আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

বর্ষায় পানিবন্দি হাওর কন্যা সুনামগঞ্জ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৬-২৯ ১৫:১৪:২২

হিল্লোল পুরকায়স্থ :: হাওর এলাকা বলে বাংলাদেশে সুনামগঞ্জের নাম বেশ ভালই পরিচিতি আছে। পানির দেশ বা ভাটিরদেশ মানেই হচ্ছে হাওরাঞ্চল, আর হাওর অঞ্চল হিসেবে সুনামগঞ্জের নাম কম বেশি সবার জানা।

সুনামগঞ্জকে বলা হয় হাওর কন্যা। আর এই হাওর কন্যা ১১ টি উপজেলা নিয়ে গঠিত।

বিশ্বম্ভরপুর, ছাতক, সুনামগঞ্জ, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুর, দোয়ারাবাজার। আর এই সব এলাকা মূলত হাওর বেষ্টিত।

আর এই  হাওর অঞ্চলে বর্ষা থাকে বছরের প্রায় ছয় মাস বাকি কয় মাস এখানে শুকনো কাল। বর্ষার দিনে এই হাওর অঞ্চলের নদীগুলোই ফুঁসে উঠে দুই তীর ছাপিয়ে প্লাবিত করে ফসলের মাঠ। এই সময় নদীগুলো হাওরের সাথে মিশে পরিনত হয় সাগরে।

পানিবন্দি হয়ে পড়ে গ্রামের মানুষ গুলো। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর একেকটাকে দেখতে ছোট দ্বীপের মতো লাগে। দূর থেকে গ্রামগুলো দেখলে  মনে হয়, পানিতে বনজ উদ্ভিত ভাসছে। ছোট বেলায় শোনে ছিলাম আমাদের এই হাওর অঞ্চল নাকি এক সময় কালিদহ সাগর ছিল। আর এই কালিদহ সাগর কালক্রমে ভূপ্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে নিম্ন সমতলভূমিতে পরিণত হয়। এই নিম্ন সমতলভূমিই এখন হাওর। হাওর শব্দটিও সাগর শব্দের অপভ্রংশ। সাগর থেকে সায়র, সায়র থেকে হাওর।

বর্ষায় হাওর হয়ে ওঠে কূলহীন সাগর যে দিকে চোখ যায় সেই দিকে শুধু পানি আর পানি। আর এই বর্ষায় পানিবন্দির স্বীকার হয়ে পড়ে হাওর পাড়ের মানুষ গুলো, পড়তে হয় তাদের নানা সমস্যায়। সুনামগঞ্জের সবকয়টি উপজেলা হাওর বেষ্টিত অঞ্চল হওয়ায় কম বেশি সবাইকে নানা জটিলতার স্বীকার হতে হয়। বিশেষ করে  হাওর অঞ্চলের  কৃষকদের ভোগতে হয় বেকারের সমস্যায়। এসময় তাদের কোন কাজ থাকেনা শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদে মহাব্যস্থ এই কৃষক ছয় মাস বেকার থাকার ফলে তাদের পড়তে হয় অভাব অনটনে। পানিবন্দি এই মানুষ গুলো পায় না কাজের সন্ধান। ফলে এক ফসলি জমিনের আয় দিয়ে সারা বছর চলতে গিয়ে তাদের অভাব অনটন ধারদেনা তাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে পরে। বর্ষার দিনে এই পানিবন্দি কৃষকগুলো  তাস, ঘাফলা সহ বিভিন্ন খেলা খেলে ও গল্প, আড্ডায় সময় পার করে। আর এসময় হাওরবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা। তখন নৌকাই হয়ে উঠে তাদের  যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। অনেকে হাওর বা নদী পার হতে ব্যাবহার করেন কলা গাছের  বা ডামের ভোরা। আর পানিবন্দি অনেক গ্রামের মানুষ নৌকা না পেয়ে প্রয়োজনের সময়ও যেথে পারেন না নিকটবর্তী শহরে। যাতাযাতের অভাবে অনেক জটিল রোগীদের সময় মত নিতে পারেনা হাসপাতালে।

শুধু কি তাই হাওরে যখন বাতাস দীর্ঘস্থায়ী হয় তখন ঢেউয়ের প্রখরতা বাড়তে থাকে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর আর তখন পাড় ভাঙ্গা থেকে শুরু করে বাড়িঘর ভাঙতে থাকে।

আর এই ঢেউ থেকে ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য বছরের পর বছর  লড়াই করতে হয় হাওরবাসীকে। ভাঙন প্রতিরোধে  ইট, বাঁশ, বস্তা, কচুরিপানা  দিয়ে বাড়ির চারপাশে নির্মাণ করতে হয় শক্ত বাঁধ। হাওর উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, হাওরবাসী তাদের আয়ের ১/১৬ অংশ ব্যয় করেন এ প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মানে। আর এই  প্রতিরক্ষা দেয়াল বছরের পর বছর  ঢেউ এর আঘাতে লন্ড-ভন্ড হয়ে গ্রামের পর গ্রাম  ভেঙ্গে  হাওরবাসীকে চরম দুরভোগে ফেলছে।

বর্ষায় বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় স্কুল, কলেজ ছাত্র ছাত্রীদের গ্রামের চারি পাশে পানির বিশালতা  স্কুল কলেজের দূরত্ব।যোগাযোগের জন্য যানবাহন না পেয়ে  স্কুলে যাওয়া তারা বন্ধ করে দেয়ে।বিশেষ করে এই সমস্যায় বেশি ভোগে প্রাইমারি স্কুলের ছাত্ররা, দুই তিন গ্রামে একটি স্কুল তাও  গ্রাম গুলো থাকে দূর দূর নৌকা ছাড়া যাতাযাতের আর থাকেনা কোন পথ। এমনিতেই হাওরের স্কুলগুলো বর্ষায় ছাত্র,ছাত্রী ও শিক্ষকের উপস্থিতির অভাবে প্রায়ই বন্ধ থাকে।বর্ষাকালে হাওর এলাকার প্রতিটি গ্রাম জলবন্দি হয়ে পড়ে। ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে পরে। বিশাল হাওর পাড়ের অসহায়  মানুষ গুলো এ ভাবেই যুগ যুগ ধরে পানিবন্দি হয়ে দারিদ্রতা, শিক্ষা, চিকিৎসার অভাব, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলছে সুনামসগঞ্জ জেলার হাওরাবাসীর জীবন যুদ্ধ।

লেখক: সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

@

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন