আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

অস্থির বাঙালি এবং সর্প নৃত্যের কাহিনী

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১০-০৯ ০১:৪২:১১

গোলাম মাওলা রনি :: বাঙালির অস্থির হৃদয়ের সঙ্গে আবহমান বাংলার সর্প নৃত্যের অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। অন্যদিকে জাতি হিসেবে বাঙালির উত্থান-পতন, লাভ-লোকসান এবং হাসি-কান্নার সঙ্গে হৃদয়ের অস্থিরতার একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে।

মানুষের অস্থিরতার পেছনে মূল নেয়ামত হিসেবে যে কয়টি উপাদান সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অজানা ভয়, অহেতুক কৌতূহল এবং অতিরিক্ত উৎসাহ সংবলিত আবেগ ও অনুভূতি। সর্প নৃত্যের সঙ্গে অস্থিরতার কী সম্পর্ক রয়েছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে সর্প নৃত্য সম্পর্কে কিছু বলে নিই।

গ্রাম বাংলায় বড় হয়েছেন অথচ ঐতিহ্যবাহী সর্প নৃত্য দেখেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাপুড়ের বাঁশির সুরের সঙ্গে বিষধর কালনাগিনী, পদ্ম গোখরা, খৈয়া গোখরা প্রভৃতি সাপের ফণা তুলে নাচন-কুর্দন এবং ফোঁসফাঁস ভয়ঙ্কর আওয়াজে চারদিকে তাকানোর দৃশ্য দেখে আমরা ছোটবেলায় উল্লাসে ফেটে পড়তাম এবং সাপুড়ের কথামতো ছেলেবুড়ো সবাই প্রচণ্ড জোরে তালি বাজিয়ে সাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাবিজ কিনে বাড়ি ফিরতাম। বড় হয়ে যখন জানলাম যে সাপের কোনো শ্রবণশক্তি নেই এবং দৃষ্টিশক্তিও প্রায় অন্ধের মতো তখন বাঁশির সুরের সঙ্গে সর্প নৃত্যের কার্যকারণ যেমন মেলাতে পারিনি তেমনি সর্প নৃত্য দেখে উল্লসিত হয়ে তাবিজ কেনার কারণও খুঁজে পাইনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন জ্ঞানী-গুণী মানুষের সংস্পর্শে এলাম তখন জানলাম যে জাতি হিসেবে আমরা অকারণ অস্থিরতায় ভুগি এবং ক্ষণে ক্ষণে রাগ-ক্ষোভ বা ভালোবাসায় উত্তেজিত হয়ে পড়ি। আবেগ-সোহাগ, ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং মারামারি-কাটাকাটির মতো বিষয়গুলো ঘটিয়ে ফেলি কোনো কিছু ঠিকমতো জানা বা বোঝার আগেই।

আমাদের জীবনের অনেক সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করি সীমাহীন ভয়, শঙ্কা এবং অনিশ্চয়তাকে মোকাবিলা করার জন্য। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো আমাদের ভয়ভীতির প্রকৃত কারণ আমরা প্রায়ই জানি না। ফলে ভয় মোকাবিলার জন্য যেসব দাওয়াই গ্রহণ করি সেগুলোর কার্যকারিতা প্রায়ই সর্প নৃত্য দেখে সাপের তাবিজ ক্রয় করার মতো ফলাফল বয়ে নিয়ে আসে। আমাদের যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন আমরা সাপ খেলা দেখতে যেতাম তাহলে সবাই একবাক্যে উত্তর করবেন যে, নেহায়েত বিনোদন এবং চটুল আনন্দ লাভের জন্য সাপ খেলা দেখতাম। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আমরা মূলত ভয় পাওয়ার জন্য নিজের অজান্তে সেখানে যেতাম আর সাপুড়ে ভয় দেখিয়ে, মিথ্যা বলে এবং আমদের বিবেক, বুদ্ধিকে ভোঁতা করে দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে তাবিজ বিক্রির আয়োজনটা করে ফেলত বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে।

বাঙালি কেন অস্থিরতায় ভোগে এমনতরো প্রশ্নের বহু নির্ভরযোগ্য উত্তর রয়েছে। দেহগত কারণ ছাড়াও ভূ-প্রাকৃতিক এবং খাদ্যাভ্যাসের কারণে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ অস্থিরতার পেছনে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত দুর্বলতা। আমরা প্রায়ই না জেনে না ভেবে কেবল কোনো দৃশ্য দেখে অথবা কোনো শব্দ শুনে অস্থির হয়ে পড়ি। আবহমান বাংলার শিল্পসাহিত্য, সংগীত, নৃত্যকলা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করলে বাঙালি সত্তার পরিচয় এমনই পাওয়া যায়। নববধূকে বাড়িতে রেখে স্বামী প্রবাসে গেছেন। বধূ তার ভয় কাটানোর জন্য অথবা বধূর নিরাপত্তার জন্য স্বামীর অবর্তমানে তার মা ও বোন রাতের বেলায় বধূর সঙ্গে একত্রে ঘুমোতে যান। গভীর রাতে বধূর মনে পড়ে যায় পাশের বাড়ির প্রেমিকটিকে যে তাকে কুলহারা করার জন্য কোকিলের স্বর নকল করে কুউ কুউ রবে ডাকতে থাকে। বধূ সন্তর্পণে ঘর থেকে বের হয়ে যান এবং প্রেমিককে বলেন— ‘আমায় এতো রাতে ক্যান ডাক দিলে! প্রাণ কোকিলারা রে...!’

উপরোক্ত গানটি আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি। কিন্তু গানের কথাগুলো কতজন বিবেচনা করেছি তা আমি বলতে পারব না। বিশেষ করে প্রেমিকের ডাকে বধূর অস্থিরতা এবং মুহূর্তের মধ্যে নিজের মন-মানসিকতাকে ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরিয়ে দিয়ে শ্বশুরকুলের আত্মীয়দের শত্রু বানিয়ে ফেলার বিষয়টি লক্ষ্য করার মতো। সে প্রেমিকার কাছে অনুযোগ করে বলে তুমি তো জানো ‘আমার শেয়রে শাশুড়ি ঘুমায় জ্বলন্ত নাগিনী, আমার বৈঠানে ননদী শুয়ে দুরন্ত নাগিনী। ’ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের এই গানটি ছাড়াও খান আতার বিখ্যাত সিনেমা ‘দিন যায় কথা থাকে’র একটি গানের মধ্যে বাঙালির অস্থির মনের হঠাৎ দিকপরিবর্তন সম্পর্কে চমৎকার একটি ধারণা পাওয়া যায়। মাঝি তার নৌকা অকুল দরিয়ার মাঝে বেয়ে চলেছে। হঠাৎ মাঝপথে তার মনে হলো— সে আর নৌকা চালাবে না। ফলে তার কণ্ঠে বেঁজে ওঠে— ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না...। ’ অস্থিরতার কারণে হঠাৎ উত্তেজনা এবং অজানা ভয়ের কারণে আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা এবং একটি বেসরকারি অফিসের অদ্ভুত গবেষণার কাহিনী বলে আজকের প্রসঙ্গ শেষ করব। মহান মুক্তিযুদ্ধের কয়েক মাস আগে থেকেই কতিপয় কট্টরপন্থি নেতা সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে যেমন চাপ দিয়েছিলেন তেমনি সারা দেশের মুক্তিকামী মানুষকে প্রবলভাবে উত্তেজিত করে তুলেছিলেন। ফলে স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র বাংলাদেশ। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় প্রায় ১০ লাখ লোকের সমাগম হয়। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের তুলনায় পলায়নপর জনতার সংখ্যা বেড়ে যায় অন্তত তিনশ গুণ। প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কতজন অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন সে ব্যাপারে যথেষ্ট প্রশ্ন আজও বিভিন্ন মহল থেকে করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার শত চেষ্টা-তদ্বির করেও ৫০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রস্তুত করতে পারেনি। স্বাধীনতার এত বছর পর অনেক টেনে টুনে এবং নানা বিতর্ক সৃষ্টি করে সাকুল্যে লাখ দেড়েক মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মধ্যে যদি দেড় লাখ মুক্তিযোদ্ধা হন তবে রাজাকারের সংখ্যা কতজন ছিল? অন্যদিকে ভয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন এক কোটি লোক। অন্যদিকে বিভিন্ন শহর থেকে গ্রামে অথবা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পালিয়ে যাওয়া লোকের সংখ্যা ছিল প্রায় দুই কোটি। অন্যদিকে পাকিস্তানি আর্মি বা রাজকারদের নাম শুনলে বা তাদের বাঁশির শব্দ শুনে কিংবা গুলি-বোমার আওয়াজে কতজনের হার্টবিট বেড়ে যেত, কতজন চৌকি বা খাটের নিচে পালাতেন এবং ভয়ে কান্নাকাটি করতেন তা আমি বলতে পারব না।

এবার একটি বেসরকারি অফিসের অদ্ভুত গবেষণার কাহিনী বলি। অফিসের বস একজন মধ্যবয়সী রহস্যময় প্রকৃতির মানুষ। সাকুল্যে একশজন বিভিন্ন বয়সের লোকজন তার অধীনে কার্যালয়ে কর্মরত। ঢাকার অভিজাত এলাকায় বিশাল এক স্বতন্ত্র বাড়ি নিয়ে তার অফিসটির প্রাঙ্গণে বড় বড় কয়েকটি গাছ এবং সবুজ লন তার অফিসের সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। অফিসের বস তার কর্মচারী-কর্মকর্তাদের প্রতি অতিশয় মানবিক এবং তারাও বসের জন্য জীবনটি দিয়ে দিতে পারেন বলে সকাল-বিকাল বসের সামনে গিয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করে আসেন। রহস্যময় বস একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, অদ্ভুত উপায়ে তিনি তার কর্মচারীদের সাহসের পরীক্ষা নেবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি কোনো এক সন্ধ্যারাত্রিতে সাধারণ বৈঠক ডেকে সবাইকে নিয়ে একটি কামরায় জড়ো হলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী হঠাৎ করে ঝড়ের বেগে উন্মাদ প্রকৃতির বিদঘুটে পোশাক পরা এক লোক সেখানে এসেই চিৎকার করে বলতে লাগলেন খা, খা, বক্ষিলারে খা, সবগুলোরে খা। এ কথা বলেই লোকটি সাপের মতো দেখতে কয়েকটি প্লাস্টিকের খেলনা সাপ, ব্যাটারিচালিত ভ্যাওয়া ব্যাঙ এবং কিছু আবর্জনা ব্যাগ থেকে বের করে ছেড়ে দিলেন। এই ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা মোতাবেক পুরো অফিসের বিদ্যুৎ চলে গেল, বিকল্প জেনারেটর চলল না— এমনকি জরুরি আইপিএস বাতিগুলোও জ্বলল না।

ঘটনার আকস্মিকতায় সেখানে রোজ কেয়ামত হাজির হলো। ওরে মারে-ওরে বাবারে গুক্কুর সাপের দংশনে মরলাম রে ইত্যাদি শব্দে বোম ফাটিয়ে যে যার মতো ভৌঁ দৌড় দিয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে আরম্ভ করল। ৯০ সেকেন্ড পর বিদ্যুতের আলোতে দেখা গেল রুমের মধ্যে কয়েকজন সংজ্ঞা হারিয়ে অস্পষ্ট স্বরে গোঙ্গাচ্ছে, কয়েকজন প্রাণ বাঁচাতে অফিস লনের গাছগুলোর মগডালে উঠে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করছে এবং বেশিরভাগ লোক মূল গেট খোলা থাকা সত্ত্বেও দেয়াল টপকিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় অবিরত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আজ হঠাৎ করে বেসরকারি অফিস কর্তার অদ্ভুত গবেষণার কথা মনে পড়ল সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কিছু অস্থির মানুষের জেহাদি জোশ দেখার পর যারা অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রতি অতিশয় সংবেদনশীল হয়ে রাষ্ট্রকে মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অবিরত উসকানি দিয়ে চলেছেন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন