আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

যেভাবে আউলিয়ার নামে অপরাধী চক্র গড়ে ‘গডমাদার’ হয়ে ওঠেন পাপিয়া

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০২০-০৩-০৭ ১৯:৫৬:১৮

সিলেটভিউ ডেস্ক :: যুব মহিলা লীগ থেকে বহিস্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার অনেক ছবিই গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এসব ছবিতে তার হাতে আঁকা কিছু উল্কি বা ট্যাটু অনেকেরই চোখে পড়েছে। এই ট্যাটুতে বিশেষ কায়দায় লেখা ইংরেজি তিনটি অক্ষর, কেএমসি। পাপিয়ার মতো নকশা করা ট্যাটু না হলেও বাহুতে কেএমসি লেখা কিছু তরুণকে উদ্ধতভঙ্গিকে দলবেঁধে নরসিংদী শহরে দাপিয়ে ফিরতে দেখা যেত কিছুদিন আগেও। তবে পাপিয়া বহিস্কৃত ও গ্রেপ্তার হওয়ার পর এদের অনেকেরই দেখা মিলছে না। কেউ কেউ আবার দলছুট হয়ে লম্বা ফুলহাতা শার্ট পড়ে হাতের কেএফসি ঢেকে চুপিসারে বাইরে চলাফেরা করছেন।

কেবল দেহবিনোদনের জন্য সুন্দরীদের দল গড়েই ক্ষ্যান্ত দেননি মক্ষীরানি পাপিয়া। নরসিংদীর উঠতি বয়সী কিশোর-তরুণীদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন এই ‘কেএফসি’ বাহিনী। শহরের অনেকের কাছেই এরা ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। এদের কাজ ব্যবসায়ী অথবা সাধারণ মানুষকে ধরে এনে অথবা ফোন করে ডেকে নিয়ে টাকা আদায়, জমি দখল, চাঁদাবাজি। এরা নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতেন একটি একতলা বাড়ি। নরসিংদীর দাস পাড়ার ওই বাড়িতে শামীমা নূর পাপিয়ার মালিকাধীন ‘কেএমসি কার ওয়াশ অটো সলিউশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও মুলত এটি ছিল যুব মহিলা লীগ নেত্রীর গড়ে তোলা বাহিনীর হেডকোয়ার্টার। এদের পরিচালনা ও সমন্বয়ের কাজটি করতেন তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে মতি সুমন।

অসামাজিক ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগ র‌্যাব পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের অপকর্মের বিশ্বস্ত কেএমসি বাহিনীর নাম সামনে আসে। এর আগে এদের দাপটের কথা আতংকে কেউ বলার সাহস পায়নি। মূলত এই বাহিনীর সদস্যদের সিংহভাগই যুব লীগের সঙ্গে জড়িত। যুব মহিলা লীগের নেত্রী হিসেবে পাপিয়ার সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। নিজের আধিপত্য আর অবাধে অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য যুবলীগের উঠতি বয়সী কর্মীদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে গঠন করা হয় কেএমসি বাহিনী। এ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের হাতে ছিল কেএমসি লেখা আলাদা ট্যাটু। মাদক পরিবহন, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, কাউকে ধরে এনে মারধর করা, জমি দখলে অংশ নেওয়ারি কাজ করতো এই ‘কেএমসি বাহিনী’।

কেএমসি মানে ‘খাজা মইনুদ্দীন চিশতি’। নিজের অপকর্ম চালিয়ে যেতে পাপিয়া তার গড়া অপরাধী চক্রের নাম রাখেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আউলিয়ার নামে। এ বিষয়ে নানাজনকে তিনি বলতেন, খাজা মইনুদ্দীন চিশতির দরগাহে গিয়ে তাঁদের ভাগ্য ফিরেছে। তাই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর নিজের বাহিনীর নাম দিয়েছেন কেএমসি।

পাপিয়া ও তাঁর স্বামী সুমন গ্রেপ্তার হলেও কেএমসি বাহিনীর সদস্যদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি নরসিংদী আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা-কর্মী প্রথম আলোকে বলেছেন, কেএমসি বাহিনীর সদস্য ৩০ থেকে ৩৫ জন। এদের মধ্যে রয়েছে—ভাগদী এলাকায় পাপিয়ার বড় ভাই সাব্বির আহমেদ, ছোট ভাই সোহাগ আহমেদ, মেহেদী খন্দকার, মাইনুদ্দীন খন্দকার, জসিম খান (স্থানীয় একটি কারখানায় কাজ করে), মাহমুদুল হাসান ভুবন, বাবু (মুদি দোকানদার), সেলিম, আবির, সাব্বির খন্দকার, সাদেক, আলভী, প্লাবন, মোবারক (চায়ের দোকানদার), মেরাজ, রাসেল ও জুয়েল। দত্তপাড়া এলাকার সানি (ফুচকা দোকানি), ব্রাহ্মন্দী এলাকার মিয়া মো. আজিজ, মিয়া শাকিলা জাহান, রুহি মোসাব্বির, মোস্তফা মুনমুন, আলম মো. জুবায়ের, দাসপাড়া এলাকার সাগর, রেজাউল, অনিক, ফরহাদ, হিমেল ও রাব্বি। তাঁরা সবাই পাপিয়ার বেতনভুক্ত। পাপিয়া-সুমন শহরে এলে তাঁরা গাড়ির সামনে–পেছনে মোটরবাইক নিয়ে মহড়া দেন। শহরের ভাগদী ও ব্রাহ্মণদী এলাকার যুবকেরা মূলত কেএমসি বাহিনীর সদস্য। পাপিয়া গ্রেপ্তারের পর সবাই গা ঢাকা দেন। এখন কাউকে আর এলাকায় দেখা যাচ্ছে না।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়া, তাঁর স্বামী সুমনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তিনটি মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

পাপিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, পাপিয়া ও সুমনের হাতেও বাহিনী প্রতীকের উল্কি আছে। এ ছাড়া পাপিয়ার ডান বাহুতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থাপনার ছবি ও বাঁ বাহুতে এক দেবীর ছবির উল্কি রয়েছে। র‍্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, পাপিয়ার কর্মকাণ্ড ও জীবনযাপন ছিল খুবই রহস্যময়। যেমন নিজের বাসা ছেড়ে তিনি দিনের পর দিন পাঁচ তারকা হোটেলে থাকতেন। সিনেমার নায়িকাদের মতো সাজগোজ করে গানের দৃশ্য ভিডিও করতেন, সুইমিংপুলে মেয়েদের নিয়ে নাচানাচি করতেন, অস্বাভাবিক সাজতেন এবং সঙ্গের মেয়েদের সেভাবে সাজতে বাধ্য করতেন। ফেসবুকে তাঁর সমর্থকের সংখ্যা ৩৫ হাজারের মতো।

র‍্যাব জানায়, পাপিয়ার আয় বলতে ছিল মাদক ব্যবসা, দালালি আর চাঁদাবাজি। বিভিন্ন লোককে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন। পুলিশ ও রেলওয়ের বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে তিনি টাকা আদায় করেছেন, এমন তথ্যপ্রমাণ র‌্যাবের হাতে আছে। জমি কেনাবেচা, ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়া, সিএনজি স্টেশনের অনুমোদন পাইয়ে দেওয়া, শিল্পকারখানায় গ্যাস–সংযোগ করে দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজের লাইসেন্স ও অনুমোদন এনে দেওয়ার মধ্যস্থতা করতেন তিনি। আর এসব কাজ পাওয়ার টোপ হিসেবে পাঁচ তারকা হোটেলে আমোদ–ফুর্তির সুযোগ করে দিতেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, পাপিয়ার কাছে যাঁদের আসা–যাওয়া ছিল, তাঁদের বেশির ভাগই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। কিছু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তাঁরাই পাপিয়াকে বিভিন্ন কাজ ও সুবিধা পাইয়ে দিতেন। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পাপিয়ার বেপরোয়া জীবনযাপন এবং তাঁর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর নরসিংদীর স্থানীয় এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতারা যেমন জানতেন, তেমনি বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও অজানা ছিল না বলেই মনে করে সাধারণ মানুষ। কিন্তু আর্থিক লেনদেন, ভাগ–বাঁটোয়ারার বিষয় জড়িত থাকায় সবাই জেনেও চুপ ছিলেন। এখনো এই ঘটনার দায় নিতে চাচ্ছেন না কেউ।

এই বাহিনী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নরসিংদী পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান বলেন, সুমন যখন বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এমন খবরে তাদের নরসিংদী থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এখন তারাই নরসিংদীতে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।

এ বিষয়ে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মতিন ভূঞা বলেন, সুমন-পাপিয়ার মতো সন্ত্রাসী, অস্ত্রবাজদের যেন নরসিংদীতে পুনরায় জন্ম না হয়।

সৌজন্যে : পূর্বপশ্চিম
সিলেটভিউ২৪ডটকম/ ০৭ মার্চ ২০২০/জিএসি

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন