আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

২০ বছর আগের প্রতিশোধ, নাকি প্রত্যাবর্তন?

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৮-০৭-১৫ ১৯:৪৩:৪৯

দেবব্রত ঘোষ চৌধুরী :: ২০১৮ বিশ্বকাপ ফুটবলে শিরোপার লড়াইয়ে মুখোমুখি ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া। এবার কি তবে ২০ বছর আগের সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ারহারের প্রতিশোধ? নাকি ২০ বছর আগের ফ্রান্সের সেই রাজকীয় প্রত্যাবর্তন। রাতে ফাইনালের শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গুণতে হবে। শিরোপা জয়ের মহারণে বাংলাদেশ সময় রাত ৯ টায় মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হবে দু’দল।

এরই মধ্যে ‘উট শাহীন’ ফাইনালে কে জিতবে তা নির্ধারণ করে ফেলেছে। এবার তার ভাষ্য হচ্ছে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে জায়গা করে নেয়া ক্রোয়েশিয়ার ঘরেই যাবে রাশিয়া বিশ্বকাপের শিরোপা! তাহলে তো হলোই। কিন্তু বাস্তবে কি তা ঘটবে? কে জিতবে? কে হাসবে শেষ হাসি? এ নিয়ে নানান যুক্তি পাল্টা যুক্তির শেষ নেই। কেউ বলবেন ফ্রান্সের গতি আর রক্ষণভাগের কথা। পাল্টা যুক্তি ক্রোয়েটদের লড়াকু মানসিকতা আর তাদের সেরা মধ্যভাগ। গত ৩ ম্যাচে ১২০ মিনিট করে খেলে তারা সেটির প্রমাণ দিয়েছে।

আসরের শেষ লড়াইয়ে দুই দলের মধ্যে যে দল, আজ কম ভুল করবে কিংবা যে দল প্রাপ্ত সুযোগ মিস করবে না, তারাই এগিয়ে থাকবে। তারাই তোলে ধরবে বিশ্বকাপ ট্রফি। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে ফ্রান্স। তারা ইতিমধ্যে ১৫ বার বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে ২ বার ফাইনাল খেলে ১ বার চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। আরএবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে সেমিতে ইংল্যান্ডকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে ক্রোয়েশিয়া।

যদিও ক্রোয়েশিয়ারও রয়েছে বিশ্বকাপে শুরু থেকে খেলার ইতিহাস! ঐতিহ্যশালী ফুটবল ইতিহাসেরই উত্তরাধিকার বহন করছেতারা। যদিও এটা খন্ডিত উত্তরাধিকার। ক্রোয়েশিয়াকে ‘নবাগত’ আখ্যা দেওয়া হলেও যুগোস্লাভিয়া ছিল ফুটবল পরাশক্তি। ১৯৩০-র প্রথম বিশ্বকাপে তারা সেমিফাইনালে উরুগুয়ের কাছে হারে। ১৯৬২-তে চতুর্থ হয়। ১৯৯০সালে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে। মারাদোনার আর্জেন্টিনার কাছে হেরেছিল সেবার। খেলার শৈলীর জন্য যুগোস্লাভিয়াকে ‘ইউরোপের ব্রাজিল’ বলা হতো। ১৯৮৭ সালে যুগোস্লাভিয়া বিশ্ব যুব ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়। এই টুর্নামেন্টই এখন অনুর্দ্ধ-২০ বিশ্বকাপ নামে পরিচিত। সেই দলে ডেভোর সুকের, জোভিনমির বোবান, রবার্ট জারনি, রবার্ট প্রোসিনেস্কি ছিলেন। ১৯৯৮ সালে ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপ দলেও ছিলেন তাঁরা। ১৯৯১ সালে যুগস্লাভিয়া থেকে বের হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর যুগস্লাভিয়ার উত্তরসূরী এই ক্রোয়েটরা ১৯৯৮ সালে ক্রোয়েশিয়া নামে প্রথম বিশ্বকাপে আসে।

বিশ্বসেরা দুই ক্লাব বার্সেলোনা এবং রিয়াল মাদ্রিদের দুই সেরা মিডফিল্ডার ইভান রেকিটিচ এবং লুকা মদ্রিচ। সঙ্গে মাতেও কোভাচিচ, ইভান পেরিসিকের মত মিডফিল্ডার তাদের নিয়ে শক্তিশালী মিডফিল্ড ক্রোয়েশিয়ার। শুধু মিডফিল্ড নয় আক্রমণেও রয়েছেন সেরা তারকা। জুভেন্টাসের মারিও মানজুকিক, এসি মিলানের নিকোলা কালিনিক। ডিফেন্সে ডিজান লোভরেন, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সিমে ভারসালকো, সাম্পদোরিয়ার ইভান স্ট্রিনিকরা রয়েছেন। তারপরও দলটিকে নিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর দিকে কেউ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হওয়ার জন্য বাজি ধরতে রাজি হননি। কারণ অবশ্য ছিল। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ইউরোপ অঞ্চলের ৫৪টি দেশের মধ্যে ৯টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একে অপরের সাথে হোম এওয়ে পদ্ধতিতে খেলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ানরা সরাসরি উত্তীর্ণ হয়। আর সেরা ৮টি রানারআপের মধ্যে প্লে অফ ম্যাচ খেলে আসে আরও ৪টি দল। ক্রোয়েশিয়ার আই গ্রুপের দল গুলো ছিল আইসল্যান্ড, তুরস্ক, ফিনল্যান্ড, কসোভো, ইউক্রেন। কিন্তু চ্যাম্পিয়ান হতে পারেনি ক্রোয়েটরা। চ্যাম্পিয়ান হয় আইসল্যান্ড।পরে গ্রুপের সেরা ৮টি রানারআপ দল ইতালি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, রিপাবলিক আয়ারল্যান্ড ও গ্রিসের সাথে প্লে অফ ম্যাচ খেলতে হয়।প্লে অফে গ্রিসকে ৪-১ গোলে হারিয়ে নাম লেখায় রাশিয়া বিশ্বকাপে।

বিশ্বকাপ শুরুর আগে প্রস্তুতি ম্যাচেওব্রাজিলের কাছে পরাজয়। সব কিছু মিলিয়ে সেরা মিডফিল্ড তবে বড়জোড় কোয়ার্টার ফাইনাল এ পর্যন্তই ধরে নিয়েছিল সবাই। কিন্তু এবাররের বিশ্বকাপ শুরু হতে হতে ডালিকের শিষ্যরা তাদের জাত চেনাতে শুরু করে।ফুটবল আকাশে ক্রোয়েশিয়ার উদয় যেন ধুমকেতুর ন্যায়। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে প্রথমবার এসেই সেমিফাইনাল খেলেছিল পূর্ব ইউরোপের দেশটি। ডেভর সুকার জিতেছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা গোল্ডেন বুটের পুরস্কার।

এবারের আসরের প্রথম ম্যাচেই আফ্রিকান সুপার ঈগল নাইজেরিয়া এবং ইউরোপিয়ান পাওয়ার হাউজ ক্রোয়েশিয়া মুখোমুখি হয়েছিল। তাদেরকে ২-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের জানান দেয়। দ্বিতীয় ম্যাচে বিশ্বেও সেরা খেলোয়াড় মেসির আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গেলে বিধ্বস্ত করে জানান দেয় এবার তার শুধু খেলতেই আসেনি। জিততেও চায় সোনালী ট্রফিটা। শেষ ম্যাচে জয়ের লক্ষ্য নিয়ে ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল আইসল্যান্ড। ২-১ গোলে আইসল্যান্ডকে হারিয়ে ‘ডি’ গ্রুপ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়েই দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে ক্রোয়েশিয়া।

বিশ্বকাপে টানা তিনটি ম্যাচ এর আগে কখনও জেতেনি ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯৮ সালে সেমিফাইনাল খেললেও গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচ টানা জিততে পারেনি ডেভর সুকারের দল। দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলায় ক্রোয়েশিয়ান গোলরক্ষক সুবাসিচ অসাধারণ নৈপুণ্য দেখি ডেনিসদের তিনটি পেনাল্টি রুখে দিয়ে চলে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে।পরে টাইব্রেকারে রাশিয়াকে হারিয়ে সেমিতে ওঠে ক্রোয়েশিয়া। শিরোপা জয়ের কত প্রস্তুতিই না সেরে রেখেছিল ইংল্যান্ড! ৫২ বছর পর আবারও সোনালি ট্রফিটা হ্যারিকেইনের হাতে শোভা পাবে- এই আশায় ইংলিশরা মস্কোয় এসে তাবু গেঁড়ে বসেছিল। ‘ফুটবল ইজ কামিং বেক’ গানে মুখরিত ইংলিশদের স্বপ্নে পেরেক ঠুকে দেয় তারা। সেমিফাইনালের পুরো ম্যাচেই পরিসংখ্যানে নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে আসে ক্রোয়েশিয়া।

অন্যদিকে বিশ্বকাপের শুরুতে ফ্রান্স ছিলো কাগজে কলমে সবচেয়ে শক্তিশালী দল। তাদের মধ্যভাগ, আক্রমনভাগ অনেক ভাল। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী তাদের রক্ষণভাগ। এরকম প্রচারণা ছিল খুউব বেশি। তবে বাছাইপর্বে বেলারুশ, লুক্সেমবার্গের মত দলের সাথে ড্র, প্রীতি ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রকে হারাতে না পারা- সব মিলিয়ে বিশ্বজয়ের মিশনের আগে কিছুটা হতাশই ছিল ফ্রান্সের সমর্থকেরা। ইনজুরির কারনে পায়েটের বিশ্বকাপে আসা হয়নি এবার। জায়গা হয়নি দুই ফরোয়ার্ড আলেকজান্দ্রে লাকাজেত ও অ্যান্থনি মার্শিয়ালের। করিম বেনজেমা টিকলেন না ২৩ সদস্যের দলে। এসব নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তাতেই ছিলেন তাদের সমর্থকরা। তবে কোচ দেশাম আতলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে ইউরোপা লিগ জেতা অতোয়ান গ্রিজম্যান, প্যারিস সেইন্ট জার্মেইন (পিএসজি) ফরোয়ার্ড কিলিয়াম এমবাপের সঙ্গে বার্সেলোনা তারকা উসমানে দেম্বেলে এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মিডফিল্ডার পল পগবার উপর ভরসা রাখেন।

ইতালির বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ভালো ফুটবলের ইঙ্গিত দিয়েছিল ১৯৯৮ এর বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক বর্তমান কোচ দেশামের দল।কিন্তুনিজেদের প্রথম ম্যাচে নিষ্প্রাণ খেলায় সেই ইঙ্গিত পুরোটাই নিভে যায়। অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ মিশন সাদামাটাভাবে শুরু করে। দ্বিতীয় ম্যাচ পেরুর বিরুদ্ধে কস্টার্জিত ১-০ গোলের জয়। শেষ ম্যাচে ডেনমার্কও রুখে দিয়েছিল ফ্রান্সকে। এ নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়েগিয়েছিল এবারের কাগুজে বাঘ ফ্রান্স। কিন্তু ইউরো কাপ হাতছাড়া হওয়ারপর থেকে হতাশায় থাকা খেলোয়াড়রা দ্বিতীয় রাউন্ডেই তাদের ম্যাজিক দেখাতে শুরু করে। তারুণ্যদীপ্ত গতির কাছে হার মানতে হয় আর্জেন্টিনাকে। যদিও বিপরীতে ৩টি গোল খেয়ে তারেদ দুর্ভেদ্য রক্ষণভাগকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। তবেছয় ম্যাচে ফ্রান্সের জালে বল ঢুকেছে মাত্র চার বার।

তবে কাভানী বিহীন ডানাভাঙ্গা উরুগুয়েকে আটকে রাখতে সক্ষম হয় তাদের রক্ষণভাগ।যদিওস্যামুয়েল উমতিতি ও রাফায়েল ভারানের নেতৃত্বে তাদের অসাধারণ রক্ষণভাগ বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। কোয়ার্টারে ব্রাজিলের ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া লুকাকুরা সেমিফাইনালে পুরো ৯০ মিনিট খেলেও ফ্রান্সের রক্ষণভাগ ভেদ করতে পারেনি। শুরুতে ১ গোলে এগিয়ে গিয়ে ফ্রান্স নিজেদের খোলসের ভিতরে নিয়ে যায়। এই ফল ধরেও রাখে শেষ পর্যন্ত।সেমিফাইনালে এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রুইনা ও রোমেলু লুকাকুর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে ফ্রান্সের রক্ষণভাগে। বেলজিয়াম উরুগুয়ের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের রক্ষণভাগের পারফর্মেন্স ছিল অসাধারণ। ফ্রান্সের রক্ষণকে খুব কমসংখ্যক বার পরাস্ত করা গেছে।

আর্জেন্টিনার সাথে ঝড় তোলা এমবাপে নয় ফ্রান্সের তুরুপের তাস মিডফিল্ডার এনগোলো কানটে। অসামান্য স্টামিনা নিয়ন্ত্রন নিখুঁত পাস ফলাফল গড়ে দিচ্ছে প্রতিটি দলের বিরুদ্ধে।আর্জেন্টিনাকে যে ম্যাচে ফ্রান্স হারালো, সেখানে মেসিকে ঠিকমতো খেলতে দেননি এই কানটে। সে কারণেই আর্জেন্টিনার সাথে ম্যাচে মেসিকে কেউ তেমন দেখেনি। সেমিফাইনাল পর্যন্ত কানটে মাঠে দৌড়েছেন প্রায় ৬৩ কিলোমিটার। একমাত্র রুশ মিডফিল্ডার রোমান জবিন তার চেয়ে সামান্য বেশি দৌড়েছেন।

ফ্রান্সের খেলোয়াড় পগবার কথায় পাওয়া যায় হিসাব।‘ক্রোয়েশিয়া দলটা অত্যন্ত শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ।মনে করি না ম্যাচ ১২০ মিনিট বা টাইব্রেকার পর্যন্ত গড়াবে। ওটা নিয়ে ভাবছিও না। আমাদের স্বপ্ন বিশ্বকাপ ছোঁয়া। ফ্রান্স যখন বিশ্বকাপ জেতে (১৯৯৮-তে) তখন আমি শিশু ছিলাম। বিশ্বকাপ জেতার আবেগটা বুঝতে পারিনি। সে জন্য ওটা হাত দিয়ে ধরতে চাই।’

ছয় বছর বয়সে লুকা মদরিচের দাদুকে গুলি করে মেরেছিল সার্ব জঙ্গিরা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল বসতভিটে। বাবা যোগ দিয়েছিলেন গেরিলা বাহিনীতে। সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় তখন ক্রোটদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল সাত বছরের লুকা মদরিচকে। গুলি, বোমা, গ্রেনেড বিস্ফোরণ পেরিয়ে ঠাঁই মিলে ছিল এক হোটেলে। সেই হোটেলের সামনের ফুটপাথেই ফুটবল খেলার হাতেখড়ি। তাদের উপর ভরসা করেই লুঝনিকি স্টেডিয়ামর প্রেস সেন্টারে এসেছিলেন ক্রোয়েশিয়ার কোচ দালিচ। বলে দিলেন, ‘আর একটা ইতিহাস গড়ার জন্য ছেলেরা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। আমি আশাবাদী আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ডের মতো টিমকে আমরা হারিয়েছি। এবার ফ্রান্সকেও হারাব।’

লেখক: ব্যুরো প্রধান, দেশ টিভি, সিলেট অফিস।

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন