন। সারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মীরা এদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। আরেকপক্ষের সভাপতি হন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন; সাধারণ সম্পাদক খ ম জাহাঙ্গীর। ’৮৩ সালে ছাত্রলীগের বিভক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গেলে দলের একটি অংশ সমঝোতা ঘটতে দেয়নি। জালাল-জাহাঙ্গীর গ্রুপকে বৈধতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ভেঙেই দেননি; আবদুর রাজ্জাকসহ ’৭৫-এর পর যারা দলকে আত্মসমালোচনা, আত্মশুদ্ধির পথে সুসংগঠিত করেছিলেন তাদেরও বের করে দেওয়া হয়। অনুঘটকের ভূমিকায় যারা কাজ করেছিলেন, রাজনীতিতে তারাও এখন ভালো নেই। মাঝখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আদর্শিক, গণমুখী, জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তি।

স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে মেধাবী, সাহসী তারুণ্য আওয়ামী লীগে উদ্ভাসিত হয়েছিল জাসদ গঠনের মধ্য দিয়ে সেই শক্তিকে স্বাধীনতার পর পর আলাদা করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ী শক্তিকে দুর্বল করা হয়েছিল। দুটি ভাঙনের নেপথ্যেই ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। দুটি ভাঙনেই দলের ভিতরে যারা তৃপ্তির হাসি হেসেছিলেন, রাজনীতিতে তারা নিজেরা নিজেদের করুণ পরিণতি দেখেছেন। জাসদের উগ্র, হটকারী, রোমান্টিক পথ নিজেদেরই সর্বনাশ করেনি, মুক্তিযুদ্ধের মেধাবী তারুণ্যকেই শেষ করেনি, আওয়ামী লীগ ও সরকারের সর্বনাশও করেছিল।

আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বের ভাঙন আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার কারণে শেখ হাসিনা দলকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিলেও ’৯১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারেননি। সেই উপলব্ধি থেকে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বিভক্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক শক্তি আওয়ামী লীগে ফিরে এলে দলে শক্তিই বৃদ্ধি পায়নি; ’৯৬ সালে ২১ বছর পর দলটি ক্ষমতায় ফিরে আসে। ষাট দশকে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একদিকে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের দুঃশাসন অন্যদিকে মস্কো, পিকিংপন্থি ও অতিবামদের মোকাবিলা করে গণজাগরণ ঘটিয়েছিল। ’৭০-এর গণরায়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। আর আওয়ামী লীগ হয়েছিল জনগণের নির্বাচিত দল।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর একদিকে খুনি মোশতাক চক্র, সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের দুঃশাসন, মস্কোপন্থিদের খালকাটা বিপ্লবে যোগদান, আওয়ামী লীগ ও মুজিববিদ্বেষী অতিবাম ও হঠকারী বিপ্লবীদের রাজনীতিকে মোকাবিলা করে অগ্রসর হতে হয়েছে প্রথমে আবদুর রাজ্জাক ও পরবর্তীতে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। শেখ হাসিনাই বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলে পরিণত করেন। শুধু তাই নয়; যারা বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ঢোল, হাড্ডি দিয়ে ডুগডুগি ও জুতা বানানোর ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে পরে তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছিলেন, মিথ্যাচার করেছিলেন, মুখে বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলা আনতে নারাজ ছিলেন; এক কথায় ছিলেন চরম আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী, সেই তাদের রাজনীতি দিয়ে শেখ হাসিনা তার পায়ের জুতা পালিশ করাতে পেরেছেন। যে শাহরিয়ার কবীররা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের চরমবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন, তারা এখন কালো মুজিব কোট পরে সরকারি টেলিভিশন বিটিভিতে টকশো করেন। শেখ হাসিনা শুধু বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসিতেই ঝুলাননি, রাজনৈতিকভাবে যারা আওয়ামী লীগের কট্টর বিরোধী তাদের নিঃশর্ত আনুগত্য অর্জন করার ক্যারিশমা দেখিয়েছেন।

ডাকসু ভবনে যারা সুলতান মনসুরের টানানো বঙ্গবন্ধুর ছবি সহ্য করেননি, রাকসুর অভিষেকে যারা ছানা-রানাদের বুকে বঙ্গবন্ধুর ছবি শোভিত ব্যাজ মেনে নেননি; তারাই এখন বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যার অধিক বন্দনা করেন। ’৭৫ উত্তর ছাত্রলীগের রাজনৈতিক সংগ্রামের ওপর ভর করে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বিজয়ের অর্জন এটি।

কয়েক দিন থেকেই ভাবছিলাম, ছাত্রলীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যে বিষয়টি নিয়ে লিখব সেটি শুরুতে এলোমেলো হয়েছে ছানা ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের সম্মেলনে পরিষ্কার বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস, ছাত্রলীগের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস। ’ ’৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্মের এক বছরের মাথায় যে তরুণ দুরদর্শিতা নিয়ে বাঙালির মুক্তির জন্য ’৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি আর কেউ নন, মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্য পাওয়া, শেরে বাংলা এ কে ফললুল হকের স্নেহ কুড়ানো, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দীক্ষা নেওয়া, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ডাকে অন্যায়ের প্রতিবাদে কলকাতার ব্ল্যাক হোল মনুমেন্ট ভেঙে দেওয়া, মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাংগঠনিক ক্যারিশমায় উদ্ভাসিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ছাত্রলীগ গঠনের পর ’৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের অন্যতম কারাবন্দী প্রতিষ্ঠাতা নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা নেতাদের ভুলের চোরাবালিতে ডুবিয়ে দিয়ে নিজস্ব ক্যারিশমায় বাঙালি জাতির স্বাধীনতার যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তার অন্যতম শক্তি ছিল ছাত্রলীগ। ’৬২ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য পর্দার অন্তরালে বঙ্গবন্ধু যে তত্পরতা শুরু করেন, যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের সূচনা ঘটান, সেখানে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরিফ আহমেদের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস গড়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলার স্বপ্নে পরবর্তীতে আরও অনেকেই যুক্ত হন। বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত মাঠে ময়দানে ছড়িয়ে দেওয়া ও বাস্তবায়ন করার অগ্রভাগে সব দমন নির্যাতন সহ্য করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে দলের ভিতরে-বাইরে অনেকেই কটাক্ষ করেছেন। এদেশের সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ইত্তেফাকের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ক্ষুরধার লেখনীতে, পরামর্শে পাশে থাকেন। মাঠে লড়ে ছাত্রলীগ। জন্মকালীন থেকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে নাইমুদ্দিন আহমেদ, দবীরুল ইসলাম, খালেক নেওয়াজ খান, কামরুজ্জামান, এম এ ওয়াদুদ, আবদুল মমিন তালুকদার, এম এ আওয়াল, রফিকুল্লাহ চৌধুরী, আজহার আলী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মণি, কে এম ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রাজ্জাক, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, ইসমত কাদির গামা, শেখ শহিদুল ইসলাম, এম এ রশীদ, মনিরুল হক চৌধুরী, শফিউল আলম প্রধান (মহসীন হলের ৭ খুনের ঘটনায় বহিষ্কৃত ও কারাদণ্ডে দণ্ডিত), মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, এম এ আওয়াল, ওবায়দুল কাদের, বাহালুল মজনুন চুন্নু, খ ম জাহাঙ্গীর, আবদুল মান্নান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মোহাম্মদ আবদুর রহমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, অসীম কুমার উকিল, শাহে আলম, মাইনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, ইকবালুর রহিম, এ কে এম এনামুল হক শামীম, ইসহাক আলী খান পান্না, বাহাদুর বেপারী, অজয় কর খোকন, লিয়াকত সিকদার, নজরুল ইসলাম বাবু, মাহমুদ হাসান রিপন, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন, এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ, সিদ্দিকী নাজমুল আলম এ ৬৯ বছরে ছাত্রলীগের আহ্বায়ক থেকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির ইতিহাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে আবদুর রাজ্জাকই ’৭৫ উত্তর আওয়ামী লীগের দুবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার ওবায়দুল কাদের হলেন দ্বিতীয় ভাগ্যবান যিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। ছাত্রলীগের অনেকে সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও প্রভাবশালী নেতারা জীবিত থাকলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দায়িত্বশীল পদ-পদবি পাননি। ভাসমান আওয়ামী লীগার হিসেবে মাঠে ঘুরছেন। সরকারের মন্ত্রিসভায় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতিদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ এবং ওবায়দুল কাদেরই রয়েছেন। তোফায়েল আহমেদের পর ছাত্রলীগের নির্বাচিত ডাকসু ভিপি সুলতান মনসুরের ইমেজ থাকলেও দলের বাইরে ছিটকে পড়েছেন। অনেকে আওয়ামী লীগ রাজনীতিও করছেন না। এত মুজিব আদর্শের মহাদুর্দিনের সন্তানরা ভাসমান থাকে আর হঠাৎ নেতা হয়ে দলে অনেকে বা বামরা এসে দাপুটে হয় কীভাবে তার রহস্য আমি বুঝি না। এদেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাত্রলীগ ও তার নেতাদের বাদ দিয়ে কখনই লেখা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর অন্যতম চার প্রধানের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মণি ’৭৫ এর ঘাতকের হাতে নিহত। সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের পর আর কোনো গণসংগঠনে যুক্ত হননি। জাসদ সৃৃষ্টির নেপথ্য নায়ক বলা হলেও সেখানেও তার নাম নেই। জীবিত থাকলেও রাজনীতিতে তাকে রহস্য পুরুষই বলা হয়। আওয়ামী লীগেই আবদুর রাজ্জাক ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুর আগে বুকজুড়ে ছিল দহন ও বেদনা। রাজনীতিতে আছেন কেবল আরেক অন্যতম প্রধান তোফায়েল আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। তার বক্তৃতায় ছাত্র সমাজের সঙ্গে গণজোয়ার ঘটে যেত। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেলও খেটেছেন দীর্ঘদিন। সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন। ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব তুলেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আবদুল কুদ্দুস মাখন অকালেই চলে গেছেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এ চার নেতাকে ছাত্রসমাজ ভালোবেসে চার খলিফা বলত। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রলীগের নেতারা প্রাণশক্তি জোগালেও দলের মন্ত্রী-এমপি ও নেতা হওয়ার মিছিলে পিছিয়ে থেকেছেন বরাবর। আন্দোলন, সংগ্রাম ও রক্তদানে ছাত্রলীগ এগিয়ে; কিন্তু ইতিহাসের চিত্রপট বলে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ভোগ করেছে বামপন্থি ও আগন্তুকরা যাদের বলা হয় হাইব্রিড।

মুক্তিযুদ্ধের পর অনেকেই নানা পথে চলে গেছেন, অনেকের আদর্শচ্যুতিও ঘটেছে। কিন্তু আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস তাদের বাদ দিয়ে লেখা যাবে না। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে না থাকা অনেক নেতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ষাটের উত্তাল সময়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের শক্তির উৎস ছিল জগন্নাথ কলেজ থেকে আসা ছাত্রলীগের মিছিল। সেই মিছিলের নেতা ছিলেন রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু, কাজী ফিরোজ রশীদ, কে এম সাইফুদ্দিন, এম এ রেজা প্রমুখ। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আমির হোসেন আমু, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর প্রভাব তো ছিলই। আইয়ুব খানের দালাল মোনায়েম খানের সন্ত্রাসী বাহিনী পাঁচ পাত্তুদের উত্খাতে, ’৬৯-এর উত্তাল আন্দোলনকে তীব্র করে দিতে মোস্তফা মহসিন মন্টু, কামরুল আলম খসরুদের নাম মুছে ফেলা যাবে না।

এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে হিমালয়ের উচ্চতায় মহানায়কের আসনটি ইতিহাস যাকে দিয়েছে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার উচ্চতা দূরে থাক, তার কাছাকাছি কারও জায়গা নেই। কিন্তু যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত ও পরিচালনায় বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ইতিহাসে তাদের প্রাপ্য সম্মান দান সময়ের দাবি। যার যা প্রাপ্য তার তা পাওয়া উচিত। না হয় ইতিহাস বিকৃতির ধারা অব্যাহত থাকবে। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের কারও কারও মতলববাজি, সুবিধাবাদী, ব্যক্তিস্বার্থের কারণে সংঘটিত ঘটনায় ইতিহাসের গৌরবময় এই সংগঠনের ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না। ছাত্রলীগের ইতিহাসকে যারা গৌরবের উচ্চ শিখরে নিয়েছিলেন, তাদের রাজনীতি ও জীবনযাত্রা, খেয়ে না খেয়ে গভীর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আদর্শবোধ নিয়ে সংগঠন, ছাত্রসমাজ ও দেশের জন্য কাজ করা থেকে শিক্ষা না নিলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। ছাত্রলীগের গৌরব ছাত্ররাজনীতির অতীত ইতিহাস ধূসর হয়ে যাবে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সবিনয় অনুরোধ, এদেশে অনেক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ অনেক গুণীজনদের নামে হয়েছে, অনেক বীরের নামে হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রলীগের যে অবদান, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যে ভূমিকা তা উপেক্ষিত হয়ে এসেছে। তাদের প্রাপ্য সম্মান ও স্মৃতি রক্ষার্থে আপনিই পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নামে হলের নামকরণ করতে। এক্ষেত্রে মুজিব বাহিনীর চার প্রধান শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখনের নামে নামকরণ দিয়ে সেটি শুরু করা যায়। ইতিহাসের সন্তানদের কীর্তি আপনিই অমর করে রাখতে পারেন। স্বাধীনতার পর বা আজকে কার কী ভূমিকা সেটি বড় নয়; বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদানের স্বীকৃতিই বড়। একই সঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো চালুর মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগকে তার গৌরবজনক ইতিহাসের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা যায়। যাতে করে ছাত্রলীগ নিয়ে কেউ নাক ছিটকাতে না পারে।   আপনার মন্ত্রিসভা ও দলে দুই-তিনজন সদস্য রয়েছেন, যারা ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যান না, নাক ছিটকান, সাধারণ আম-জনতার মনে ছাত্রলীগ নিয়ে কি প্রশ্ন আজ তা ভাবতে হবে।   সেভাবেই শোধরাতে হবে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ।

ইমেইল : peerhabib.rahman@gmail.com

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন