আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

গ্রুপ লিডারদের সেকাল-একাল

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৩-৩১ ০০:৩৫:২৭

অনিরুদ্ধ মজুমদার পলাশ :: আজ থেকে ৫/৬ বছর পূর্বেকার কথা বলছি। সিলেটের উল্লেখিত কয়েকজন নেতা আমাদের মত ছাত্রলীগ কর্মীদের দলে ভিরাতেন। দলে ভিরাতেন বললে ভূল হবে, মূলত যারা স্বচ্ছ ভাবে রাজনীতি করতে চাইতো, তাদের একটা ছায়া দিতেন। তাও অনেক পরিক্ষার নিরীক্ষার পরই যায়গা হত একটা নির্দিষ্ট বলয়ে। যায়গা হত কর্মীর পারিবারিক পরিচয়, কর্মীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, দল এবং সংঘটন এর প্রতি তার আনুগত্যতার পরিমাপের উপর। নেতার পেছনে দুএক বছর না ঘুরলে তাও অর্জন করা অসম্ভব ছিলো। কিন্তু আজকাল হরহামেশায় দেখছি কর্মীর সংখ্যা এমনি বেড়েছে যে গ্রুপ তৈরি হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও হচ্ছে কর্মীরা কোন বলয়ে গিয়ে অন্য কর্মীদের জন্য সুবিধা করতে না পেরে কয়েকজন কর্মী মিলেই নতুন এক নেতা তৈরি করছে। নেতা তখন ফ্রি তে কিছু কর্মী পেয়ে নিজেকে গ্রুপ লিডার হিসেবে শহরে পরিচিত করতে তার থেকেও মোটা অভিভাবক কে নিয়ে জন্মদিন বা রাস্তায় শোডাওন দিচ্ছে। পোস্টার হচ্ছে, ব্যানার হচ্ছে সেই নেতাকে নিয়ে যে নিজেই তার পদের ভাড় বহন করতে হিমসিম খাচ্ছেন। তবে এখনকার সময়ে এ নিয়ে তেমন কোন অসুবিধা হচ্ছে না, নতুন গ্রুপ লিডারের এবং আশ্রয়দাতা অভিভাবকের। কারন রাষ্ট্রদোহীতা এবং সন্ত্রাসী কার্জকলাপের কারনে শিবির - ছাত্রদল এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য মাঠ ছাড়া। এই সব গ্রুপ লিডারদের মেক্সিমাম যোগ্যতা হচ্ছে সাবেক ছাত্র নেতা।

সাবেকও বেশি দিনের নয়। যখন বি এন পি - জামাত কোণঠাসা হয়ে বাচার রাস্তা খুজছে, তখন ঐসব ছাত্রনেতাদের অবির্ভাব হয়েছিলো। আর তারাই এখন গ্রুপ লিডার। গ্রুপের পাল্লা ভাড়ি করতে দলের মনোগ্রাম সপে দিচ্ছেন ছাত্রদল-ছাত্রশিবির থেকে আসা দুষ্কৃতীকারি দের। কাছে টানছেন দলের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ছিনতাই রাহাজানি করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসা সন্ত্রাসীদের। কখনো কখনো ভাগ্যক্রমে পেয়ে যাওয়া পদের মালিক হচ্ছেন গ্রুপ লিডার, কোথাও একটু জোড়ে শ্লোগান দিতে পারে বলে হয়ে যাচ্ছে গ্রুপ লিডার, কোথাও দেখতে একটু মোটাসোটা নেতাটি হয়ে যাচ্ছে গ্রুপ লিডার, কোথাও অনেক টাকার মালিক লোকটি হয়ে যাচ্ছে গ্রুপ লিডার।

কোথাও খুব ভালো তোষামোদ করতে পারা কর্মীটি হয়ে যাচ্ছে গ্রুপ লিডার। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের সাথে একটু ভালো সম্পর্ক আছে, এমন ছেলেটিও গ্রুপ লিডার, কোথাও অভ্যন্তরীণ কুন্দলে একটি প্রাণ বিসর্জন দিয়ে, সেটাকে পুঁজি করে হয়ে যাচ্ছে গ্রুপ লিডার, ৮ম শ্রেণি অসম্পন্ন ছেলেটিও হয়ে যাচ্ছে অনার্স পড়ুয়া কর্মীদের গ্রুপ লিডার, কোথাও বংশ পরিক্রমায় বা পোষ্য কোটায় হচ্ছে গ্রুপ লিডার, গ্রামাঞ্চলে দেখতাম যে পিতার ছেলে সন্তান বেশি, সে পিতার এলাকায় স্বেচ্ছাকৃত মোড়ল হতেন- আর বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় অধিক ছেলে সন্তান থাকলে, তার মধ্যে একজন বনে যায় গ্রুপ লিডার।

আর এসব গ্রুপ লিডারদের রাজনৈতিক কার্জক্রমের মধ্যে পরে - টেন্ডার ছিনতাই করতে গিয়ে "জয় বাংলা" বলে শ্লোগান দেয়া, জায়গা দখল করতে গিয়ে "জয় বঙ্গবন্ধু "বলে শ্লোগান দেয়া, সরকারি জমি কিংবা সম্পত্তি দখল নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা এবং সজিব ওয়াজেদ জয় এর ছবি সংবলিত সাইনবোর্ড লাগিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা। আদম ব্যবসার সাইনবোর্ড লাগিয়ে চারপাশ থেকে টাকা উত্তোলন করে, কাজ না করে সেই টাকার মালিক বনে যাওয়া ইত্যাদি। কেও কেও জয় বাংলা বলে চালাচ্ছেন জমিজামার সেটেলমেন্ট ব্যবসা, কেও কেও গ্রুপের কর্মীদের পাঠাচ্ছে বিভিন্ন অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা ধনি কোন ব্যক্তির কাছে দলীয় কর্মসূচী পালনের নামে চাঁদা সংগ্রহ করতে। যে বা যারাই দিতে অনীহা প্রকাশ করছে, সাথে সাথে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পেয়ে যাচ্ছে জামাত, রাজাকারের তকমা। কোথাও জয় বাংলা বলে নিজস্ব সম্পত্তি থেকে কাওকে উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে বিরাট মুনাফা। কোথাও সাধারণ মানুষদেরকে মিথ্যা মামলা দায়ের করার ভয় দেখিয়ে অর্জিত হচ্ছে মুনাফা। এসব অনেক লাভজনক কর্মসূচি দিয়েই চলছে এই ডিজিটাল গ্রুপ গুলা। যে হারে গ্রুপ আর গ্রুপ লিডার বাড়ছে সেহারে মনে হয় নৌকার ভোট কিংবা আওয়ামীলীগার বাড়ছে না। এর প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ভাবে পেয়েছি বলে, মনে হচ্ছে আমার। কারন গ্রুপ আর গ্রুপ লিডারদের বর্তমান রেশিও যেহারে বেড়েছে সে ক্ষেত্রে তো দেশে বা শহরে তো জামাত - বি এন পি খুজে পাওয়ার কথা না।

কিন্তু এমন তো দেখা যাচ্ছেনা। কোথাও কোথাও তো এখনো ঘটা করে ১৫ই আগস্ট কে বেগম জিয়ার ভুয়া জন্মদিন পালন করতে দেখা যায়। কোথাও আবার এরকমও আছে যে সর্বক্ষণ কোন গ্রুপ লিডারের সঙ্গি হিসেবে চলা একটি লোক ঐ গ্রুপ লিডারের পাশে থেকেই বঙ্গবন্ধু কিংবা জননেত্রীর নামে মিথ্যাচরণ করছে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে তা ফলাও করে প্রকাশ করছে। তার কিছু সময় পরে আবার তাকে নিয়েই ফেসবুকে চেকইন বা হাস্যজ্জ্বল সেলফি দিচ্ছে। দেশে এখন শেখ হাসিনার চেয়ে বড় মুজিব প্রেমিক জন্ম নিয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন "লীগ" এর জন্মও হয়েছে। বিদ্যালয়ের গণ্ডি না পেরোনো ছেলেটি আজজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় ভাষণ দিচ্ছে। সেই স্বশিক্ষিত নেতাটিকে নিয়ে গুটি কয়েক শিক্ষিত কর্মী ভাই ভাই বলে খুশি করার চেষ্টা করছে। আগে যেখানে গ্রুপভিত্তিক রাজনীতিতে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা হতো আজ সেখানে প্রতিহিংসার নগ্ন প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত। আগে যেখানে নেতা এবং কর্মীর মধ্যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক থাকতো এখন সেখানে প্রভুত্বের সূচক মাপা হচ্ছে। যে কর্মী যত বেশী প্রভুভক্ত, সে কর্মী ততো বেশি সুযোগ সুবিধার মালিক।

২০০৫ ইং এ ছাত্ররাজনীতিতে ঢুকি তাই ২০০১-২০০৫ সালের চারদলীয় সরকার ব্যবস্থা খুব ভালো করেই মনে আছে আমার। সেই সময়ে দেখেছি বি এন পির কিছু অসাধু নেতা তাদের পেশী শক্তি বৃদ্ধি করতে চুর, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীদের দলে ভিড়িয়েছিলেন। প্রাথমিক অবস্থায় সেই নেতাদের অর্থনৈতিক অনেক মুনাফা হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু দলগত ভাবে তাদের কেমন মুনাফা আর লোকসান হয়েছে তা আমরা খুব সহজেই এখন পরিমাপ করতে পারি। সেই সন্ত্রাসী নেতা কর্মীদের ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিমসিম খেয়ে নতুন এক বাহিনী পর্যন্ত গঠন করতে হয়েছিলো। আগামী সময়েও যে নতুন এক বাহিনী হবেনা, সেটাও গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না। যাইহোক আমিও দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নই। কিন্তু দলীয় ক্ষতি হবে এমন কিছু করি নাইই, সেটা হলফ করে বলতে পারি। এতসব লেখার একটাই উদ্দেশ্য সেটা হল পারিবারিক ভাবেই আওয়ামীলীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি এক অকৃত্রিম ভালোবাসার শিক্ষা পেয়েছি। তাই চোখের সামনে সেটার ক্ষতি দেখতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।

ভুল কিছু লিখে থাকলে সাবেক ছাত্রনেতা না ভেবে একজন ক্ষুদে কর্মী ভেবেই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু

লেখক: সাবেক সহ সভাপতি, সিলেট জেলা ছাত্রলীগ।

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন