আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং

অবৈধ বাস, ভণ্ডামির কাজ

সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৭-১০-১২ ০২:০৫:১৬

জাকির হোসেন :: ভারতীয় এক নাগরিক অবৈধপথে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় এসে ‘সাধক মা’ পরিচয়ে সর্বরোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন। তাঁর কাছে চিকিৎসা নিতে প্রতিদিন চাকমা, বাঙালি ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের শত শত রোগী ভিড় জমাচ্ছে।

চিকিৎসকরা বলেছেন, এ ধরনের চিকিৎসা প্রতারণার শামিল। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলেছে, কথিত সাধক মা মন্দিরের প্রতিমাকে অবমাননা করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন।

এ ঘটনা উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা সম্প্রদায় অধ্যুষিত বৌদ্ধপাড়ায়। ওই ব্যক্তি এক দিন পুরুষের পোশাক পরেন, আরেক দিন নারীর পোশাক পরেন। তাঁর চালচলন, বাচনভঙ্গি তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) ব্যক্তিদের মতো।

কথিত সাধক মা দাবি করেন, তার নাম চরিত্র দেব বর্মন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার ছেরামি থানার রামকৃষ্ণ গ্রামের মুনিরাম দেব বর্মার সন্তান তিনি। সাধনার বলে মহাদেব তাঁর নাম রেখেছেন শান্তি দেবী। এখন এ নামেই পরিচিত।

তিনি নিজেকে পুরুষ দাবি করেন। প্রায় দেড় মাস আগে অবৈধভাবে ভারতের রইসাপাড়া দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। ২৫ দিন ধরে বৌদ্ধপাড়ায় অবস্থান করছেন।

গত সোমবার গিয়ে দেখা গেছে, বৌদ্ধপাড়া শিবমন্দিরের অদূরে অস্থায়ী বাজারের সামনে বাঁশ দিয়ে তৈরি গেট করে চিকিৎসা নিতে আসা হাজারো লোকজনকে আটকে রাখা হয়েছে। কারণ  ভেতরে চিকিৎসা নিতে লাইনে অপেক্ষমাণ রয়েছে কয়েক শ লোক। তাদের একাংশ ফিরলে এখান থেকে ভেতরে যাওয়ার জন্য কিছু লোক ছাড়া হবে। রোগমুক্তির আশায় গেটে লোকজন ধৈর্য নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে। প্রায় ৩০০ গজ দূরের এ গেটে জুতা খুলে রেখে যেতে হয়। ভেতরে জুতা পায়ে এবং কোনো ক্যামেরা ব্যবহার নিষেধ।

ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, শিবমন্দিরের আঙিনায় পলিথিনের ছাউনি দিয়ে রোগীদের লাইন ধরে বসার জায়গা করা হয়েছে। কিন্তু সে ছাউনিতে জায়গা হচ্ছে না। ছাউনির ভেতরের চেয়ে বাইরে রোগীর সংখ্যা বেশি।

আগত রোগী খাগড়াছড়ির ৩ নম্বর যৌথখামার এলাকার অপর্ণা চাকমা জানান, তিনি দুই বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। সাধক মায়ের কাছে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। থানাপাড়া গ্রামের আরেক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি স্বামীকে না জানিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরে এখানে আসছেন। কিন্তু তাঁর রোগ সারছে না।

সমস্যার কথা সাধক মা (ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের পুরুষের পোশাক পরা) জানতে চাইলে থানাপাড়ার জরিনা খাতুন (৫৫) জানান, কণ্ঠনালিতে মার্বেলের মতো এক গুটি আছে বলে অনুভব হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হননি। শোনার পর কথিত মা মন্ত্র পাঠ করে জানতে চাইলেন গুটিটি চলে গেছে কি না? রোগীর উত্তর, রয়ে গেছে। এরপর তিনি রোগীর গলায় হাত দিয়ে মন্ত্র পাঠ করে জানতে চাইলেন। কিন্তু না কোনো পরিবর্তন নেই। এভাবে তিনি রোগী নিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর জানান, এটি সারার মতো নয়। পরদিন পাঁচটি ফুল ও পাঁচটি ফল নিয়ে আসার পরামর্শ দেন। একইভাবে এক নারী জানান, তাঁর সন্তান হয় না। তিনি নারীকে মন্ত্র পাঠ করে দিয়ে পরবর্তী সময়ে স্বামীসহ আসার পরামর্শ দেন।

দেখা রোগীরা যে যার মতো টাকা দিচ্ছেন, আর সে টাকা কথিত মার সঙ্গে থাকা একজন সহযোগী একটি ব্যাগে ভরে রাখছেন। তার সঙ্গে আরেকজন রয়েছেন ভাষা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।

মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, ভিন্ন এক চিত্র। আগত রোগীদের অনেকে ফিরে যাচ্ছে। সবার মুখে মুখে একই কথা, কার অবমাননার কারণে সাধক মা নাকি সাপ হয়ে গেছেন।   ভেতরে যাওয়া সবার নিষেধ। বিশেষ অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢোকেন এ প্রতিবেদক। গিয়ে দেখেন, মন্দিরের আঙিনায় কথিত মা চিত হয়ে শুয়ে আছেন। চারপাশে অনুসারীরা আগরবাতি জ্বেলে তাঁঁর মঙ্গল কামনা করছেন। পাশে একটি বাটিতে দুধ রাখা আছে। কিছুক্ষণ পর সাপের ভঙিমায় তিনি উঠে বাটির দুধ খেয়ে নিলেন। পরে ঢুকলেন পাশের শিবমন্দিরে। সেখানে শিবলিঙ্গের ওপর অনেক্ষণ বসে থাকলেন। নেমে এসে পাশের আস্তানায় গিয়ে গোসল সেরে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের নারীর পোশাক পরে গেলেন পাশের কালীমন্দিরে। সেখানে গিয়ে দেবী কালীর প্রতিমার সামনে জিহ্বা বের করে শিবের প্রতিমার ওপর দাঁড়ালেন। মন্দিরের পুরোহিত তাঁর পূজা-অর্চনা করলেন। কালী প্রতিমার সামনে রাখা প্রসাদও খেলেন তিনি। এরপর একটি পাঁঠা বলি দেওয়া হলো। আবার ফিরে শিবমন্দিরে শিবলিঙ্গের ওপর দাঁড়ালেন আর পুরোহিতসহ তাঁর অনুসারীরা সেখানে ডাবের জল দিয়ে তার পা ধুইয়ে পূজা-অর্চনা সারলেন। এরপর আবার শুরু হলো রোগীদের চিকিৎসা।

এ বিষয়ে দীঘিনালা উপজেলা সনাতন ছাত্র ও যুব পরিষদের সভাপতি জীবন চৌধুরী উজ্জ্বল বলেন, ‘ভগবান সমতুল্য শিবের প্রতিমার ওপর এই ভণ্ড পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যা ধর্মের জন্য চরম অবমাননাকর। এর প্রতিবাদ করতে গেলে স্থানীয় ত্রিপুরা সম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ’

উপজেলা সনাতন সমাজকল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিউটন মহাজন বলেন, ‘রোগমুক্তির নামে মানুষকে হয়রানিকারী এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ’

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উপজেলা কমিটির সদস্য সমীর চাকমা তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘এ ধরনের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না?’

দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মো. নুরুল আনোয়ার বলেন, ‘এ ধরনের চিকিৎসার বিজ্ঞানসম্মত কোনো ভিত্তি নেই। ধর্মকে পুঁজি করে মানুষ ঠকানো হচ্ছে। একশ্রেণির লোক ব্যবসা করছে। আমি আশা করি, প্রশাসন এর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। ’

দীঘিনালা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রবেশে তাঁর কোনো বৈধতা আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ’

-কালেরকন্ঠ

শেয়ার করুন

আপনার মতামত দিন