আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

রোহিদার কথা মনে হলে শুধু অসহায় মুখভঙ্গির ছবি ভাসে

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৪-০৬ ০১:৪৮:১৪

সুমনকুমার দাশ :: রোহীদা কী কারণে যেন বেঁকে বসে আছেন! লোকউৎসবে যাবেন না বলেই মনস্থির করলেন। সে কী রাগ! অথচ সেবারই প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে তাঁরই ওস্তাদের নামে ‘শাহ আবদুল করিম লোকউৎসব’। জীবিতদের মধ্যে তিনিই তখন করিমের প্রধান শিষ্য, অথচ সেই তিনি মান করে বসে রয়েছেন, এমনকি উৎসবে থাকবেন না বলেও ঘোষণা দিয়েছেন, তা কি হয়? রাগ ভাঙাতে তাঁর বাড়িতে গেলাম। সঙ্গে করিম-তনয় শাহ নূরজালালও। দুজনে মিলে অনেকক্ষণ ধরে তাঁর মান-ভাঙানোর চেষ্টা করলাম। তাঁকে বললাম, ‘দাদা, আপনার ওস্তাদের নামে প্রথমবারের মতো বড়ো উৎসব হচ্ছে। দেশের প্রখ্যাত মানুষেরা আসছেন। আর আপনি থাকবেন না? এটি যদি আপনার ওস্তাদ জানেন, তাহলে তিনি এই শেষ বয়সে কতটুকু কষ্ট পাবেন, বুঝতে পারছেন?’ এ-কথায় বেশ কাজ দেয়, তিনি নিঃশব্দে খুব সম্ভবত একটি ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে রওয়ানা হন আমাদের সঙ্গে উৎসব মঞ্চে। সেবার তাঁর নেতৃত্বে করিম-রচিত ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে’ গানটির মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল লোকউৎসবের সাংস্কৃতিক পর্বের।

দুপুরে লোকউৎসব উদ্বোধন শেষে সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয়েছিল গানের আসর। সে রাতে বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন রোহীদা। তাঁর মনে তীব্র কষ্ট, প্রচণ্ড অভিমান। সেই কষ্ট-অভিমানের ছাপ যেন পড়ল তাঁর গাওয়া গানেও! বিচ্ছেদ যেন উপচে পড়ছিল তাঁর গলায়! গান শেষে ঘন অন্ধকার সঙ্গী করে রোহীদা আর আমি বোরো জমির আল ধরে অনেকদূর হেঁটেছিলাম। তিনি হাঁটছিলেন আর আক্ষেপ করছিলেন, এতদিন ধরে গান করছেন। এরপরও শিল্পী হিসেবে যথাযথ মর্যাদা তিনি নাগরিক সমাজে পেলেন না! আমি তাঁকে বলি, ‘সমস্তটাই আপনার ভুল ধারণা। আপনার সুমধুর কণ্ঠ আর করিম-শিষ্য হিসেবে সমাজে অনেক গুরুত্ব আপনার। মানুষজন আপনাকে অনেক শ্রদ্ধা করে। আপনার কণ্ঠকেও প্রচ- ভালোবাসে।’ কিন্তু রোহীদা কী যেন বলতে গিয়েও আর বলেন না, চেপে যান, কিছুই বলেন না, কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন! রাতের অন্ধকারে হাওরে সেদিন কিছুটা ঝড়ো বাতাস বইছিল, সম্ভবত সে কারণেই রোহীদা মাঝেমধ্যে তাঁর লম্বা চুল গোছাতেই বারবার নিজ মাথায় হাত বোলাচ্ছিলেন। ঘণ্টাখানেক এমনিভাবে হেঁটে, এমনিভাবে হাওরের লিলুয়াবাতাস গায়ে মাখিয়ে আমরা পুনর্বার উৎসবমাঠে ফিরলাম। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে রোহীদার সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে গেলাম। সে রাতে মুড়ি চিবোতে চিবোতে আর হাতল-ভাঙা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রোহীদার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠি। তাঁর সামনে রেখে দিই আমার পুরোনো অডিও-রেকর্ডার। সেই রেকর্ডার ধারণ করতে থাকে রোহীদার কণ্ঠ, রোহীদার জীবনের গল্প, রোহীদার পাওয়া না-পাওয়ার দুঃখগাথা। এভাবে আড্ডা-গল্পে বেশ সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে গিয়েছিলাম উজানধল গ্রামের মাঠে, লোকউৎসবের মূল মঞ্চে, যেখানে একের পর এক গান গেয়ে মঞ্চ মাতাচ্ছিলেন বাউলশিল্পীরা।

সে রাতের পর রোহীদার সঙ্গে আরও বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে। এর প্রায় বছর খানেক পর একদিন শুনতে পাই, রোহীদা খাদ্যনালীর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। অভাব-অনটনে সংসার চালানোই যখন তাঁর পক্ষে মুশকিল, সেখানে চিকিৎসার খরচ সংগ্রহ করতে হিমশিম খাওয়াই স্বাভাবিক। রোহীদা তাই উপায়ন্তর না দেখে চিকিৎসাই বন্ধ করে দেন! পরে পারিবারিক উদ্যোগের পাশাপাশি নানা শুভানুধ্যায়ী আর পরিচিতজনদের প্রচেষ্টায় তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু, সেটাও বেশি দিন করা সম্ভব হয়নি। একসময় সব ছেড়েছুড়ে ঠিকই চলে গেলেন অভিমানী রোহীদা। রোহীদার দেহত্যাগের খবরটি যখন শুনতে পাই, তখন আমার একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসব চলছিল। আর এ বইটি ছিল তাঁরই ওস্তাদ শাহ আবদুল করিমের জীবন ও কর্মভিত্তিক আমারই সম্পাদিত ‘শাহ আবদুল করিম সংবর্ধন-গ্রন্থ’ বইয়ের। বইটি প্রকাশ হওয়ার পর একটি কপি রোহীদার হাতে তুলে দিয়েছিলাম, অসুস্থ রোহীদা বইটি হাতে নিয়ে চরম শারীরিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও তৃপ্তির হাসি হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ওস্তাদজিকে নিয়ে এর আগে কোনও বই লেখা হয়নি। খুব ভালো লাগছে এ বইটি দেখে।’

সেই রোহীদা চলে গেলেন, এমন এক সময় গেলেন, যখন তাঁরই গুরুভাই আবদুর রহমান-কাইয়ূম শাহ-হারুন অর রশীদ-দুখু মিয়া-লাল শাহরা আমার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে রোহীদারই পছন্দের গান ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো, আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে’ গানটি গাইতে মত্ত ছিলেন। এটাই ছিল আমার কোনও বইয়ের প্রথম প্রকাশনা অনুষ্ঠান। আবুল মাল আবদুল মুহিত-আনিসুজ্জামান-মুহম্মদ জাফর ইকবালদের মতো গুণীজনেরা প্রকাশনা উৎসবে উপস্থিত। এ আনন্দঘন মুহূর্তে আমার চোখে অশ্রু থাকাই স্বাভাবিক। তাই আমার চোখেও সেদিন অশ্রু ছিল। কিন্তু, এ অশ্রু তো আনন্দের নয়, এ অশ্রু যে বড়োই বেদনার, এ অশ্রু যে কেবলই রোহীদার জন্য। উৎসব শেষে বাসায় ফিরে সেদিন আমার সংগৃহীত কিছু পুরোনো পা-ুলিপি ঘাঁটতে থাকি, খুঁজতে থাকি আমার কাছে থাকা রোহীদার হাতের লেখা চিরকূটটি, যে চিরকূটটি তিনি লিখে দিয়েছিলেন সেই লোকউৎসবের রাতে। পড়তে থাকি রোহীদার লেখা কথাগুলো, ‘সুমন বাবু, মাঝেমধ্যে মনে হয়, শিল্পী হওয়াটাই বোধহয় আমার ঠিক হয়নি। কেউ না-বোঝে শিল্পের সম্মান, না-বোঝে শিল্পীর মর্যাদা। তবে এ জন্য আমার কোনও অভিমানও নাই।’ চিরকূটে কেন রোহীদা এমন লিখেছিলেন জানি না, তবে এটা যে তাঁর প্রচ- অভিমানের কথা, সেটা অনুমান করতে আমার ভুল হয় না। অভিমানী ভাটির শার্দুল অভিমান নিয়েই চলে গেলেন। কেবল জানতে পারলাম না, বুকের ভেতরে কি এমন অভিমান জমা ছিল তাঁর?

পরে, বেশ পরে, সিলেট নগরের তালতলা এলাকার একটি সিডি-দোকানে স্থানীয় লোকগানের অ্যালবাম কিনতে গিয়ে রোহীদাকে নিয়ে প্রকাশিত একটি তথ্যচিত্রের অ্যালবাম দেখতে পাই। লোকগানের দরদী মানুষ ও সংগঠক কামাল উদ্দিন রাসেল প্রযোজিত এবং শামসুল ইসলাম শামীমের পরিকল্পনায় মু. নাছিবুর রহমান খান পরিচালিত ‘হৃদয়ের ক্যানভাসে’ শীর্ষক এ তথ্যচিত্রটি প্রকাশ করেছিল স্টারডম ভিজ্যুয়াল। মুহূর্তেই এটি কিনে নিয়ে বাসায় ফিরে তাৎক্ষণিক কম্পিউটারে চালু করে দিই। তথ্যচিত্রটি দেখি, আর কাঁদি। রোগ-শোকে জর্জরিত নাকে নল-ঢুকানো অবস্থায় বসে থাকা অসুস্থ রোহীদা থেমে থেমে কাশছেন আর বলছেন, ‘আমার অসুস্থতার বেলায় আমাকে অনেকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। আমি উনাদের কাছে চিরঋণী। আমি উনাদের ঋণ শোধ করতে পারব না। তবে আমি একটা জিনিস বুঝেছি, যে, মানুষ মানুষকে এখনও ভালোবাসে।’ বুকটা চ্যাৎ করে ওঠে রোহীদার জন্য। এরপর থেকে যতবারই আমার রোহীদার কথা মনে হয়েছে, ততবারই তাঁর ওই ন্যাড়া মাথার নাকে নল-ঢুকানো অসহায় মুখভঙ্গির ছবিটিই বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শত চেষ্টা করেও রোহীদার হাস্যেজ্জ্বল কোনও চেহারা আমি চোখে ভাসাতে পারি না।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন