আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস দ্বারা সৃষ্ট রোগ

ডা. মুফতি মোহাম্মদ শামছ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-০৭-১১ ০০:০১:১১

কারো ডায়াবেটিস থাকলে তাকে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করা দরকার। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিক্যিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে মানুষের নানা রোগ সৃষ্টি হতে পারে।

১। ডায়াবেটিস ও চক্ষুরোগ :
যে সকল সুস্থ সবল স্বাভাবিক মানুষ চোখ রোগের কারনে অন্ধত্যবরন করেন, তাদের প্রায় ২০-২৫ ভাগ রোগীই ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন। ৩০ বছর বয়সের পর রুটিন চেক-আপ করানোর প্রচলন আমাদের দেশে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে করা হয় না, যার ফলে অধিকাংশ রোগীই জানে না তিনি যে ডায়াবেটিস এ ভুগছেন। ডায়াবেটিস রোগ শুরু হওয়ার সময় থেকে ১০ বছর এর মধ্যেই চোখের অসুবিধা দেখা দেয় দৃষ্টি শক্তির অনেক পরির্বতন ঘটে। অবহেলা করে অনেকেই এর প্রতি কোন গুরুত্ব দেন না অথচ অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারন হল ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস হলে চোখের রেটিনা নামক অংশটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে যার ক্রমধারা গুলো হলো - ১। নন-প্রলিকারেটিভ বেকগ্রাউন্ড রেটনাপ্যাথি উথআউট মেকুলোপ্যাথি ২। ম্যাকুলাপ্যাথি ৩। প্রি-প্রলিকারেটিভ রেটিনোপ্যাথি ৪। প্রলি ফারোটিভ রেটিনোপ্যাথি। সব কথার শেষ কথা রোগীর চোখ দেখার ক্ষমতা লোপ পায়। যদি সিমপল বেকগ্রাউন্ড রেটিনোপ্যাথি হয় তবে কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না তবে প্রি-প্রলিফারেটিভ, প্রলিফারেটিভ এবং মেকুলোপ্যাথিক রেটিনোপ্যাথি হয় তহলে রেটিনাল লেজার ফটোকয়াগোলেশন নামক চিকিৎসা নিতে হয়। আর যদি ভিট্রিযাস এ রক্তক্ষরন জনীত কবলে দৃষ্টি শক্তি লোপ পায় তবে ভিট্রিকটমি নামক অপারেশন করতে হয় তা না হলে রোগী চির দিনের মত অন্ধত্য লাভ করে। তাই ডায়াবেটিস যাদের আছে তাদের খুব নিয়মিতান্ত্রিক দৈনন্দিন জীবনাচরনে অভ্যস্থ হয়ে ডায়াবেটিস নিয়নন্ত্রে রাখতে হবে অন্য থায় চিরদিনের মতো অন্ধত্বের শিকার হতে হবে ।

২। ডায়াবেটিস ও স্নায়ুরোগ :
প্রায় ৩০ ভাগ ডায়াবেটিস রোগী খুব তাড়াতাড়ি ডায়াবেটিস স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হন। পায়ের পাতায় অবস অবস ভাব, ব্যাথা করা, জ্বলা পুড়া করা, ক্ষত হওয়া ,পায়ের মাংশপেশী শোকিয়ে যাওয়া এরই  সাথে পায়ের টেনডন রিক্সেক কমে যাওয়া, কম্পন অনুভূতি লোপ পাওয়া, হাতে কারপাল টানেল সিনড্রম ও পায়ে ফুট ড্রম হওয়া, দাঁড়ানো বাসা শুয়ে থাকা অবস্থায় তিন রকমের রক্তচাপ পাওয়া যা পশচারাল হাইপোটেনশন নামে পরিচিত; র‌্যালেটিভ টেকিকারডিয়া বা স্বাভাবিক অবস্থায় নাড়ীর গতি ১০০ বিট এর বেশী পাওয়া, খাবার গিলতে গেলে গলায় ব্যাথা অনুভব করা, পেট ভরা ভরা অনুভব করা, বমি বমি ভাব অনেক ক্ষেত্রে বমি হওয়া, রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া, পায়খানার বেগ আসার কারনে এর সাথে পাতলা পায়খানা হওয়া অথবা অপূর্ণ পায়খানা হওয়া। প্র¯্রাবের চাপ থাকা স্বত্তেও প্র¯্রাব শুরু হতে দেরী হওয়া, বার বার প্র¯্রাবে বেগ পাওয়া, প্র¯্রাবে ইনফেকশন হওয়া, পুরুষত্ব লোপ পাওয়া বা বন্ধ্যাত্ব, খাওয়ার সময় শরীরে ঘাম হওয়া, পাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়া ছাড়ায় রাতে শরীরে ঘাম হওয়া, মুখ শুকন শুকন ভাব পায়ের চামড়া ফাটা, পায়ের পাতা ঠান্ডা হওয়া এবং লাইট রিফ্লাক্স নষ্ট হয়ে যাওয়া বা দেরিতে হওয়া, যদি এ লক্ষন দেখা তবে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য কঠোর ভাবে আত্ম নিয়োগ করা।

৩। ডায়াবেটিস ও কিডনীরোগ :
ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে কিডনী রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১৭ গুন বেশী। যে সকল রোগের কারনে কিডনী নষ্ট বা বিকল হয়ে যায় ডায়াবেটিস তাদের মাঝে অন্যতম প্রধান একটি রোগ। দীর্ঘ দিন থেকে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কিডনী বিকল করে দেয়। তিনটি ধাপে ডায়াবেটিস রোগীর কিডনী বিকল বা নষ্ট হয় প্রথমে গ্লমেরুলার ডেমেজ হয় এরপর ইসচেমিয়া হয় এবং তারপর এসেনডিং ইনকেকশন। কিভাবে বুঝবেন? -শরীর ফোলে যাওয়া প্রস্রাবে প্রোটিন পাওয়া- শরীরে পানি জমে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া। কি করবেন? - কিছুই করার নেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখতেই হবে তারপর ও যদি হয়ে যায় তখন কি করবেন বসে বসে আল্লাহর নাম ডাকবেন কারন চিকিৎসা সাস্ত্রের অনেক উন্নতি হলেও ডায়াবেটিক নেক্রপেথি হয়ে গেলে তা কমিয়ে আনার কোন উপায় এখন ও আবিস্কার হয় নি। তবে চিকিৎসা সাস্ত্রে কিডনী বিকল হওয়ার গতিটা কিছু কমিয়ে আনতে পারে কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করতে পারে না। যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে প্রেটিন জাতীয় খাবার (৪০ - ৬০ গ্রাম /দিন) কম পরিমানে খেতে হবে এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনের জন্য অঈঊ রহযরনরঃড়ৎ ও লোপ ডায়াবেটিসক জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করতে হবে। আর যদি কিডনী বিকল হয়েই যায় মানে সিরাম ক্রিয়েনিন যদি ২০০ মিলিমোল পার লিটারের হয়ে যায় তবে সাথে সাথে কিডনী রোগ বিশেষজ্ঞ নেকফ্রোলজিষ্টর এর পরামর্শ নিতে হবে। আর সিরাম ক্রিয়েটিনিন যদি ৪৫০ মিলিমোল পার লিটারের বেশী  হয়ে যায় তবে ডায়াবেটিস বা কিডনী ট্রাস্নপ্লাণ্ট করার প্রস্তুতিমুলক ডায়ালাইসিস নিতে হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী।

৩/ ডায়াবেটিস ও পায়ের ক্ষতরোগ :
যাদের ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথি হয়ে গেছে তারা খুব ঘন ঘন পায়ের পাতায় ক্ষত রোগে আক্রান্ত হন। কারন হল নিউরোপ্যাথি হওয়া পায়ের অনুভূতি ক্ষমতা লোপ পায় তাই পায়ে কোন আঘাত লাগলে বা ক্ষত হলে রোগী সহজে বুঝতে পারেন না ফলে ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হয় আর পায়ের চিস্যু পচে যায় খুব দ্রুত। তার কারন ১। নিউরোপ্যাথি ২। ইনফেকশন আর ৩। রক্ত চলাচল কমে যাওয়া বা ইসচেমিয়া। কিভাবে বুঝবেন?
- প্রাথমিকভাবে যদি নিউরোপ্যাথি হয় তবে পায়ের পাতায় হাত দিলে কিছুটা গরম অনুভূত হবে, পায়ের রক্তনালীর বা নাড়ীর গতি কখনো পাওয়া যাবে কখনো পাওয়া যাবে না, অনুভূতি লোপ পাবে, চামড়া পিংক বা রক্রবর্ন ধারন করবে, পা দেখতে শুকনো শুকনো মনে হবে ,স্বাভাবিক চামড়ার যে মসৃনতা আছে তা লোপ পাবে, কেলাস তৈরি হবে চামড়ার ক্ষসে যাবে, ব্যাথা বিহীন ক্ষত তৈরি হবে, ক্ষত স্থানের চামড়া আর স্বাভাবিক চামড়ার মাঝখানে একটি কালো লাইন বা দাগ কাটা থাকবে আঙুল পচা শুরু হবে (ডিজিটাল গ্যানস্রিন পায়ের ইন্টারোসিয়াস মাসুল নামক অংশ শোকাতে থাকবে এবং পা কিছুটা ফোলা থাকবে। আর প্রাথমিক ভাবে যদি রক্ত চলাচল কমে যায় তবে - পায়ের পাতা হাত দিয়ে ঠান্ডা অনুভূত হবে পায়ের রক্তনালীর নাড়ীর গতি পাওয়া যাবে না, পায়ের অনুভূতি ঠিক থাকবে, পায়ে আলসার বা ক্ষত হয়ে তাতে ভাল ব্যাথা অনুভব হবে, পায়ে পচন ধরবে (গ্যানগীন হবে)। যদি ডায়াবেটিক ফুট হয়েই যায় কি করবেন ?- খুব যতœ সহকারে কঠোর ভাবে ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রন করতে হবে, পায়ের যতœ নিতে হবে। বিশেষ্ণ ভাস্কুলার স্বার্জনের পরামর্শ মোতাবেক পায়ের এনজিওগ্রাম করে রক্ত নালীর রিকন্সট্রাকশণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। (চিরপডিষ্ট বা পা রোগ বিশেষজ্ঞ এখনো আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। উন্নতবিশ্বে থেকে আমরা স্বাস্থ্য খাতের দিকে অনেক পিছিয়ে)
সতর্ক সাবধান নিয়মিত নিয়মতান্ত্রিক গোছানো জীবন যাপনে অভ্যস্থ হতে পারলে ডায়াবেটিস থাকা স্বত্ত্বেও - এ সকল অসুবিধা থেকে দুরে থাকা সম্ভব।

লেখক:
ডা. মুফতি মোহাম্মদ শামছ
এমবিবিএস, সিসিডি, এফএমডি, এফসিজিপি।
মোবাঃ ০১৭১১৯৬৭৪৪৪

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন